বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নাগরিকদের অধিকার, সুরক্ষা, অবহেলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে ৮ দফা সুপারিশ করেছে ডিস্যাবিলিটি রাইটস ওয়াচ (ডিআরডাব্লিউ)।

শনিবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সহযোগিতায় আয়োজিত এক সম্মেলনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডিস্যাবিলিটি রাইটস ওয়াচের সভাপতি মনসুর আহমেদ চৌধুরী, সদস্য সচিব খন্দকার জহুরুল আলম, সদস্য মো.

জাহাঙ্গীর আলম, প্রতিবন্ধী উন্নয়নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডা. নাফিসুর রহমান এবং টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, প্রতিবন্ধী নাগরিকদের প্রতি বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে এখনই কার্যকর ও সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে ডিআরডাব্লিউর পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপস্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ (সিআরপিডি) ২০০৭ সালে বাংলাদেশ অনুসমর্থন করলেও এবং ২০১৩ সালে ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করা হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অত্যন্ত সীমিত। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এখনও নানা রকম অবহেলা, বঞ্চনা ও অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন।

ডিআরডাব্লিউ জানায়, দেশের উন্নয়নে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা না হলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও সম্ভব হবে না। তারা উল্লেখ করে, ২০১৯ সালে গৃহীত ‘প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা’ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি এবং জাতীয় পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটিগুলোও প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

ডিআরডাব্লিউ তাদের সংবাদ সম্মেলনে সরকারের কাছে আট দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেছে। সুপারিশগুলো হলো:

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক দায়িত্ব পুনর্বিন্যাস: প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাবিষয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সেবাগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্থানান্তর করা।

আইন বাস্তবায়নে কমিটি সচল করা: জাতীয় ও জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোকে কার্যকর করতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া।

সিআরপিডি বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ: জাতীয় পর্যায়ে প্যারিস প্রিন্সিপাল অনুযায়ী শক্তিশালী পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন।

এসডিজি কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি: এসডিজি রিপোর্টিংয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন সংক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা এবং সবক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতাভিত্তিক পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা।

জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক বরাদ্দ বাড়ানো: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা।

সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী কোটা পুনর্বহাল: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এক শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা এবং তা পূর্ণভাবে কার্যকর করা।

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন পুনর্গঠন: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ও দক্ষতা বাড়িয়ে ফাউন্ডেশনটিকে আরও শক্তিশালী করা।

ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধীনে একটি আলাদা ক্রীড়া ফেডারেশন গঠন করা।

ডিআরডাব্লিউর পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত বছর ২ নভেম্বর সংগঠনটির প্রতিনিধিদল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসব সুপারিশ লিখিত আকারে পেশ করা হয়েছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ট আইব ড আরড ব ল ক র যকর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

জনমত জরিপগুলো কী বার্তা দেয়

সম্প্রতি নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচনের দাবিতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে দেশের নাগরিক সমাজের ‘মূলধারা’ নির্বাচনের পক্ষে ভাষ্য তৈরি করছে। যুক্তি– গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে নির্বাচনের বিকল্প নেই। সুতরাং অচিরেই নির্বাচন লাগবে। মজার বিষয়, সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন জরিপে দেশের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ লোক সংস্কারের পর নির্বাচনের পক্ষে। জরিপগুলো পরিচালনা করেছে দৈনিক যুগান্তর, কালবেলা, খালেদ মুহিউদ্দীনের জানতে চাইসহ একাধিক সংবাদমাধ্যম। 

নির্বাচন 
কালবেলা পত্রিকার একটি অনলাইন জরিপে প্রশ্ন ছিল: ‘নির্বাচন ডিসেম্বরের পরে গেলে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, সতর্ক করল বিএনপি। আপনিও কি তাই মনে করেন?’ ৮০ হাজার লোক এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। ৮২ শতাংশ ‘না’ এবং ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ। ২ শতাংশের মন্তব্য নেই। 

খালেদ মুহিউদ্দীনের আরেকটি অনলাইন জরিপের প্রশ্ন ছিল: ‘ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন, এমন দাবি সামনে রেখে বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। প্রিয় দর্শক, এই উদ্যোগ সমর্থন করেন কি?’ এই প্রশ্নের জবাবে ৭৭ শতাংশ ‘না’ ভোট দিয়েছে। ‘হ্যাঁ’ ভোটের পক্ষে ২৩ শতাংশ। দৈনিক যুগান্তরের একটি অনলাইন জরিপের প্রশ্ন ছিল: ‘নববর্ষে জাতির আকাঙ্ক্ষা দ্রুত ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। রুহুল রিজভীর এই বক্তব্যকে কি সমর্থন করেন?’ ৮৫ শতাংশ ভোটার এই প্রশ্নের জবাবে ‘না’ ভোট দিয়েছে। ১৩ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ এবং ২ শতাংশ ‘মন্তব্য নেই’ জানিয়েছে। 

শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের শরিকদের প্রধান দাবি– শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা এবং আওয়ামী লীগের বিচার করা। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করছে। কালবেলা পত্রিকার এ সংক্রান্ত একটি অনলাইন জরিপের প্রশ্ন ছিল: ‘মোদির কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছেন ড. ইউনূস। ভারত কি শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে বলে মনে করেন?’ ৪৪ হাজার ভোটারের মধ্যে ৮৪ শতাংশ মনে করে– ‘ফেরত দেবে না’। ১৩ শতাংশ মনে করে– ‘ফেরত দেবে’। মাত্র ৩ শতাংশ ভোটারের মন্তব্য নেই। এতে দুই দেশের সম্পর্কের জটিলতার চিত্রই উঠে আসে, যেখানে হাসিনার বিচার করা দুরূহ বলেই মনে হচ্ছে। 

সরকারের মেয়াদ
বর্তমানে রাজনীতিতে নির্বাচন ও সংস্কার বিতর্কে নতুনভাবে যোগ হয়েছে ড. ইউনূসের সরকার প্রসঙ্গ। গত সপ্তাহে ‘মার্চ ফর ড. ইউনূস’ লেখা ব্যানারযোগে এক ঝাঁক তরুণ ও কয়েকজন প্রবীণকে মাঠে তৎপর দেখা গেছে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন দিয়ে জনমত যাচাই করেছে দৈনিক যুগান্তর। জরিপের প্রশ্ন ছিল: ‘সাধারণ মানুষ চাচ্ছে এই সরকার আরো পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাক। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলমের এই মন্তব্যের সাথে কি আপনি একমত?’ ৯০ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ ভোট দিয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধি অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে এ ধরনের ফলাফল মূলত বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে জনঅসন্তোষের প্রতিফলন। 

ভোটারের মনোভাব
অনলাইন জরিপের ভোটারদের মনোভাব বোঝার জন্য যুগান্তর পত্রিকার একটি জরিপ গুরুত্বপূর্ণ। এতে ভোটাররা কোনোভাবে পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা হুজুগে কিনা, তার ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। যেমন, ‘বিক্ষোভে গিয়ে যারা জুতার দোকানে লুটপাট করেছে তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করেন?’ ৯৪ হাজার লোক এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। মুসলিমবিশ্বে ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে তীব্র মনোভাব গড়ে উঠেছে। দেশে সম্প্রতি একটি অংশ এই সুযোগে ইসরায়েলি পণ্যের কথা বলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে দোকান লুটপাট করেছে। সাধারণ মানুষ এ ধরনের হুজুগেপনার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, যা জরিপেও উঠে এসেছে। ৯৪ শতাংশ ভোটার জড়িতদের শাস্তি দিতে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছে। মাত্র ৪ শতাংশ ভোটারের অবস্থান ‘উচিত না’। ২ শতাংশের মন্তব্য নেই। 
সমাপনী বিশ্লেষণ প্রতিটা জরিপের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তেমনি অনলাইন জরিপেরও কিছু ঘাটতি থাকে। এখানে উপস্থাপিত জরিপগুলোর ফলাফল শেষ পর্যায়ে কমবেশি হতে পারে। তবে সম্ভাব্য ফলাফল স্পষ্ট। এ ধরনের জরিপের সঙ্গে সরাসরি স্মার্টফোন ব্যবহার ও ইন্টারনেটের সম্পর্ক রয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত থাকে ওই জনগোষ্ঠীর মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা, বয়স এবং সাম্প্রতিক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ। 

২০২৫ সালের ৫ জানুয়ারি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জরিপমতে, দেশের ৭০ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পরিবার একটি স্মার্টফোন ব্যবহার করে। তবে অর্ধেক পরিবার এখনও ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছে না। দেশের ২ হাজার ৫৬৮টি এলাকার ৬১ হাজার ৬৩২টি পরিবার থেকে এসব তথ্য সংগ্রহের ভিত্তিতে এই ফলাফল জানা গেছে। দেশের একটি সাংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মোবাইল ফোন ও ব্রডব্যান্ড মিলিয়ে দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি, যা গত জুনে ছিল ১৪ কোটি ২২ লাখ। 
সর্বোপরি, এখানে উপস্থাপিত জরিপের ভিত্তিতে বলা যায়, দেশের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক অবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের পক্ষে। একই সঙ্গে জরিপে পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে।

ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল 
iftekarulbd@gmail.com 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