‘ধর্মবিরোধী’ অভিযোগ তুলে পাঠাগার থেকে নজরুল-রবীন্দ্রনাথের বই নিয়ে গেলেন একদল যুবক
Published: 26th, April 2025 GMT
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় ‘অভয়ারণ্য’ নামের একটি পাঠাগার থেকে পাঁচ শতাধিক বই নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ১৫-২০ জনের একদল যুবক পাঠাগারে ঢুকে বই নিয়ে যায়। পরে পাঁচটি বস্তায় ভরে বইগুলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে জমা দেয় তারা। ওই যুবকদের দাবি, তারা যেসব বই পাঠাগার থেকে নিয়ে এসেছেন, সেগুলো ধর্মবিরোধী। এসব বই পড়ে যুবসমাজ ধর্মবিরোধী হয়ে উঠছে।
পাঠাগার কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রায় দুই লাখ টাকার বই ও নথিপত্র লুট এবং ৫০ হাজার টাকার আসবাব ভাঙচুর করেছে ওই যুবকরা। তারা যে বইগুলো নিয়ে গেছে তার মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঞ্জীব ভট্টাচার্য, জাফর ইকবাল প্রমুখের বই রয়েছে।
পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক দুর্জয় চন্দ্র ঘোষ জানান, তৌহিদি জনতার নাম নিয়ে স্থানীয় গোলাম রাব্বানী রিশাদ, সোহেল, শাফি, শহিদুল ইসলাম আলামিনসহ ১৫-২০ জনের একটি দল পাঠাগারে ঢুকে বই বস্তায় তুলতে শুরু করে। তারা হুমকি দিয়ে বলে, এখানে কোনো পাঠাগার থাকতে দেবে না, বই পুড়িয়ে ফেলবে।
এ বিষয়ে গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘অভয়ারণ্য পাঠাগার যারা পরিচালনা করেন, তারা সব ধর্মের বিরোধী। গত বুধবার এই পাঠাগারের এক সদস্য ফেসবুকে ধর্মবিরোধী একটি পোস্ট দেয়। আমরা তাকে ডেকে কথা বলি। তার কাছে জানতে পারি, সে ওই পাঠাগারের সঙ্গে জড়িত হয়ে ধর্মবিরোধী হয়ে উঠেছে। এ জন্য বৃহস্পতিবার আমরা পাঠাগারে গিয়ে যে বইগুলো ধর্মবিরোধী মনে হয়েছে, তা নিয়ে ইউএনওর কাছে জমা দিয়েছি। বই লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি।’
ইউএনও শাহীন মাহমুদ বলেন, ‘তৌহিদি জনতার নাম করে কয়েকজন কারও অনুমতি ছাড়াই বস্তায় ভরে বইগুলো পাঠাগার থেকে আমার অফিসে নিয়ে এসেছেন। রোববার দুই পক্ষকে নিয়ে বসে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে।’
পাঠাগারের সভাপতি সুপ্তি মিত্র বলেন, ‘হামলা কেবল বইয়ের ওপর নয়, মুক্তচিন্তা ও যুক্তিনির্ভর জ্ঞানচর্চার একটি নিরাপদ পরিসরকে ধ্বংসের চেষ্টা। আমি দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং পাঠাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাই।’
ধনবাড়ী থানার ওসি এস এম শহিদুল্লাহ জানান, এ ঘটনায় পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক দুর্জয় চন্দ্র ঘোষ ৪-৫ জনের নামে থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্গম পদ্মার চরে নতুন আশা
ফরিদপুরের সদরপুরে নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নটি দুর্গম পদ্মার চরে। পিছিয়ে পড়া এ জনপদে মাধ্যমিক বিদ্যালয় কোনোদিন চোখে দেখেনি কেউ। শিক্ষার বাতিঘর হিসেবে এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এতে এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা ইউনিয়নবাসীর।
সদরপুর উপজেলায় রয়েছে ৯টি ইউনিয়ন। এর মধ্যে নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নটি পদ্মা নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরে। এ চরে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও এখানকার অধিবাসীরা আজ পর্যন্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় কী তা জানে না। আশপাশের চরনাছিরপুর, চরমানাইর তিন চরেও নেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ফলে প্রাথমিকের পাট শেষ করে আর এগোতে পারে না চরবাসী শিশুরা। চরে হাওলাদারকান্দি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত সদরপুর উপজেলা প্রশাসন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি হয়ে উঠবে শিক্ষার বাতিঘর– এমনটাই প্রত্যাশা এখানকার বাসিন্দাদের।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে চলে এ চরাঞ্চলের মানুষের জীবন। শিক্ষাদীক্ষায় চরবাসী আলোর মুখ না দেখতে পেয়ে বাধ্য হয়ে সন্তানদের পৈতৃক পেশা মাছধরা বা কৃষিকাজে লাগিয়ে দিতেন। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় পঞ্চম
