ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিগুলোর বিস্ময়কর বিষয় হলো, মানুষ এখনো এসব নীতি দেখে বিস্মিত হচ্ছেন। ট্রাম্প যখনই বৈশ্বিক উদারপন্থী ব্যবস্থার একটি ভিতে আঘাত হানছেন, তখনই খবরের শিরোনামে অভিঘাত ও হতাশা ফুটে উঠছে। সেটা ইউক্রেনের ভূখণ্ডে রাশিয়ার দাবির প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন জানানো বা গ্রিনল্যান্ডকে বলপূর্বক যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হিসেবে যুক্ত করার অভিলাষই হোক, কিংবা তাঁর নিজের ইচ্ছেমতো শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে আর্থিক দুনিয়া টালমাটাল করে দেওয়া হোক। তারপরও তাঁর নীতিগুলো এতটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং দুনিয়া সম্পর্কে তাঁর দর্শন এতটা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত যে এই পর্যায়ে কেবল স্বেচ্ছায় আত্মপ্রবঞ্চক হওয়া কোনো ব্যক্তি বিস্মিত হতে পারেন।

২.

উদারপন্থী ব্যবস্থার সমর্থকেরা বিশ্বকে দেখে থাকেন এমন একটি পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে, যেখানে সবাই লাভবান হন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে সংঘাত অনিবার্য নয়; কারণ, সহযোগিতা থেকে সবাই উপকার পান। এই বিশ্বাসের গভীর দার্শনিক শিকড় রয়েছে। উদারপন্থীরা যুক্তি দেন যে সব মানুষ কিছু অভিন্ন অভিজ্ঞতা ও স্বার্থ দ্বারা তাড়িত, যা সর্বজনীন মূল্যবোধ, বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি রচনা করেছে। 

উদাহরণস্বরূপ, সব মানুষই রোগবালাইকে অপছন্দ করেন আর তাই সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার রোধ করা তাঁদের সবার অভিন্ন স্বার্থ। সে কারণেই চিকিৎসাবিষয়ক জ্ঞান বিনিময়, মহামারি দূরীকরণে বৈশ্বিক প্রয়াস এবং এসব কাজের সমন্বয় করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতো প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মধ্য দিয়ে সব দেশই উপকার পেতে পারে। একইভাবে উদারপন্থীরা যখন বিভিন্ন দেশের মধ্যে চিন্তাভাবনা, পণ্য ও মানুষের প্রবাহের দিকে দৃকপাত করেন, তখন তাঁরা একে অনিবার্য প্রতিযোগিতা ও শোষণের বদলে পারস্পরিক উপকারের সম্ভাবনা হিসেবে দেখে থাকেন।

■ ট্রাম্পের দৃষ্টিতে দুনিয়ার প্রতিটি লেনদেনে হার-জিত আছে। তাই এই বিশ্ব হলো এমন একটি খেলার ময়দান, যেখানে এক পক্ষ জিতবে, আরেক পক্ষ হারবে। ■ ট্রাম্পীয় বিশ্বদর্শনে ন্যায়বিচার, নৈতিকতা ও আন্তর্জাতিক আইন অপ্রাসঙ্গিক; বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচ্য হলো শক্তি বা ক্ষমতা, যেখানে দুর্বলেরা সবলদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে।

এসবের বিপরীতে ট্রাম্পের দৃষ্টিতে দুনিয়ার প্রতিটি লেনদেনে হার-জিত আছে। তাই এই বিশ্ব হলো এমন একটি খেলার ময়দান, যেখানে এক পক্ষ জিতবে, আরেক পক্ষ হারবে; কিন্তু কোনোভাবেই সবাই লাভবান হবে না। সে কারণেই চিন্তাভাবনা, পণ্য ও মানুষের আদান–প্রদান মজ্জাগতভাবেই সন্দেহজনক বিষয়। 

