২০২০ সালের এপ্রিল মাস। দেশে তখন করোনাকাল, ভয়ে-আতঙ্কে মানুষ দিশাহারা। ৬ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত হলো অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর লেখা, শিরোনাম: ‘অভাবীদের তালিকা করে মোবাইলে টাকা পাঠান’। তখনো করোনার বিপদ, করণীয়, মুক্তির উপায় সম্পর্কে বিশ্ববাসী বেশি কিছু জানে না। শুধু আসছে মৃত্যুর খবর; আক্রান্তের সংখ্যা যাচ্ছে হু হু করে বেড়ে। সেই শুরুর দিনগুলোয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী তাঁর ছোট্ট লেখায় সবগুলো অগ্রগণ্য করণীয় ঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। 

জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, ঘরে থাকুন, সাবান দিয়ে হাত ধৌত করুন, বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরুন, চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে যুক্ত করুন, হোম অফিস ও হোম স্কুল চালু করুন, আর অভাবী মানুষের তালিকা করে তাঁদের মোবাইল ফোনে টাকা পাঠান। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার ২২ দিন পর ২৮ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী নিজের ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে ঘুমের মধ্যে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

স্যারের ক্লাস মন দিয়ে করলে শেখা হয়ে যেত। আর যা পড়াতেন, সেখান থেকে প্রশ্ন করতেন পরীক্ষায়। খারাপ করার কোনো সুযোগ ছিল না।

পাঁচ বছর পর তাঁর ওই শেষ লেখাটি পড়লাম। এই লেখাটায় যেন বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু ধারণ করা আছে। এত ছোট লেখায় দরকারি সব কথা বলার জন্য দরকার হয় প্রজ্ঞা, জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন এক অনন্য প্রাজ্ঞ মানুষ।

১৫ নভেম্বর ১৯৪৩ সালে সিলেটে প্রকৌশলী পরিবারে তাঁর জন্ম। ২০ বছর বয়সে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (তখন ইপুয়েট) থেকে পুরকৌশলে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন রেকর্ড মার্কস নিয়ে। বৃত্তি নিয়ে ১৯৬৪ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনে অ্যাডভান্সড স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর করতে যান। ১৯৬৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পিএইচডির বিষয় ছিল প্রকৌশল কাঠামো নকশায় কম্পিউটারের ব্যবহার। ওই সময় বিলাতে তিনি প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। দেশে ফিরে এসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সেন্টার চালু করেন।

পদ্মা সেতু কিংবা যমুনা সেতুতে যখন চলাচল করি, তখন আমরা জামিলুর রেজা স্যারের কথা স্মরণ করি। বাংলাদেশের আইটি সেক্টর নিয়ে প্রথম যাঁরা স্বপ্ন ও পরিকল্পনা রচনা করেন, তিনি ছিলেন সেখানে অগ্রদূত।

আমি জামিলুর রেজা চৌধুরীর সরাসরি ছাত্র ছিলাম। লেখালেখির প্রতি অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়ায় বুয়েটে আমি ভালো ছাত্রের তালিকায় ছিলাম না। কিন্তু জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের ক্লাসে এবং পরীক্ষায় আমি প্রায় পূর্ণ নম্বর পেয়েছিলাম। এর কারণ, স্যার পড়াতেন কম্পিউটারের মতো করে, প্রথমে বলতেন, গত ক্লাসে আমরা কী শিখেছি। তারপর আজকের ক্লাসে আমরা শিখব। এরপর এতক্ষণ আমরা শিখলাম। স্যারের ক্লাস মন দিয়ে করলে শেখা হয়ে যেত। আর যা পড়াতেন, সেখান থেকে প্রশ্ন করতেন পরীক্ষায়। খারাপ করার কোনো সুযোগ ছিল না।

