নারী সংস্কার কমিশনে নারীর উত্তরাধিকার ও প্রস্তাবনা
Published: 27th, April 2025 GMT
১৯৫৬ সালে সেবার খুব কলেরার প্রকপ হয়েছিল। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছিল ওলাওঠায়। হামিদা বেগম রেখার ৮ মাস বয়সে তার স্কুলশিক্ষক বাবা মারা যান সেরকম এক রাতে কলেরায়। ২ বছর পর তার কিশোরী মায়ের অন্যত্র আবার বিয়ে হয়ে যায়। রেখার দাদাবািড় এবং নানাবাড়ি একই উঠানের এপার-ওপার হলেও তিনি নানাবাড়িতে লালিত-পালিত হতে থাকেন। শরিয়া আইন অনুযায়ী যেহেতু দাদার সামনে বাবা মারা গেলে তার সন্তানাদি দাদার সম্পত্তির উত্তরাধিকার বঞ্চিত হয়, ফলে তৎকালীন অন্য সব শিশুর মতোই তার ঠাঁই দাদাবাড়ি হয়নি। ১৯৬৩ সালে দাদা ইসমাইল সরদার মারা যাওয়ার ২ বছর আগে ১৯৬১ সালে একটি যুগান্তকারী আইন পাশ করে আইয়ুব খান সরকার- মুসলিম পারিবারিক আইন! এই আইনের বলে মৃত পিতার সমপরিমাণ সম্পদের উত্তরাধিকার স্বত্ব পেয়ে যান তার সন্তানেরা। হামিদা বেগম রেখা অবশ্য এই আইন সম্পর্কে জানতে পারেন আরো পরে এসে আশির দশকে এবং এরপর তিনি মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ ৬ বছরের আইনি লড়াইয়ের পর ১৯৯২ সালে আদালত তার পক্ষে রায় দেন এবং তিনি তার দাদার সম্পত্তির বাবার অংশ পুরোটাই লাভ করেন। এই সম্পত্তি তাকে নানাভাবে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে। সন্তানের লেখাপড়া চালিয়েছেন এই সম্পত্তি বিক্রি করে। সেই লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম বলেই হয়তো আজকে এই লেখার সুযোগ পাচ্ছি!
জি, এটি আমার মায়ের গল্প। পাকিস্তানের সময় আমাদের মনে নানাভাবে ক্ষত সৃষ্টি করলেও আমি মনে করি, এই একটি আইন একটি বিরাট দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। লক্ষ লক্ষ অকালপ্রয়াত বাবার সন্তানদের মাথার উপর ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে এই আইন।
আমরা একটা যুগের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। ফলে দীর্ঘ দিনের অন্যায্যতা, বৈষম্য সারিয়ে নতুন করে সমাজ বিনির্মাণের সময় এসেছে। সম্প্রতি নারী সংস্কার কমিশন নারীর বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সম-অধিকারের বিষয়ে সুপারিশ করছে। সেই সুপারিশ সমর্থন করতেই আমার এই লেখা। আমরা পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশ এবং ভারতীয় উত্তরাধিকার আইনগুলো দেখব এবং সেখান থেকে বোঝার চেষ্টা করব- এই দাবি কতটা যৌক্তিক?
বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, যার পরিবারিক আইন ১৯৬১ সালের Muslim Family Laws Ordinance অনুযায়ী পরিচালিত হয়। ইসলামের আদলে নারীদের উত্তরাধিকার অধিকার স্বীকৃত হলেও বাস্তবতা হলো—নারীরা প্রায়শই পরিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম ও বহুধর্মীয় দেশ যেমন তুরস্ক, তিউনিসিয়া এবং ভারত নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। সে আলোকে বাংলাদেশেও সময় এসেছে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার আইনি ও সামাজিকভাবে নিশ্চিত করার।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই বাংলাদেশের প্রচলিত শরিয়াভিত্তিক উত্তরাধিকার ব্যবস্থায়। নারী পুরুষের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তি পান (যেমন ভাই ২ অংশ, বোন ১ অংশ), স্ত্রী পায় স্বামীর সম্পত্তির ১/৮ বা ১/৪ ভাগ। অথচ নারীর জীবনে অর্থনৈতিক চাহিদা বা দায়িত্ব কম নয়। যদিও ইসলাম নারীদের উত্তরাধিকারে অধিকার দিয়েছে, বাস্তবে সমাজে এটি প্রয়োগ হয় না। অধিকাংশ নারী ভাই বা স্বজনদের চাপ কিংবা পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে সম্পত্তি দাবি করতে পারেন না। অনেক সময় ‘ভ্রাতৃপ্রেমে’ ছেড়ে দেওয়ার চাপ তৈরি করা হয়।
তুরস্ক ও তিউনিসিয়ার দৃষ্টান্ত: ধর্মীয় কাঠামো থেকে নাগরিক অধিকারে রূপান্তরিত তুরস্ক ১৯২৬ সালে সুইস সিভিল কোড গ্রহণ করে শরিয়াহ নির্ভর পরিবারিক আইন বাতিল করে। এতে নারী-পুরুষ সমানভাবে উত্তরাধিকার লাভ করেন।
তিউনিসিয়া ২০০৪ ও ২০১৮ সালে নারী অধিকারে সংস্কারমুখী আইন প্রস্তাব করে। উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের কথা বলা হয়েছে—যদিও ধর্মীয় বিতর্ক থাকলেও রাষ্ট্র নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টায় এগিয়েছে। এই দুই রাষ্ট্র দেখিয়েছে যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নাগরিক অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য রেখে আইন সংস্কার সম্ভব।
ভারতের অভিজ্ঞতা: আইনগত স্বীকৃতি ও প্রগতিশীলতা ভারতে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে ২০০৫ সালের সংশোধনী অনুযায়ী, কন্যারা এখন বাবার সম্পত্তিতে সমান অংশীদার। মুসলিমদের ক্ষেত্রে শরিয়াহ প্রযোজ্য হলেও নারীবান্ধব আইন প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনা চলছে। ভারতের প্রেক্ষাপটে নারীর আইনি সুরক্ষা রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কেন বাংলাদেশে সমানাধিকার প্রয়োজন?
