গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, রাজনৈতিক পরিমণ্ডল আগামীতে কীভাবে সামনে আসে, তা দেখার জন্য বিনিয়োগকারীদের অনেকেই অপেক্ষা করছেন। জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হলে বিনিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (এফডিসি) একটি মিলনায়তনে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে বিনিয়োগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি হিসেবে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এমন মত দেন।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সম্প্রতি ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন, তারা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ দেখতে চান। সম্মেলনে রাজনৈতিক দলগুলো বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা নীতির ধারাবাহিকতার কথা বলেছেন। এগুলো ইতিবাচক।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ খুব নিম্নমাত্রার। গত বছর দেশে নিট বিদেশি বিনিয়োগ মাত্র ১৩০ কোটি ডলার। তবে এর উল্লেখযোগ্য অংশ আগের মুনাফা থেকে করা। নতুন বিনিয়োগ একেবারেই কম। সম্প্রতি বিনিয়োগ সম্মেলনে ২৫ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে। প্রতিশ্রুতির চেয়ে এর বাস্তবায়ন বড় বিষয়। সহায়ক পরিবেশ পেলে যারা প্রতিশ্রুতি দেননি, তারাও আসবেন। বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, দুর্নীতি, বন্দরের সমস্যাসহ নানা বাধা দূর করতে হবে।
তিনি মনে করেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন দেশের কর, সেবা প্রদানসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তুলনামূলক বিচার করে সিদ্ধান্ত নেন। এমনও হতে পারে, বাংলাদেশ ভালো করছে; কিন্তু অন্য কেউ হয়তো এর চেয়ে ভালো করছে। এখানে প্রতিযোগিতা তীব্র। আরেকটি বিষয় হলো, বিদেশিরা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মনোভাব পর্যবেক্ষণ করেন। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা সন্তুষ্ট থাকলে বিদেশিরা আগ্রহ দেখাবেন।

বিনিয়োগ সম্মেলনের পরপরই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে কিনা– এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাসের খরচ উল্লেখযোগ্য বিষয়। তবে বিনিয়োগকারীরা সামষ্টিক খরচ বিবেচনায় নেন।  অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের জন্য শুধু খরচ কমানো নয়, পণ্য তৈরি করে তা সরবরাহ করার সময় বা লিড টাইম গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আগামী বছরের নভেম্বরে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে। ফলে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা থাকবে না। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ আগামী ১০ বছরে থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের মতো অবস্থায় যেতে পারবে কিনা– এমন প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ শতাংশ ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থাকলে হয়তো থাইল্যান্ডের কাছাকাছি যাওয়া যাবে। সিঙ্গাপুরের মতো হওয়া আগামী ১০ বছরে সম্ভব নয়।
‘সাম্প্রতিক বিনিয়োগ সম্মেলন বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে’ বিষয়ে ছায়া সংসদ নামের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা ইডেন কলেজের দল জয়ী হয়। সরকারি দলে ছিলেন ঢাকা কলেজের বিতার্কিকরা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। তিনি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিশ্বাসযোগ্যতা, নীতি ধারাবাহিকতা, উন্নত অবকাঠামোসহ ১০ দফা সুপারিশ করেন।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধাবস্থা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের
এক প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমানের যুদ্ধ পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য ভালো নয়। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য বড় শঙ্কার কারণ না হলেও উদ্বেগের। কেননা পরমাণু শক্তির অধিকারী দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার সম্ভাব্য তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে।
তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনা আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সার্ক দীর্ঘদিন ধরে তেমন সক্রিয় নয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সার্কের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। তিনি আশা করেন, এবারও আলোচনার মাধ্যমে সংকট এড়ানো যাবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশ বড় অঙ্কের পণ্য আমদানি করে। সে দেশে আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম। ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। সে দেশে রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে বাংলাদেশের ৪০ বছর লেগেছিল। পরের ৭ বছরে দুই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত যদি সামরিক খাতে বেশি মনোযোগী হয়, তাহলে তাদের বাণিজ্য প্রভাবিত হতে পারে। যার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরেও পড়তে পারে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

পাঠাগারে ‘নাস্তিকদের’ বই, ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে লুটের অভিযোগ

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে ‘অভয়ারণ্য’ পাঠাগারের চার শতাধিক বই লুটের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এসময় তারা জাফর ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন লেখকের প্রায় চার শতাধিক বই লুট করেন।

গত বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) রাত ৮টার দিকে উপজেলার বাঁশহাটি এলাকায় অভয়ারণ্য পাঠাগারে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পাঠাগার কর্তৃপক্ষ প্রশাসন বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

জানা গেছে, বাংলাদেশ যুব খেলাফত মজলিসের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম রব্বানী ওরফে রিশাদ আমীন অভয়ারণ্য পাঠাগার নিয়ে গত ২৪ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেন।

আরো পড়ুন:

গোপালগঞ্জে দিনে-দুপুরে যুবককে হত্যা, অর্থ ও স্বর্ণালংকার লুট  

কক্সবাজারে আবারো গুলি ছুড়ে গরু লুট

সেখানে তিনি লিখেন, ‘ধনবাড়ীতে নাস্তিক্যবাদের কোনো জায়গা হবে না। এটাই ফাইনাল বক্তব্য আমাদের। নাস্তিক বানানোর এক কারখানার সন্ধান পেয়েছি আমরা। অতিদ্রুত আপনাদের কারখানায় তালা লাগিয়ে ধনবাড়ী ছাড়ুন। অনেকদিন অবৈধভাবে সরকারি জায়গা দখল করে ভণ্ডামি করেছেন আপনারা। আর এই সুযোগ পাচ্ছেন না। কথা ক্লিয়ার।’

ওইদিন রাত ৮টার দিকে খেলাফত মজলিসের যুব সংগঠনের ২০-২৫ নেতাকর্মী পাঠাগারে হামলা চালায়। এসময় পাঠাগারটির সাধারণ সম্পাদক দুর্জয় চন্দ্র ঘোষ পাঠাগারে উপস্থিত ছিলেন। তারা পাঠাগারে থাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, জাফর ইকবালসহ কয়েকজন লেখকের চার শতাধিক বই রিকশায় করে নিয়ে যায়।

পাঠাগার থেকে বই নেওয়ার পর যুব খেলাফত মজলিসের নেতা ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘জয়বাংলা কর্মসূচী। বি:দ্র: যাদের বোঝা দরকার তারা বুঝতে পারছে।’

অভয়ারণ্য পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক দুর্জয় চন্দ্র ঘোষ বলেন, “বৃহস্পতিবার রাতে ২০-২৫ জন হুজুর পাঠাগারে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেয়। এসময় তারা ভেতরে ঢুকেই বলে, ওই, সব বই ব্যাগে তুল। এঁনে কোনো বই থাকব না। জাফর ইকবাল নাস্তিক, জাফর ইকবালের সব বই নে। এখান থেকে মানুষ নাস্তিকের বই পড়ে। এসময় মব সৃষ্টিকারী আরেকজন বলে, তোদের এ পাঠাগার থাকবো না। তোদের এখানে জাফর ইকবালের বই থাকবো ক্যা, প্রথম আলোর বই থাকবো ক্যা। এটা উপর থেকে নির্দেশ আছে ভেঙে দেওয়ার, পুড়িয়ে দেওয়ার।’’

দুর্জয় বলেন, “এই বলে বইগুলো সব নিতে থাকে তারা। পুড়িয়ে দেওয়ার কথা বলতে থাকে। তখন থানার কয়েকজন সদস্য সাদা পোশাকে এখানে আসেন। তারাও তাদেরকে নানা প্রশ্ন করেন। তখন হামলাকারীরা বুঝতে পারে তারা থানার লোক। তখন গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতিতে তারা পুড়িয়ে না দিয়ে চার শতাধিক বই লুটপাট করে।”

“এর আগে, ২০২২ সালেও অভয়ারণ্য পাঠাগারে রাতের অন্ধকারে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। তখন বিষয়টি নিয়ে থানায় অভিযোগও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তখন আমরা জানতাম না কে আগুন দিয়েছিল। থানা কর্তৃপক্ষ আর বিষয়টি নিয়ে আগায়নি।”- যোগ করেন তিনি।

পাঠাগারের সভাপতি সুপ্তি মিত্র বলেন, “রাতে তারা পাঠাগারের বই লুটপাট করে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় উপজেলা প্রশাসন ও থানা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তারা বইগুলো পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু, পুলিশের উপস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বইগুলো নিয়ে গেছে। এখনও বইগুলো উদ্ধার হয়নি। তবে জানতে পেরেছি বইগুলো ইউএনও অফিসে রয়েছে।”

অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা যুব খেলাফত মজলিসের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম রব্বানী ওরফে রিশাদ আমীন বলেন, “পাঠাগারটির সদস্যরা ইসলামবিদ্বেষী লেখা ফেইসবুকে পোস্ট করত। পাঠাগারে হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবালসহ বিভিন্ন লেখকের বই ছিল যেগুলোতে নারীদের অধিকার আর ইসলাম বিদ্বেষী লেখা ছিল। সেসব বই নিয়ে ইউএনও অফিসে জমা দিয়েছি।”

এ বিষয়ে ধনবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এসএম শহিদুল্লাহ বলেন, ‘‘কিছু লোকজন পাঠাগার থেকে হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবালসহ কয়েকজন লেখকের বই নিয়ে এসে ইউএনও অফিসে রেখেছে। তাদের দাবি, ওই লেখকরা নাস্তিক। কতগুলো বই নিয়েছে সেটা জানি না। রবিবার ইউএনও কার্যালয়ে বসে বিষয়টির সমাধান করা হবে।’’

ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহীন মাহমুদ বলেন, ‘‘পাঠাগার থেকে বই নিয়ে গেছে এমন একটি অভিযোগ পেয়েছি। রবিবার দুপক্ষকে ইউএনও কার্যালয়ে আসতে বলা হয়েছে।’’

ঢাকা/কাওছার/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