‘ সেরা নির্বাচন’ নিয়ে অঙ্গীকার এবং বাস্তবতা
Published: 26th, April 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আবারও জানিয়েছেন, তারা দেশের ইতিহাসে ‘সেরা নির্বাচন’ আয়োজন করবেন। ১৯ এপ্রিল এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনসের (এএনএফআরইএল) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই, এ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা এবং দেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এক মাইলফলক।’ এর আগেও তিনি একই কথা বলেছিলেন। সরকারপ্রধানের আসন থেকে আসা এ বক্তব্যকে সরকারের অঙ্গীকার হিসেবে ধরে নেওয়া সংগত হবে। পরপর তিনটি একতরফা ও কলঙ্কিত নির্বাচনের পর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক দল নয়, দেশবাসীর কাছে বহুল প্রত্যাশিত। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতির মাঠের বাস্তবতা কী এ অঙ্গীকার পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা তুলে ধরে?
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানকে শুরু থেকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলতে হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার ধ্বংস করে যাওয়া নির্বাচন ব্যবস্থা, লুটপাট ও চৌর্যতন্ত্রের ফলে ধ্বংস হওয়া অর্থনীতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে দলীয়করণের জের এখনও বহন করতে হচ্ছে। সরকার আইনশৃঙ্খলায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। হত্যাকাণ্ড, ‘মব’ সহিংসতা, চাঁদাবাজি, দখল, নারীকে হেনস্তা অব্যাহত আছে। এ পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচনী রোডম্যাপ, সংস্কার, গণহত্যার বিচার ইত্যাদি ইস্যুতে ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে। বিএনপি ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিচ্ছে। বিএনপি শুরু থেকে বলে আসছে, নির্বাচনের জন্য যতখানি সংস্কার দরকার ততখানি সংস্কার করে ডিসেম্বরেই নির্বাচন করা সম্ভব। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচিত সরকার ও সংসদ সংস্কার কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই সনদে সব দলই অঙ্গীকার করবে। যে-ই ক্ষমতায় যাক, ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে।’
অন্যদিকে নির্বাচনী রোডম্যাপ ও সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান স্পষ্ট নয়। শুরুতে জামায়াতের বক্তব্য ছিল, সংস্কার বাস্তবায়ন ছাড়া যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন কোনো ফল বয়ে আনবে না। জামায়াত গণহত্যার বিচারের দাবিও সামনে নিয়ে আসে। সম্প্রতি দলটির আমির ডা.
রাজনীতির মাঠের আরেক শক্তি নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন সংস্কার বাস্তবায়নের পর নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। গত ২০ এপ্রিল সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়নের পর নির্বাচনের দাবি জানান। এনসিপি সংস্কার ও গণহত্যার বিচারের আগে নির্বাচনী রোডম্যাপের বিরোধিতা করে চলেছে। ইসির তৎপরতা নিয়েও এনসিপি ‘সন্দেহ’ পোষণ করছে। এনসিপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। এর আগে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ তুলেছেন, ‘প্রশাসন বিএনপির পক্ষে, তাদের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়।’ গত ১৬ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রশাসন বিএনপির পক্ষ অবলম্বন করছে অনেক জায়গায়।’ মৌলিক সংস্কার ছাড়া এনসিপি নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেও আভাস দিয়েছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছেড়ে আসা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক রমজান মাসের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে চলছে। কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত, আংশিক একমত, ভিন্নমতের পাশাপাশি বিভিন্ন দলের নতুন সুপারিশ নিয়ে এ বৈঠক চলছে। সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশন কাজ করছে। তবে সংস্কারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক মতভিন্নতা রয়েছে। বিশেষ করে সংবিধান এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার সুপারিশের ক্ষেত্রে বিএনপি এবং এনসিপির অবস্থান একেবারেই বিপরীতমুখী। যেমন বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর বিপক্ষে। অন্যদিকে এনসিপি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব করেছে। প্রধানমন্ত্রী শাসিত নয়, এনসিপি মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের কথা বলেছে।