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: সম্পত্তিতে অধিকার নারীর আর্থিক স্বাবলম্বিতার ভিত্তি। সমানাধিকার নিশ্চিত না হলে নারীরা চিরকাল পরিবার বা স্বামীর উপর নির্ভরশীল থাকবেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি: বাংলাদেশ সিড’ (CEDAW) ও এসডিজি লক্ষ্য অনুযায়ী নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। অথচ উত্তরাধিকার আইনে সমতা অনুপস্থিত।
সামাজিক পরিবর্তনের চাহিদা: শিক্ষিত, কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু আইন এখনো শত বছর আগের বাস্তবতাকে ধারণ করে আছে।
প্রস্তাবনা
আইনি সংস্কার: একটি সমন্বিত Family Inheritance Reform Act প্রণয়ন করে নারী-পুরুষ সমান অংশ নির্ধারণ করা যেতে পারে, অন্তত ইসলামি উত্তরাধিকারের পুনঃব্যাখ্যার মাধ্যমে (ইজতিহাদের আলোকে)।
অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা: নারীরা সম্পত্তিতে অধিকার না পেলে জেলা প্রশাসক বা হিউম্যান রাইটস কমিশনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানাতে পারবেন এমন ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।
সচেতনতা ও সামাজিক উদ্যোগ: পরিবারিকভাবে নারীকে সম্পত্তি হস্তান্তরকে উৎসাহিত করতে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা, মিডিয়া প্রচার ও এনজিওদের কাজ গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্বে এগিয়ে গেলেও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে এখনো বঞ্চিত। ন্যায়বিচার, মানবিকতা এবং বহুত্ববাদের বাংলাদেশ গড়তে হলে, সেই চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে নাগরিক অধিকারের আলোকে উত্তরাধিকার আইন সংস্কার আজ সময়ের দাবি। সমতা না হলে নারীর সত্যিকারের ক্ষমতায়ন অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
লেখক: চিন্তক, মানবাধিকারকর্মী
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর ব র ক অন য য় আইন স
এছাড়াও পড়ুন:
সমকালে সংবাদ প্রকাশের পর লম্বাশিয়া পাহাড়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করল প্রশাসন
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের লম্বাশিয়া পাহাড় ধ্বংস করছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। লম্বাশিয়া পাহাড়টি বালু প্রকৃতির, যার ফলে এ পাহাড় ঘেঁষে যাওয়া সাতগরিয়া ছড়ার পানির পথ পরিবর্তন করে দেয় বালুখেকোরা। আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ে পাহাড়। শ্যালো মেশিন দিয়ে উত্তোলন করা হয় বালু। এভাবেই চলছে দেড় যুগ ধরে।
এ ছড়ায় শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে এক কিলোমিটারজুড়ে পাহাড়ের ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে। রোববার দৈনিক সমকালে ‘লম্বাশিয়া পাহাড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চলছেই’ শিরোনাম সংবাদ প্রকাশ হয়। এ সংবাদ প্রকাশের এক দিন পর রোববার দুপুরে লোহাগাড়া উপজেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় অবৈধভাবে উত্তোলিত বালুর ঢিবি নষ্ট করে দেওয়া হয়। বালু উত্তোলনের জন্য ব্যবহৃত অবৈধভাবে মজুদ করা পানি কেটে বের করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বালু পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত রাস্তা কেটে গর্ত তৈরি করে দেওয়া হয়, রাস্তার মাঝে পিলার পুঁতে কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া হয়।
লোহাগাড়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাজমুন লায়েল ও সহকারী বন সংরক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত হয়। সঙ্গে ছিলেন চুনতির রেঞ্জ অফিসার মো. আবীর হাসান, সাতগড় বিটের বিট অফিসার মহসিন আলী ইমরানসহ থানা পুলিশ ও বনবিভাগের সদস্যরা।
২০২৩ সলের ২৪ ডিসেম্বর দৈনিক সমকালে ‘অবৈধ বালু উত্তোলন চলছেই, কিলোমিটার জুড়ে ক্ষতচিহৃ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। ওই সংবাদ প্রকাশের পরও বনবিভাগ ও প্রশাসন রাস্তায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। তখনই বন্ধ হয়ে যায় অবৈধ বালু উত্তোলন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আরেক দল দূর্বৃত্ত কাঁটাতার তুলে আবারও অবৈধ বালু উত্তোলন করে।