বহির্বিভাগের কক্ষে নেমপ্লেট লাগানো মেডিকেল অফিসারের (চিকিৎসা কর্মকর্তা)। ভেতরে রোগী দেখছিলেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় হৃদরোগ, গাইনিসহ অন্য জটিল রোগীরা প্রাথমিক সেবা নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। জরুরি বিভাগেও দায়িত্ব পালন করছিলেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। লেবার ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটার বন্ধ। অন্তঃসত্ত্বা কোনো নারীও ভর্তি নেই। সাধারণ অস্ত্রোপচার কক্ষে ধুলা-ময়লার স্তর পড়েছে। সরেজমিন এমন চিত্র পাওয়া গেছে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় প্রায় ৪ লাখ মানুষের বসবাস। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০ জন সেবা নেন। গাইনি সমস্যা নিয়ে আসেন অন্তত ২০ জন। ৫০ শয্যার বিপরীতে ৬০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। কিন্তু চিকিৎসক সংকটে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন না মানুষ। অস্ত্রোপচার বন্ধ ১৮ বছর ধরে। অ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসক না থাকায় ছয় মাস বন্ধ সিজার। হয় না এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি। পাঁচ চিকিৎসা কর্মকর্তা বহির্বিভাগ ও অন্তঃবিভাগে চিকিৎসা দিচ্ছেন। সর্বশেষ কবে এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন, তা জানা নেই কারও।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ছিলেন উপজেলার হাবাশপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, সীমান্তবর্তী হওয়ায় দুর্গম স্থান থেকেও এখানে রোগী আসেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা তারা পান না। এখানে যে ক’জন চিকিৎসা কর্মকর্তা ও সহকারী আছেন, তারা তাদের মতো চেষ্টা করেন। সীমান্তের মানুষের কষ্টের কথা চিন্তা করে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এখানে দেওয়া জরুরি।  
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জানা গেছে, বর্তমানে কর্মরত কেউ কেন্দ্রটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখেননি। আগে কখনও ছিলেন কিনা, তাও বলতে পারেননি। ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত মাসে গড়ে ১৪ থেকে ১৮টি সিজার হতো। অ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসক চলে যাওয়া অক্টোবরের পর তাও বন্ধ হয়ে যায়। এ সময়ে সাধারণ কোনো অস্ত্রোপচার হয়নি। ২০২২ সালের আগে ১৮ বছর বন্ধ ছিল সব ধরনের অস্ত্রোপচার। ল্যাবে কিছু রোগ শনাক্তের পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১০টি পদই শূন্য। প্রথম শ্রেণির ২০টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন পাঁচজন। চিকিৎসক সংকট থাকায় ১০ উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) দিয়ে রুটিন অনুসারে বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও অন্তঃবিভাগে সেবা দেওয়া হয়। নার্স ও মিডওয়াইফ পদে জনবল সংকট নেই। স্বাস্থ্য পরিদর্শক, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, এমএলএসএসসহ অন্য পদগুলোয় লোকবল সংকট বেশি। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে রোগীকে ছুটতে হয় জেলা সদর, যশোর কিংবা ঢাকা ও খুলনার হাসপাতালে।
বহির্বিভাগে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রাবেয়া খাতুনকে। তিনি বলেন, ‘রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা আমরা দিয়ে থাকি।’ এদিন চিকিৎসা নিতে আসা দারিয়াপুর গ্রামের মোহাম্মদ ইব্রাহীমের ভাষ্য, হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে এলেও কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। চিকিৎসা কর্মকর্তাকেও পাননি। 
উপজেলার গেড়ামারা গ্রামের আফরোজা বেগম অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূকে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু গাইনি চিকিৎসক না পেয়ে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ফিরে যান। তিনি বলেন, এখানে যদি গাইনি চিকিৎসক থাকতেন, তাহলে ভালো হতো। 
সংকটের মধ্যেও সাধ্যমতো রোগীর সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.