একবার বুয়েটের স্থাপত্যের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে গন্ডগোল হতে লাগল। আমি তখন সাংবাদিকতা করি। স্যারের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। স্যার বললেন, ‘তুমি কি আকিরা কুরোসাওয়ার ছবি রাশোমন দেখেছ? একই ঘটনা বিভিন্নজন বর্ণনা করছে, কিন্তু একেকজনের বর্ণনা একেক রকম হচ্ছে। আমি যদি ঘটনা সম্পর্কে বলি এক রকম হবে, আর্কিটেকচারের কেউ বললে আরেক রকম হবে।’ এই রকম অনেকবার হয়েছে। জামিলুর রেজা চৌধুরী পরিস্থিতি ব্যাখ্যার জন্য সাহিত্য বা চলচ্চিত্র থেকে উদাহরণ দিয়েছেন।

শুধু নিজে স্বপ্ন দেখেননি তিনি, স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে গেছেন। আমাদের একই সঙ্গে স্বাপ্নিক এবং কর্মবীর মানুষ দরকার, জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন সেই বিরল আলোকিত মানুষ।

বাংলাদেশের বড় বড় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের প্রায় সবকিছুর সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। পদ্মা সেতু কিংবা যমুনা সেতুতে যখন চলাচল করি, তখন আমরা জামিলুর রেজা স্যারের কথা স্মরণ করি। বাংলাদেশের আইটি সেক্টর নিয়ে প্রথম যাঁরা স্বপ্ন ও পরিকল্পনা রচনা করেন, তিনি ছিলেন সেখানে অগ্রদূত। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জাতীয় ইমারত নীতিমালা, ড্যাপ প্রভৃতির পেছনে তিনি ছিলেন প্রধান কারিগর। ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ভাইস চ্যান্সেলর। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কিংবা গণিত অলিম্পিয়াডের মতো আন্দোলনে তিনি ছিলেন মশালবরদার।

জামিলুর রেজা চৌধুরী স্বপ্ন দেখেছিলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পাবেন। পাঁচ বছর বাকি আছে, দেখা যাক, জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের স্বপ্ন পূরণ হয় কি না। শুধু নিজে স্বপ্ন দেখেননি তিনি, স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে গেছেন। আমাদের একই সঙ্গে স্বাপ্নিক এবং কর্মবীর মানুষ দরকার, জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন সেই বিরল আলোকিত মানুষ। মেধাবী, পরিশ্রমী, দেশপ্রেমিক, সজ্জন এবং স্বপ্নবান মানুষ ‘জেআরসি স্যার’কে আমরা কোনো দিনও ভুলতে পারব না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ক ষ প রথম দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধে মামলা অত্যন্ত উদ্বেগজনক: ফারুকী

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রাজধানীর মিরপুরে মাহফুজ আলম শ্রাবণ হত্যার অভিযোগে অভিনেতা ইরেশ যাকেরসহ ৪০৮ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।‎ গত ২০ এপ্রিল নিহতের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পী ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন।

ইরেশ যাকের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় বিনোদন অঙ্গনের অনেক তারকারাই কথা বলছেন। এবার সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সোমবার (২৮ এপ্রিল) সাংবাদিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। এ সময় ইরেশ যাকেরের মামলার বিষয়টি উঠে আসে।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, এখন নিজে সরকারের অংশ; অ্যাক্টিভিসস্ট নই। যে কারণে কথা কম বলে কাজ বেশি করতে হবে। ইরেশ যাকেরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। জানি, তিনি জুলাইয়ের আন্দোলনেও জড়িত ছিলেন। ফলে তার বিরুদ্ধে এই মামলা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, মামলা করেছেন একজন ব্যক্তি। এটি রাষ্ট্রপক্ষ কিংবা সরকারের দেওয়া মামলা না। এখন মামলা করার স্বাধীনতা পেয়েছি সবাই। কেউ কেউ এটার অপব্যবহার করছে। আমি বিশ্বাস করি পুলিশ এটির সঠিক তদন্ত করে, যেটি সত্য সেটির পক্ষে থাকবে আর যেটি মিথ্যা সেটি বাতিল করে দেবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