ট্রাম্পের দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক চুক্তি, প্রতিষ্ঠান ও আইন আর কিছুই নয়, কেবল কিছু দেশকে দুর্বল ও বাকিদের সবল করার এক কৌশলমাত্র; অথবা সম্ভবত সব দেশকে দুর্বল বানিয়ে শুধু একদল দুষ্ট অথচ অভিজাত বৈশ্বিক নাগরিককে (কসমোপলিটন এলিট) সুবিধা দেওয়ার চক্রান্ত।

তাহলে ট্রাম্পের কাছে পছন্দনীয় বিকল্প কী? তিনি যদি বিশ্বকে তাঁর নিজের পছন্দমতো পুনর্গঠন করতে পারতেন, তাহলে তা কী রকম দাঁড়াত?

৩.

ট্রাম্পের আদর্শ দুনিয়া হলো অনেকগুলো ‘রক্ষণদুর্গের এক সমারোহ’, যেখানে বিভিন্ন দেশ একে অপরের থেকে আলাদা থাকবে আর্থিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক তো বটেই, এমনকি সত্যিকারের ইট-পাথরের প্রাচীর দ্বারা। এখানে পারস্পরিক সহযোগিতা থেকে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা তিরোহিত; বরং ট্রাম্প ও তাঁর মনোভাবাপন্ন জনতুষ্টিবাদীদের যুক্তি হলো, এহেন দুর্গ-প্রাচীর দেশগুলোকে অধিকতর শান্তি ও স্থিতিশীলতা এনে দেবে।

অবশ্যই এ চিন্তাচেতনায় গুরুত্বপূর্ণ একটিবিষয় অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস আমাদের এটা শিখিয়েছে যে প্রতিটি দুর্গই সম্ভবত সবার চেয়ে একটু বেশি নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও ভূসীমা চাইবে নিজের জন্য এবং তা তার প্রতিবেশীর মূল্যে। মানে প্রতিবেশীকেই ছাড় দিতে হবে। সর্বজনীন মূল্যবোধ, বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক আইনের অনুপস্থিতিতে কীভাবে এসব প্রতিদ্বন্দ্বী দুর্গগুলো তাদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তি করবে?

ট্রাম্পের কাছে অবশ্য সহজ সমাধান আছে: সংঘাত এড়াতে দুর্বলদের উচিত হবে সবলদের সব দাবি মেনে নেওয়া। এ রকম মতবাদ অনুসারে, দুর্বলেরা যখন বাস্তবতা মেনে নিতে অস্বীকার করে, তখনই সংঘাত দেখা দেয়। এ কারণেই যুদ্ধ বাধার জন্য সব সময় দুর্বলেরাই দায়ী।

ট্রাম্প যখন রাশিয়ার আগ্রাসনের জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করলেন, তখন অনেকেই বুঝতে পারছিলেন না যে কীভাবে তিনি এ রকম ভ্রান্ত মনোভাব পোষণ করেন। কেউ কেউ ভেবেছিলেন যে তিনি রুশ প্রচার-প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু এর সহজতর ব্যাখ্যা আছে। 

ট্রাম্পীয় বিশ্বদর্শনে ন্যায়বিচার, নৈতিকতা ও আন্তর্জাতিক আইন অপ্রাসঙ্গিক; বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচ্য হলো শক্তি বা ক্ষমতা। যেহেতু ইউক্রেন রাশিয়ার চেয়ে দুর্বল, সেহেতু তার আত্মসমর্পণ করা উচিত। ট্রাম্পীয় বিবেচনায় শান্তি মানে সমর্পণ আর ইউক্রেন যেহেতু আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেছে, তাই এই যুদ্ধ বেধেছে এবং এটাও তারই দোষ।

এই একই যুক্তিতে ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হিসেবে যুক্ত করতে চান। ট্রাম্পীয় যুক্তি হলো, যদি দুর্বল ডেনমার্ক অধিকতর শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রর কাছে গ্রিনল্যান্ডকে ছেড়ে না দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে অভিযান চালিয়ে শক্তি দিয়ে গ্রিনল্যান্ড দখল করে নেওয়া আর এ জন্য সংঘটিত যেকোনো সহিংসতা ও রক্তপাতের জন্য এককভাবে দায়ী হবে ডেনমার্ক।

৪.

প্রতিদ্বন্দ্বী দুর্গগুলো বাস্তবতা মেনে ও সমঝোতা করে সংঘাত এড়াতে পারে বলে যে ট্রাম্পীয় ধারণা দাঁড় করানো হয়েছে, এর তিনটি বিশাল সমস্যা রয়েছে।

প্রথমত, দুর্গের সমাহারে গড়া একটি দুনিয়ায় সবাই কম হুমকির মুখে থাকবে এবং প্রতিটি দেশ শান্তিপূর্ণভাবে নিজ ঐতিহ্য ও অর্থনীতির উন্নতিতে মনোযোগী হতে পারবে—এই প্রতিশ্রুতির মিথ্যা দিকটা ওই ধারণা থেকে খোলামেলাভাবে প্রকাশ পায়। বস্তুত দুর্বল ‘দুর্গগুলো’ শিগগিরই দেখতে পাবে যে তাদের শক্তিশালী প্রতিবেশী দুর্গগুলো তাদের গিলতে শুরু করেছে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় দুর্গগুলো পরিণত হবে বিস্তৃত বহুজাতিক সাম্রাজ্যে।

ট্রাম্প নিজে তাঁর সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা নিয়ে খুব পরিষ্কার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ড ও ধনসম্পদ রক্ষার জন্য সীমানাপ্রাচীর গড়তে চান, আবার একসময়ের মিত্ররাসহ অন্যান্য দেশের ভূখণ্ড ও সম্পদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। ডেনমার্কের উদাহরণ আবার টানতে হয়। 

দশকের পর দশক দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বিশ্বস্ত মিত্র ছিল। ৯/১১ হামলার পর ডেনমার্ক স্বপ্রণোদিত হয়ে ন্যাটো চুক্তির বাধ্যবাধকতা পূরণ করেছে। আফগানিস্তানে ন্যাটোর ৪৪ জন সেনা প্রাণ হারিয়েছেন, যা মাথাপিছু সৈন্য প্রাণহানিতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। অথচ ট্রাম্প ‘ধন্যবাদ’ দেওয়ার প্রয়োজনটুকু বোধ করেননি; বরং তাঁর প্রত্যাশা যে ডেনমার্ক তার সাম্রাজ্যবাদী বাসনার কাছে সমর্পিত হবে। স্পষ্টতই তিনি মিত্রর চেয়ে অনুচর চান।

দ্বিতীয় সমস্যা হলো, কোনো ‘দুর্গ’ই যেহেতু দুর্বল হলে টিকতে পারবে না, সেহেতু তারা সবাই সামরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপের মুখে থাকবে। তাই অর্থনৈতিক উন্নতি ও কল্যাণ কার্যক্রম থেকে সম্পদ সরিয়ে সামরিক খাতে আনা হবে। এভাবে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা সবারই সমৃদ্ধি কমিয়ে দেবে। কিন্তু কেউই অধিকতর নিরাপদ বোধ করবে না।

তৃতীয়ত, ট্রাম্পীয় ভাবনা এটা প্রত্যাশা করে যে দুর্বলেরা সবলদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে কারা সবল বা শক্তিশালী, তা নির্ধারণের মাপকাঠি স্পষ্ট নয়। যদি দেশগুলো হিসাব-নিকাশে ভুল করে, যেমনটা প্রায়ই ইতিহাসে দেখা যায়! 

১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত ছিল যে তারা উত্তর ভিয়েতনামের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। তাই যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করলেই হ্যানয়ের সরকার সমঝোতায় আসবে। উত্তর ভিয়েতনাম তো যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয়নি; বরং বিরাট এক ঝুঁকিপূর্ণ বাজি ধরে এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে আগে থেকে জানবে যে আসলে সে নিজেই দুর্বল?