মাহমুদ বিন হেদায়েত। তিনি বলেন, চিকিৎসা কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদায়নসহ অন্য সংকট সমাধানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবারই বলা হচ্ছে। এতে শতভাগ সেবা দেওয়া যেত। বরাদ্দ অনুসারে সরকারি ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
জনবল সংকটের কারণে এ অবস্থা বলে জানান ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, অ্যানেসথেসিয়া, সার্জারি ও গাইনি বিশেষজ্ঞ নেই। ফলে সব অস্ত্রোপচার বন্ধ। পদোন্নতি পাওয়া অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রত্যন্ত এলাকায় আসতে চান না। অনেক চিকিৎসক আছেন, যাদের ডিগ্রি থাকলেও পদোন্নতি হয়নি। এসব কারণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কবে নিয়োগ দেওয়া যাবে, সেটিও নিশ্চিত না। চিকিৎসক নিয়োগ বা প্রমোশন হলে বিশেষজ্ঞ সেবা চালু করা সম্ভব হবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ব স থ য কমপ ল ক স ম ড ক ল অফ স র চ ক ৎসক ন চ ক ৎসক র কর মকর ত উপসহক র র বন ধ উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

রাতের ব্যবধানে শত কৃষকের সর্বনাশ

ধারদেনা করে ৮৫ শতাংশ জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছেন মজিবর রহমান (৬৫)। এ জমির ধান দিয়েই ছয় সদস্যের পরিবারের সারা বছরের খোরাকি হবে– এমন আশা ছিল তাঁর মনে। ঢাকার ধামরাই উপজেলার বাসনা নয়াপাড়ার এই চাষির আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে পাশের একটি ইটভাটার কারণে। গত বুধবারও সুস্থ-সবল ধান ছিল ক্ষেতে। ওই রাতেই পাশের টাটা ব্রিকস থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় বিষাক্ত গ্যাস। এতে বাতাস উত্তপ্ত হয়ে পুড়ে গেছে মজিবরের ক্ষেতের সব ধান। 
গতকাল শনিবার নিজ জমির ধান দেখিয়ে আক্ষেপ করছিলেন মজিবর রহমান। তাঁর প্রশ্ন, ঋণের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন, পুরো বছর কীভাবেই বা চালাবেন সংসার খরচ? এই চাষির মতো ক্ষতির শিকার হয়েছেন বাসনা নয়াপাড়া ও নওগাঁহাটি এলাকার আব্দুল খালেক, আব্দুল মজিদ, আব্দুল লতিফ, কালু মিয়া, হানিফ আলী, রকেট, জিয়াউদ্দিন, নজরুল ইসলাম, সালামসহ শতাধিক কৃষক। তাদের অন্তত ২০০ বিঘা জমির আধাপাকা ধান পুড়ে গেছে।
ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে গতকাল শনিবার ও শুক্রবার কৃষকরা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে নালিশ করেন। তাঁর নির্দেশনায় শনিবার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা পরিতোষ বিশ্বাস, তাপস কুমার সরকার ও সুমন হোসেন ধানি জমিগুলো পরিদর্শন করেছেন।
ধামরাই উপজেলায় ফসলি জমির আশপাশে গড়ে তোলা ইটভাটার সংখ্যা দুই শতাধিক। এরই একটি নওগাঁহাটি এলাকার টাটা ব্রিকস। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, গত বুধবারও তাদের জমির বোরো ধানগাছ সবুজ ছিল। সেদিন রাতেই ওই টাটা ইটভাটার কিলিনে জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাস ছেড়ে দেওয়া হয়। এর পরই এলাকার বাতাস উত্তপ্ত হয়ে যায়। ওই বাতাস যেদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সেই অংশেরই ধান গাছের পাতা পুড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার থেকেই সব ধানগাছ লাল হয়ে চিটা ধরে যায়।
সব মিলিয়ে আশপাশের প্রায় ২০০ বিঘা বোরো ধান ক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাসনা নয়াপাড়ার কৃষক নজরুল ইসলাম ও আব্দুল 
খালেক। তারা এ জন্য ওই ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসকেই দায়ী করেন। বিষয়টি তারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত জমি পরিদর্শনের পর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা পরিতোষ বিশ্বাস বলেন, ইটভাটার মালিকপক্ষ ধানক্ষেত পুড়ে নষ্ট হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। তারা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
টাটা ব্রিকসের ব্যবস্থাপক আব্দুল খালেকও তাদের ভাটা থেকে ছাড়া গ্যাসের আগুনে কিছু জমির ধান নষ্ট হওয়ার কথা স্বীকার করেন। তাঁর ভাষ্য, উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। তাদের ভাটা মালিক আবুল হোসেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা চেয়েছেন। এ বিষয়ে তাদের (কৃষক) সঙ্গে বসেই সমাধান করা হবে। 
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, ইটভাটার আগুনে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি কৃষকদের কাছ থেকে জানতে পারেন তিনি। পরে তিন কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত পরিদর্শন করেছেন। ইটভাটা মালিক কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। দু-এক দিনের মধ্যে না দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাতের ব্যবধানে শত কৃষকের সর্বনাশ