প্রফেসর ইউনূসের অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়েও প্রফেসর ইউনূসকে চাপের মধ্যে থাকতে হবে। শুধু বিএনপি নয়, সিপিবি, বাসদসহ অনেক দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জারি রেখেছে। ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর নিয়োগকর্তা ছাত্রদের দল এনসিপিকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কালক্ষেপণ করছেন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা অন্যতম দাবি এনসিপির। প্রধান উপদেষ্টা এর আগে ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নেই’– এমন বক্তব্য দেওয়ার পর এনসিপি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে যে দূরত্ব বিরাজ করছে, তা দূর করা অথবা কমিয়ে আনা সহজ নয়। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এবং পরে বিভিন্ন বক্তৃতায় ১৮ মাসের মধ্যে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাওয়ার এক অনুষ্ঠানে জেনারেল ওয়াকার বলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে কিংবা ‘ক্লোজ টু দ্যাট টাইমে’র মধ্যে ফ্রি, ফেয়ার এবং ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা একমত হয়েছেন।” তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব পালন শেষে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যেতে চায়।’
প্রফেসর ইউনূস দেশের ইতিহাসে ‘সেরা নির্বাচন’ আয়োজনের কথা বলেছেন। ‘সেরা নির্বাচন’ হবে কিনা, তা এখনই বলা যাবে না। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন যে দেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন নির্বাচন হবে, একথা বলা যায়।
খায়রুল আনোয়ার: সাংবাদিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণহত য র ব চ র ড স ম বর এনস প র অবস থ ন ঐকমত য র বল ন মন ত র র জন য ইউন স ব এনপ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কার-নির্বাচনের আগে আ.লীগের বিচার চায় শহীদ পরিবার
সংস্কার এবং নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলবে তবে তার আগে জুলাই অভ্যুত্থানসহ বিগত ১৫ বছরে অসংখ্য খুন, হত্যার হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার এবং নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। একইসঙ্গে শহীদদের পরিবার এবং আহতদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন তারা।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে ‘জুলাই, পিলখানা, শাপলা গণহত্যার বিচার এবং গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের’ দাবিতে শহীদী সমাবেশে তারা এসব কথা বলেন।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদির সঞ্চালনায় সভায় শহীদ পরিবার এবং আহতরা, এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, আপ বাংলাদেশের সংগঠক আলী আহসান জুনায়েদ, ইসলামি ছাত্র আন্দোলনের সেক্রেটারি শেখ মাহবুবুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশ থেকে চারটি দাবি জানানো হয়। এগুলো হলো- আগামী ১০০ দিনের মধ্যে জুলাই গণহত্যার দৃশ্যমান বিচার শুরু করতে হবে এবং আওয়ামী লীগকে নির্বাহী আদেশ, আদালতের রায় ও রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। শাপলা চত্বরের ঘটনার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘের সহায়তায় একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে শহীদদের তালিকা প্রকাশ ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে; পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং দেশের সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের গণহত্যার বিচারের বিষয়ে স্পষ্ট ধারা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সভায় জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ইমাম হাসানের ভাই বলেন, আমাদের সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কেন রাস্তায় দৌড়াতে হবে। এখানে একটি প্রহসন চলছে। বাংলাদেশে সংস্কার হবে, নির্বাচন হবে; তবে তার আগে বিচার হওয়া লাগবে। সংস্কারের মূল বিষয় হওয়া উচিত বিচার।
শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহিনা বেগম বলেন, আমার ছেলেকে আশুলিয়ায় ভ্যানের উপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ও তখন জীবিত ছিল। তাকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ সকল হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এদের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। নইলে কিন্তু আমি ছাড়ব না। এক সন্তান মারা গেছে। দেশে আমার শত শত সন্তান আছে, তারা ছাড়বে না।
শহীদ সাইমের মা বলেন, যাত্রাবাড়িতে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়। আমার বুকটা শূন্য করে দিয়েছে। ঈদ গেল, আমি ঈদ করতে পারি নাই। আমাদের বুকে রক্তক্ষরণ হয়। এখনো আমার ছেলের হত্যার বিচার পাইনি। আমার দাবি এই স্বৈরাচার হাসিনারে যেন দেশে এনে ফাঁসি দেওয়া হোক।
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, সংস্কার না নির্বাচন আপনারা এই খেলা বাদ দিয়ে বিচার নিশ্চিত করুন। বর্তমান সরকারের বৈধতা হচ্ছে শহীদরা। জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের হত্যাকাণ্ডের বিচারের আগে বাংলাদেশে কোনো কিছু প্রাসঙ্গিক হতে পারে না।
আপ বাংলাদেশের সংগঠক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ জন্য মাঠে নামতে হচ্ছে। এটা লজ্জাজনক। আমরা বেঁচে থাকতে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে না।