একইভাবে ১৯১৪ সালে জার্মানি ও রাশিয়া—উভয়েই বড়দিনের আগেই যুদ্ধে জয়লাভ করার ব্যাপারে প্রত্যয়ী ছিল। অথচ তাদের হিসাবে গড়বড় ছিল। যে কারও ধারণার চেয়ে বেশি সময় নিয়ে যুদ্ধ চলেছে এবং অনেক অজানা বাঁকবদল হয়েছে। ১৯১৭ সালে পরাজিত জারসাম্রাজ্য নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল রুশ বিপ্লবে। কিন্তু জার্মানির বিজয় হাতছাড়া হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রত্যাশিত হস্তক্ষেপে। তাহলে কি জার্মানির উচিত ছিল ১৯১৪ সালেই সমঝোতা চুক্তি করে ফেলা, নাকি রুশ জারের উচিত ছিল বাস্তবতা মেনে নিয়ে জার্মানির দাবির কাছে নতিস্বীকার করা?

বর্তমান চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে কার উচিত হবে কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া ও আগাম আত্মসমর্পণ করা? আপনি হয়তো বলবেন যে বিশ্বকে একদলের লাভ, অন্য দলের লোকসান—এভাবে না দেখে বরং সব দেশ পরস্পরের সমৃদ্ধির জন্য একযোগে কাজ করা হলে ভালো হয়। তাহলে তো আপনি ট্রাম্পীয় দর্শনের মৌলিক ভিত্তিকেই প্রত্যাখ্যান করছেন।

৫.

ট্রাম্পীয় দর্শন অভিনব কোনো কিছু নয়; বরং উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠার আগে হাজার হাজার বছর ধরে এ ধারণার প্রাধান্যই বজায় ছিল। ট্রাম্পের সূত্র বারবার পরীক্ষিত হয়েছে, বারবার প্রয়োগের চেষ্টা হয়েছে। তাতে সাম্রাজ্য গঠন ও যুদ্ধের এক অশেষ চক্র ছাড়া আর কোনো ফায়দা হয়নি।

এর চেয়ে খারাপ কথা হলো, একুশ শতকে উল্লিখিত ‘দুর্গগুলো’কে শুধু অতীতের মতো যুদ্ধের হুমকি মোকাবিলা করতে হবে, তা–ই নয়; বরং জলবায়ু পরিবর্তন ও অতিবুদ্ধিমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মতো নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হবে। একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এসব বৈশ্বিক সমস্যা সামাল দেওয়ার কোনো উপায় নেই। ট্রাম্পের কাছে যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রণহীন এআইয়ের সমস্যা বিষয়ে কোনো কার্যকর সমাধান নেই, সেহেতু তাঁর কৌশল হলো, সোজা এসবের অস্তিত্ব অস্বীকার করা।

২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে শুরু করে। প্রায় এক দশকের দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে আমরা এখন উদারনৈতিক ব্যবস্থা–পরবর্তী বৈশ্বিক অব্যবস্থার একটি পরিষ্কার চিত্র পাচ্ছি। বিশ্ব একটি সহযোগিতামূলক বেষ্টনী, এই উদারনৈতিক দর্শন প্রতিস্থাপিত হয়েছে দুনিয়া ‘রক্ষণদুর্গের এক সমারোহ’, এ চিন্তাধারার মাধ্যমে। 

আমাদের সবার চারপাশে এটা বিস্তৃত হচ্ছে—দেয়াল বাড়ছে, অপসারণীয় সেতু উঠছে। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে স্বল্প মেয়াদে বাণিজ্যযুদ্ধ বাধবে, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা জোরদার হবে এবং সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ বিস্তৃত হবে। চূড়ান্ত ফল দাঁড়াবে বিশ্বযুদ্ধ, প্রতিবেশগত বিপর্যয় আর নিয়ন্ত্রণহীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

আমরা হয়তো এসব দেখে প্রচণ্ড মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হব এবং আমাদের সাধ্যমতো এটা ঠেকানোর চেষ্টা করব। কিন্তু এ থেকে বিস্মিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, কোনো দোহাই নেই। 

যাঁরা ট্রাম্পের দর্শনের সপক্ষে অবস্থান নিতে চান, তাঁদের একটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে: কোনো সর্বজনীন মূল্যবোধ বা অবশ্যপালনীয় আন্তর্জাতিক আইনকানুন ছাড়া কীভাবে প্রতিযোগী জাতীয় দুর্গগুলো তাদের অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক বিরোধের নিরসন ঘটাবে?

(ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত)

ইউভাল নোয়াহ হারারি ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ, গবেষক ও লেখক

বাংলায় অনুবাদ করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব ক র কর ব যবস থ র দ র বল র সহয গ ত ইউক র ন দ র সব র জন য সমস য হওয় র সমর প

এছাড়াও পড়ুন:

হামাস যে কারণে আত্মসমর্পণ করবে না

ফিলিস্তিনের গাজা। একে আপনি যেভাবেই ডাকুন না কেন–গণহত্যা কেন্দ্র, রক্ত ঝরানোর এক অনন্ত চক্র, যন্ত্রণা ও মৃত্যুকূপ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্দিশিবির কিংবা ইসরায়েলের বড় অংশ একে যেভাবে দেখছে অর্থাৎ একে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষাও করতে পারেন। তেল আবিবের অ্যাশকেনাজি ইহুদিরা পশ্চিমা বুদ্বুদে বাস করে, সকালে ক্যাপুচিনোতে চুমুক দেয় আর তাদের যোগব্যায়ামের শিক্ষকের কথা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। অথচ অদূরেই ঘটছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা, যা স্রেব্রেনিৎসা বা রুয়ান্ডার পর বিশ্বে দেখা যায়নি। একটা বিষয় তারা কেউই যেন বুঝতে পারছে না–হামাস আত্মসমর্পণ করবে না। হয়তো ধারণা করা হয়েছিল, গাজা থেকে হামাসের নেতারা এক সময়ের ফাতাহর মতো অর্থ নিয়ে পালাবেন। কিন্তু ১৮ মাসের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এবং দুই মাসের অনাহারের পরও তা না ঘটায় এটি স্পষ্ট–ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর শত্রুকে কতটা কম বোঝেন!
ইসরায়েলের সর্বশেষ ‘প্রস্তাব’ ছিল মূলত আত্মসমর্পণের আহ্বান। সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে ৪৫ দিনের জন্য খাদ্য ও পানি সরবরাহ এবং হামাসকে নিরস্ত্র করার দাবি জানিয়েছিল ইসরায়েল। হামাসের জবাব ছিল: তারা সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত, যদি বিনিময়ে কিছু ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি হুদনা বা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। মানে তারা আর নতুন টানেল খনন করবে না, অস্ত্র উন্নত করবে না এবং গাজার শাসনব্যবস্থা অন্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করবে। হামাস শুরুতেই তারা যে দুটি শর্ত দিয়েছিল, সেগুলো থেকে একচুলও সরেনি: তারা নিরস্ত্র হবে না এবং তাদের দাবি, ইসরায়েলি বাহিনী গাজা থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে যাক এবং এই যুদ্ধের পুরোপুরি অবসান ঘটুক।
আত্মসমর্পণ করবে না হামাস