শ্রেণি পাস করেই অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত।
হঠাৎ এক দিন এ বালুচরে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গল্প শোনা যায়। প্রথম দিকে কাল্পনিক মনে হলেও এখন চরবাসীর স্বপ্নের ওই বিদ্যালয়টি বাস্তবের জমিনে দাঁড়িয়ে আছে। শিগগির বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম শুরু হবে। ২০২৩ সালে সদরপুর উপজেলার তৎকালীন ইউএনও আহসান মাহমুদ রাসেল নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নে উন্নয়ন কাজের পরিদর্শনে যান। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ঘুরে দেখার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে চান তিনি। স্থানীয়রা জানান, এ অঞ্চলে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। তখনই একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি।
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠায় জমিদানের জন্য এগিয়ে আসেন ওই অঞ্চলের হাওলাদারকান্দি গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষানুরাগী আবুল হাওলাদার। তিনি বিদ্যালয়ের জন্য এক একর (একশ শতাংশ) জমি লিখে দেন। এরপর বিদ্যালয়ের স্থাপনা নির্মাণের জন্য সদরপুর উপজেলা প্রশাসনের নিজস্ব উন্নয়ন তহবিল থেকে বরাদ্দ দিয়ে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন ফরিদপুর জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার।
সদরপুর উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়ন। যোগাযোগের প্রধান বাহন ট্রলার। সদরপুর থেকে ঢেউখালী ইউনিয়নের শয়তানখালী নৌঘাট থেকে দেড় ঘণ্টা পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় এ চরে।
গত মঙ্গলবার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই চরে প্রায় ২০ হাজার মানুষ বসবাস করে। এ অঞ্চলের স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীর হাতে যেখানে বই-খাতা-কলম থাকার কথা, সেখানে তাদের হাতে দেখা যায় চায়ের কেটলি, মাছ শিকারের সামগ্রী আর গরু-ছাগলের রশি।
স্থানীয় বাসিন্দা রাজামল্লিক জানান, ইচ্ছা থাকলেও আগে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে আর স্কুলে যেতে পারত না এ অঞ্চলের শিশুরা। মাধ্যমিক বিদ্যালয় হওয়ায় শিশুরা আরও পড়াশোনা করতে পারবে। বদলে যাবে চরের শিক্ষা ব্যবস্থা।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন সরদার বলেন, অনেক চেষ্টার পর চরবাসীর জন্য উপজেলা প্রশাসন এ স্কুলটি উপহার হিসেবে দিয়েছে। এখন চরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে, পরিবর্তন হবে এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থার। ইতোমধ্যে স্কুলটির জন্য চারচালা টিনের ঘর করা হয়েছে। বেঞ্চসহ শিক্ষা উপকরণ সামগ্রীও পৌঁছে গেছে। শিগগির শিক্ষক নিয়োগ করা হবে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, এখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আশা করাও দুরূহ ব্যাপার ছিল। প্রশাসনের প্রচেষ্টা ও এলাকাবাসীর উদ্যোগের কারণে এ স্কুল প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
বিদ্যালয়ের জমিদাতা শিক্ষানুরাগী আবুল হাওলাদারের ভাষ্য– নিজ এলাকায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় দুর্গম এলাকা থেকে নদী পাড়ি দিয়ে অন্যত্র যেতে চায় না শিশুরা। তাই এখানকার জনগোষ্ঠীর শিক্ষার মান নাজুক। এখন উচ্চ বিদ্যালয় হওয়ায় তাদের শিক্ষার হার বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সদরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকিয়া সুলতানা বলেন, এই উপজেলার সাবেক ইউএনও আহসান মাহমুদ রাসেল প্রথমে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি (জাকিয়া) এসে যখন শুনেছেন, তখন থেকেই চরের শিশুদের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়টি নিয়ে কাজ করছেন। চরবাসী তাদের স্বপ্নের স্কুল পেয়েছে। সরকারি বরাদ্দ দিয়ে স্কুলের বেঞ্চসহ বিভিন্ন সামগ্রী কেনা হয়েছে। এখন উদ্বোধন ও পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষা।