আজ ২৭ এপ্রিল শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬২ সালের এই দিনে তিনি মারা যান। আমরা শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করি। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। বাংলার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অকুতোভয় কণ্ঠস্বর। তাঁর জীবন ও কর্ম আজও আমাদের পথ দেখায়, বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন শোষণ-বঞ্চনায় মানুষ ভয়াবহরূপে বিপর্যস্ত হচ্ছে।
তাঁর পুরো নাম আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর, বরিশালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা সম্পন্ন করে তিনি আইন পেশায় যুক্ত হন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল বৃহত্তর। তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি মুসলিম জনসাধারণের অধিকার আদায়ে এক বিশিষ্ট নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৪০ সালে তাঁর প্রস্তাবিত লাহোর প্রস্তাব পরে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হয়। তবে শেরেবাংলা ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি বরাবরই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পক্ষে ছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘রাজনীতি হবে জনকল্যাণের জন্য, ধর্মের জন্য নয়।’
তাঁর জীবনের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় হলো বাংলার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। ১৯৩৭ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা উপমহাদেশের ইতিহাসে অনন্য। জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। তিনি কৃষকদের জমির অধিকার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করেন, ঋণের দায়ে কৃষকদের শোষণের অবসান ঘটান। তাঁর উদ্যোগেই কৃষি ঋণ বোর্ড ও প্রজাস্বত্ব আইন চালু হয়।
তাঁর আমলে শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত মজুরি, শ্রমঘণ্টা ও সুরক্ষার বিষয়গুলো আলোচনায় আসে। তাঁর এই শ্রমজীবী ও কৃষকবান্ধব চিন্তাধারার ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৫০ সালে গঠন করেন কৃষক শ্রমিক পার্টি। এই দল ছিল শোষিত ও প্রান্তিক মানুষের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ধনীর নয়, গরিবের স্বর ছিল মুখ্য।
কৃষক শ্রমিক পার্টি ছিল সেই সময়ের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি তাজা হাওয়া। ফজলুল হকের নেতৃত্বে এ দল মানুষের মৌলিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত গণতন্ত্র তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন কৃষক ও শ্রমিক এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ– রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে।
আজ শেরেবাংলার মৃত্যুবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আমরা যখন দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের দিকে তাকাই, তখন তাঁর সেই কথাগুলো আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করি। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলি, অথচ কৃষক এখনও ফসলের ন্যায্য দাম পান না, শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন, ন্যূনতম শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এই বাস্তবতায় শেরেবাংলার আদর্শ ও কৃষক
শ্রমিক পার্টির দর্শন আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
এ.
তাঁর মৃত্যু ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল। সেদিন শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই নয়, হারিয়ে গিয়েছিলেন একটি যুগের প্রতীক। তবে তাঁর আদর্শ আজও বেঁচে আছে সেই সব মানুষের মাঝে, যারা সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা চায়, যারা কৃষক-শ্রমিকের কণ্ঠস্বর হতে চায়। আমরা চাই, নতুন প্রজন্ম শেরেবাংলার কর্ম ও জীবন থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করুক। কৃষক শ্রমিক পার্টির আদর্শকে সামনে রেখে গঠিত হোক এমন এক রাজনীতি, যা শুধু ক্ষমতার জন্য নয়, বরং মানুষের অধিকার ও মর্যাদার জন্য কাজ করে। তাহলেই তাঁর প্রতি হবে প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লড়াই।
mdyamin.khan1983@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স মরণ র র জন ত ক র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না ফারুকের
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালানো নারায়ণগঞ্জের এস এম রানাকে বিসিবিতে নিয়ে এসেছিলেন ফারুক আহমেদ। বিসিবির টাকায় তাঁকে র্যাডিসন হোটেলেও রাখা হয়েছিল। গত অক্টোবরে ফারুক-রানাকে প্রকাশ্যে মেলামেশা করতে দেখা গেছে। ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই সমালোচনার মুখে পড়েন বিসিবি সভাপতি। বিপিএলে স্পট ফিক্সিং ইস্যু, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে বিতর্কিত ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়োগ, মধুমতি ও মেঘনা ব্যাংকে অস্বাভাবিকভাবে ১১৮ কোটি টাকার এফডিআর করা এবং সম্প্রতি তাওহিদ হৃদয়ের নিষেধাজ্ঞা ও তামিম ইকবালের চাপ প্রয়োগের ইস্যুতে নতজানু হওয়ার ঘটনায় বিতর্কিত হচ্ছেন ফারুক।
জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক বিসিবির প্রথম ক্রিকেটার সভাপতি। তাঁর কাছে তাই প্রত্যাশাও বেশি ছিল ক্রীড়ামোদীদের। অথচ কিছু বিতর্কিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়া এবং একরোখা স্বভাবের কারণে আট মাসেই অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। বেশির ভাগ পরিচালকের অভিযোগ, রেগে গেলে সভাপতির আচরণ শালীন থাকে না। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা মনে করেন, মেজাজ হারিয়ে দিন দিন শত্রুতা বাড়াচ্ছেন ফারুক। তাঁর সাংগঠনিক ক্যারিয়ারকে যেটা প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করেন ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টরা।
গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ফারুকের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ান যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার প্রেস সচিব মাহফুজুল আলম। মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিসিবি সভাপতি ফারুকের সঙ্গে কয়েকজন বিতর্কিত লোকের ওঠাবসার কারণে ঝামেলার সূত্রপাত। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো রানাকে বিসিবিতে সম্পৃক্ত করা, আওয়ামী লীগ সম্পৃক্ত জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার খন্দকার সাইদুর রহমান এফিকে নিরাপত্তার দায়িত্বে রাখায় ক্ষুব্ধ ছিল মন্ত্রণালয়। এ দু’জনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ফারুক কয়েক মাস আগে বলেছিলেন, ‘রানার সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা ছিল নারায়ণগঞ্জের ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে। সে যে আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে, তা জানা ছিল না। এ ব্যাপারে অবগত হওয়ার পরই বাদ দেওয়া হয়েছে। খন্দকার সাইদুর রহমান এফি জাতীয় দলের ক্রিকেটার হিসেবে বিসিবিতে এসেছে। যখন জেনেছি তার ব্যাপারে আপত্তি আছে, তাকেও বাদ দিয়েছি।’
বিসিবি সভাপতি হওয়ার পর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক থেকে এফডিআর সরিয়ে নিরাপদ ব্যাংকে নেওয়ার কথা বলেছিলেন ফারুক। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বিসিবি জানায়, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক থেকে ২৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করে সবুজ ও হলুদ তালিকাভুক্ত ১৩টি ব্যাংক– মধুমতি ব্যাংক (হলুদ), ইস্টার্ন ব্যাংক (সবুজ), ব্র্যাক ব্যাংক (হলুদ), মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (হলুদ), প্রাইম ব্যাংক (সবুজ), সিটি ব্যাংক (সবুজ), মেঘনা ব্যাংক (সবুজ), পূবালী ব্যাংক (হলুদ), অগ্রণী ব্যাংক (লাল), বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক (হলুদ) ও সিটিজেন ব্যাংকে (হলুদ) ২৩৮ কোটি টাকা নতুন করে এফডিআর করা হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো থেকে ২ থেকে ৫ শতাংশ বাড়তি মুনাফা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এফডিআর করার ফলে অংশীদার ব্যাংক থেকে ১২ কোটি টাকা স্পন্সর পাওয়া নিশ্চিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মধুমতি ব্যাংক ও মেঘনা ব্যাংক ঢাকা ও জাতীয় লিগের স্পন্সর ছিল। নতুন করে এফডিআর করায় সভাপতিকে কেউ দোষারোপ করছে না। সমস্যা হয়েছে, মধুমতি (৬৬ কোটি টাকা) ও মেঘনা (৫২ কোটি টাকা) ব্যাংকে ১১৮ কোটি টাকা এফডিআর করা নিয়ে। ১১টি ব্যাংকে রাখা হয়েছে ১২২ কোটি টাকা, কিন্তু দুই ব্যাংকে কেন প্রায় অর্ধেক টাকার এফডিআর? একজন পরিচালকের কাছে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, ‘সাধারণত মোটা অঙ্কের টাকা এফডিআর করা হলে কমিশন পাওয়া যায়। এই কমিশন বৈধ। সভাপতি সেটি নিয়েছেন কিনা, জানি না। তবে যেটুকু শুনেছি, মধুমতি ও মেঘনা ব্যাংকে সভাপতির বন্ধু আছেন। সে কারণে সেখানে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।’ বিপিএল ও আন্তর্জাতিক সিরিজের টিকিট বিক্রির পার্টনারও মধুমতি ব্যাংক। এ বিষয়ে ফারুকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘পুরোপুরি স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কাজগুলো করেছি। সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছিলাম, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক থেকে এফডিআর নিরাপদ ব্যাংকে নেওয়া হবে। বোর্ড সভায় অনুমোদন নিয়ে কাজটি করা হয়েছে। এ ছাড়া ফিন্যান্স ও লজিস্টিক কমিটির চেয়ারম্যানরা স্বাক্ষর করেছেন। মূলত আমার ইমেজ ক্ষুণ্ন করতে এ ধরনের কাজ করা হচ্ছে।’ তবে বিসিবি পরিচালক মাহবুবুল আনাম বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাক্ষর করি কোনো কিছু অনুমোদন করার পর। তখন ফিন্যান্স কমিটির সভাপতি ছিলেন সভাপতি নিজে। নিজস্ব ক্ষমতাবলে এফডিআর ১৩টি ব্যাংকে নিয়েছেন। তিনি সেটি পারেনও। যে ব্যাংকগুলোতে নেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে বিসিবি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এ কারণে নেওয়া হয়েছে।’
কে এই এসএম রানা
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সামনে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানোর সময় আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান ও তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে ছিলেন এসএম রানা। এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় করা মামলার আসামি রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি জামিন পেয়েছেন। এ ছাড়া ফতুল্লা থানায়ও ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা আছে।
অভিযোগ রয়েছে, শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটু, বিসিবির বর্তমান চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন, নগরীর নিতাইগঞ্জ বাপ্পী চত্বর এলাকার এসএম রানা মিলে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। এই সিন্ডিকেট জমি দখলসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিল। শামীম ওসমান পরিবারের সহযোগিতায় রানা নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহসভাপতি ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যকরী সদস্য হন।