হামাস কেন আত্মসমর্পণ করবে না, তার অনেক কারণ রয়েছে। দিনরাত তারা এবং গাজার জনগণ যে দুর্দশা ভোগ করছে, তারপরও তারা পিছু হটছে না। মার্চে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়ার পর দেড় হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। হামাসের প্রথম সারির নেতৃত্ব, বেসামরিক সরকার, পুলিশ বাহিনী এবং প্রায় সব হাসপাতাল শেষ হয়ে গেছে। রাফাহ শহর ধ্বংস করা হচ্ছে। তবুও নির্বাসনে যাওয়ার জন্য তাদের বিপুল অর্থ প্রস্তাব করলেও, তা প্রত্যাখ্যান করে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রয়াত ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত হয়তো অনেক আগেই নির্বাসনে চলে যেতেন, যেমনটা তিনি করেছিলেন ১৯৮২ সালে পশ্চিম বৈরুতে পিএলও বাহিনী ঘেরাও হওয়ার পর। ফাতাহও এতক্ষণে বিদেশে পাড়ি জমাত। কিন্তু এই উদাহরণ হামাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেন?
প্রথমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা এবং সহিংসতা দেশটিকে যেমন চিরতরে পাল্টে দিয়েছে, তেমনি গাজার ধ্বংসস্তূপ ফিলিস্তিনি সংগ্রামকেও ভিন্ন রূপ দিয়েছে। গাজা এখন সব ফিলিস্তিনির কাছে পবিত্র ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এই যুদ্ধে গাজার এমন কোনো পরিবার নেই, যাদের স্বজন শহীদ হয়নি বা যাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়নি। হামাস বা অন্য কোনো প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে এই জনগণ থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। সমষ্টিগত কষ্ট যত বাড়ছে ততই তাদের নিজেদের ভূমিতে টিকে থাকার ইচ্ছাশক্তিও বাড়ছে; যেমনটা নিরস্ত্র দক্ষিণ হেবরনের কৃষকরা প্রমাণ করে দিয়েছেন। আরও একটি বিষয়, ইসরায়েলের নির্দয় আচরণের কারণেই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রেরণা জন্মেছে। 
ইসরায়েলের ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’
ইসরায়েল শুধু জমি বা নিয়ন্ত্রণই চায় না। তারা সব সময় আরও বেশি চায়। তাদের ধর্ম অঞ্চলের অন্য সব ধর্মের ওপর আধিপত্য বিস্তার না করা পর্যন্ত তারা থামে না। এমনকি ইস্টার সানডেতে খ্রিষ্টানরাও মুসলমানদের মতোই এই আচরণের শিকার হয়। তাদের বসতি স্থাপনের কাজ যুদ্ধের সময়ের তুলনায় শান্তির সময়েই আরও বাড়ে। যেমন অসলো চুক্তির পর তারা পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন করে।  
বস্তুত ইসরায়েল কখনোই দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে বিশ্বাসী ছিল না, কারণ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং তাদের উত্তরসূরিদের মনে সব সময় শুধু একটি রাষ্ট্রের ধারণাই ছিল। ইতামার বেন গভির, বেজালেল স্মোত্রিচ এবং নেতানিয়াহু মিলে যা করছেন, তা হচ্ছে ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করা’; অর্থাৎ ডেভিড বেন গুরিয়ন যে ফিলিস্তিনিদের ‘ইসরায়েলের ভূমি’ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন, সেটা সম্পন্ন করা।
আজ যদি হামাস আত্মসমর্পণ করে, গাজাও আত্মসমর্পণ করে, সেটি হবে পুরো ফিলিস্তিনি আন্দোলনের আত্মসমর্পণ। এটি এ কারণে নয় যে, সব ফিলিস্তিনি ধর্মপ্রাণ বা ফাতাহ অজনপ্রিয়। বরং এ কারণে যে, প্রতিরোধই এখন দখলদারিত্ব অবসানের একমাত্র পথ হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল গাজা, পশ্চিম তীর, জেরুজালেম এবং নিজ দেশের ভেতরের সব ফিলিস্তিনির ওপর যে দুর্ভোগ চাপিয়ে দিয়েছে, তার ব্যাপকতা এমন যে এখন হামাসের ভাগ্যই ফিলিস্তিনের ভাগ্য হয়ে গেছে।
তবে হামাস থেকে ফাতাহ আলাদা এ কারণে যে, হামাস একটি ধর্মীয় সংগঠন। এই যুদ্ধের সূচনা তারা করেছিল আল-আকসা মসজিদে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের অনুপ্রবেশের প্রতিক্রিয়ায়। গাজার ফিলিস্তিনিরা যে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে, সেটার অর্থ খোঁজার জন্য তারা নিজেদের ধর্মের দিকেই ফিরে যাচ্ছে।
কৌশলগত কারণ
হামাস যে লক্ষ্যে স্থির, এ সংগঠন যে দুর্নীতির বাইরে, তার পেছনের কারণ তাদের সম্মিলিত শৃঙ্খলা ও ইমান। বিষয়টি সবার ওপরই প্রভাব ফেলেছে।
রিফাত রাদওয়ান। ২৩ বছর বয়সী একজন প্যারামেডিক পেশাজীবী, যাঁর মৃত্যুর মুহূর্তের কথা তিনি রেকর্ড করেছেন। মৃত্যুর আগে আল্লাহর কাছে তিনি দোয়া করছিলেন যেন তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত না পড়ার জন্য ক্ষমা পান। তিনি হয়তো খুব ধার্মিক ছিলেন না এবং স্পষ্টতই হামাসের সদস্যও ছিলেন না, কিন্তু মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে ক্ষমা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস কতটা গভীর ছিল। যদি কখনও গাজার ফিলিস্তিনিদের সাহস ও আত্মত্যাগের কোনো প্রতীক খোঁজা হয়, রাদওয়ানই ছিলেন সেই প্রতীক। মৃত্যুশয্যাতেও তিনি ইমানের পরিচয় দিয়েছেন। গাজার ইমানও তদ্রূপ ধ্বংস হবে না। হামাস কেন আত্মসমর্পণ করবে না, তার আরও কিছু কৌশলগত কারণও রয়েছে। একটি সংগঠন হিসেবে তাদের ভবিষ্যৎ যাই হোক, যেমন তামিল টাইগার বা চেচেন বিদ্রোহীদের মতো অনেক বিদ্রোহী দল বড় সামরিক শক্তির দ্বারা নির্মূল হয়েছে আবার ইটিএর মতো দলও লক্ষ্য অর্জন না করেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারপরও হামাস বিশ্বাস করে, তারা ইতোমধ্যে তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করেছে। সেই লক্ষ্য ছিল–ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংগ্রামকে আবারও বিশ্বের মানবাধিকার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা।
পিউ রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বেড়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের ৫৩ শতাংশ ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক মত পোষণ করে, যা ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি।
জনমতও হামাসের পক্ষে, যেখানে হেরেছে ইসরায়েল। বিশেষ করে সেই সব দেশে, যেখানে হামাস নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত, মানুষকে বলা হয়েছে তারা যেন হামাসকে সন্ত্রাসী হিসেবে ভাবে। কিন্তু মানুষ ক্রমেই সেই ধারণা থেকে সরে আসছে। এমনকি যদিও তারা ৭ অক্টোবরের ঘটনাকে ভয়ংকর অপরাধ হিসেবেই দেখে।
যদি ইসরায়েল চায় এই যুদ্ধকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে শেষ করতে, তবে তারা নিশ্চিত থাকতে পারে–একই লক্ষ্য প্রতিটি ফিলিস্তিনির মনেও স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে। নেতানিয়াহু যতদিন এই ব্যর্থ অভিযানে গাজায় এগিয়ে যাবেন, ততদিন ইউরোপের বড় দেশগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যেমন ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার দিকে আরও এগিয়ে যাবে। v

ডেভিড হার্স্ট: মিডল ইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক; মিডল ইস্ট আই থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হামাস যে কারণে আত্মসমর্পণ করবে না