চৈত্রের এক ভরদুপুরে বাড়ি ফিরে মাকে বললাম, ‘মা, জানো, এবার নাকি পুজোর মাঠে চড়কপুজোয় মেলা বসবে?’

মায়ের হ্যাঁ-সূচক উত্তরে বুঝলাম, খবরটা তার আগেই জানা। আমি আবার বললাম, ‘মা, এবার নাকি পুতুলনাচ আসবে?’

মা বলল, ‘তাই! কোথায় শুনলি?’

বললাম, ‘ডাক্তার জ্যাঠাদের বাড়ি থেকে মাত্রই শুনে এলাম।’

গ্রামের সর্বজনীন বিষয়গুলোর আলোচনা তখন ডাক্তার জ্যাঠাদের বাড়িতেই হতো। আমি পড়ি প্রাইমারিতে। সেই বয়সে, গ্রামের মেলায় পুতুলনাচ আসবে শুনে আমার মনটাও নেচে উঠল। মাকে বললাম, ‘মা, আমি কিন্তু পুতুলনাচ দেখব।’

ঠিক হলো, মেলায় যদি পুতুলনাচ আসে, তবে আমি আর আমার পাঁচ বছরের বড় ভাই মিলে পুতুলনাচ দেখতে যাব। সেবার মেলায় সত্যিই পুতুলনাচ বসল; ‘ঝুমুর ঝুমুর পুতুলনাচ’। চড়কপূজার পরের দিন, পয়লা বৈশাখের পড়ন্ত বিকেলে দাদা আর আমি মেলায় গেলাম। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা তখন লাল আভা ছড়াচ্ছে। মাঠের চারপাশ ঘিরে ছোট ছোট দোকানে নানান রকম জিনিস। মাটির পুতুল, টিনের খেলনা, ঘর-গৃহস্থালির জিনিসপত্র আর মোয়া-মুড়কি, নকুলদানা, বাতাসা, মিষ্টি, রসগোল্লার দোকান। চারদিকে হাঁকডাক, হইহুল্লোড়, গানবাজনার শব্দ। মেলায় ঢোকার পথে হরেক রঙের পান-মসলা দিয়ে পান সাজিয়ে বিক্রি করছে একজন পানওয়ালা।

দাদা আর আমি ঘুরে ঘুরে মেলা দেখছি। দুটি টিনের বাঁশি কিনলাম দুজনে। দাদা টিনের তৈরি একটা মাছের চরকা কিনে দিল আমাকে। সেটা ঘুরালে ক্রমাগত পট পট শব্দ হয়। হঠাৎ দেখি, মাঠের মাঝখানে সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছে। ভিড় ঠেলে সামনে গেলাম। একটা বিশাল জলভরা চাঁড়ি। তাতে ছোট্ট একটা টিনের লঞ্চ ভটভট শব্দ করে ঘুরছে। এ রকম খেলনা আমি প্রথম দেখলাম। খুব ভালো করে লঞ্চটির ভেতরে তাকিয়ে দেখি, পিদিমের মতো ছোট্ট একটা শিখা জ্বলছে। পেছনে বুদ্‌বুদ জল ঠেলে এগিয়ে চলছে খেলনা লঞ্চটি। পছন্দ হলেও লঞ্চটা কিনতে পারলাম না। কারণ, আমাদের হাতে লঞ্চটা কেনার মতো টাকা ছিল না।

দাদা আমার হাত ধরে নিয়ে গেল পুতুলনাচের প্যান্ডেলের দিকে। সেখানে মাইকে বলছে, ‘আসুন, আসুন। ঝুমুর ঝুমুর পুতুলনাচ দেখুন। ছোট-বড়, ছেলে-মেয়ে, সবাই আসুন। এক টাকা টিকিটের দাম।’

তাঁবুঘেরা বিশাল প্যান্ডেল। ভেতরে ঢোকার জন্য পর্দা দেওয়া ছোট পথ। টিকিট কিনে ভেতরে ঢুকলাম। ঘাসের ওপর খড় বিছিয়ে বসার জায়গা করা। জায়গা পেয়েছি পেছনের দিকে। বাইরে তখন সন্ধ্যা। গোটা কয়েক হ্যাজাকের আলোয় ভেতরটা আলোকিত। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি সামনের ছোট কাপড়ে ঘেরা মঞ্চের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্যান্ডেলটা অন্ধকার হয়ে এল। মঞ্চের আলোয় দেখা গেল, দুদিকে সরে যাচ্ছে সামনের পর্দা। আর তখনই শুরু হলো গান। রংবেরঙের একদল পুতুল সারবেঁধে মঞ্চে প্রবেশ করল। কী অদ্ভুত! পুতুলগুলো গানের তালে নাচছে, গাইছে! গান শেষে পুতুলগুলো নাচতে নাচতে চলে গেল।

এবার একটা রাজা পুতুল আর একটা রানি পুতুল কথা বলতে ঢুকল। পরপরই অন্য রাজ্যের আরেক রাজা, আরেক রানি পুতুল। দুই রাজ্যের দুই রাজপুত্র আর রাজকন্যার মধ্যে কীভাবে বিয়ে হলো, পুতুলনাচে দেখানো হলো সেই কাহিনি। দুই রাজ্যের পুতুলদের আনন্দ নাচে শেষ হলো পুতুলনাচের পালা। আমরা বেরিয়ে এলাম।

বাইরে তখন দোকানে দোকানে আলো। ক্রেতার ভিড়। আমার চোখে তখনো পুতুলনাচের দৃশ্য। পুতুলগুলো এত জীবন্ত নাচল কী করে! বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে শুনতে হবে। মা নিশ্চয়ই জানে এই পুতুলনাচের রহস্য।

আরও পড়ুনজীবনের প্রথম উপার্জন, তা–ও আবার বছরের পয়লা দিনে১৯ এপ্রিল ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বলল ম

এছাড়াও পড়ুন:

বৈশাখি মেলার যে স্মৃতি আজও ভুলতে পারি না

চৈত্রের এক ভরদুপুরে বাড়ি ফিরে মাকে বললাম, ‘মা, জানো, এবার নাকি পুজোর মাঠে চড়কপুজোয় মেলা বসবে?’

মায়ের হ্যাঁ-সূচক উত্তরে বুঝলাম, খবরটা তার আগেই জানা। আমি আবার বললাম, ‘মা, এবার নাকি পুতুলনাচ আসবে?’

মা বলল, ‘তাই! কোথায় শুনলি?’

বললাম, ‘ডাক্তার জ্যাঠাদের বাড়ি থেকে মাত্রই শুনে এলাম।’

গ্রামের সর্বজনীন বিষয়গুলোর আলোচনা তখন ডাক্তার জ্যাঠাদের বাড়িতেই হতো। আমি পড়ি প্রাইমারিতে। সেই বয়সে, গ্রামের মেলায় পুতুলনাচ আসবে শুনে আমার মনটাও নেচে উঠল। মাকে বললাম, ‘মা, আমি কিন্তু পুতুলনাচ দেখব।’

ঠিক হলো, মেলায় যদি পুতুলনাচ আসে, তবে আমি আর আমার পাঁচ বছরের বড় ভাই মিলে পুতুলনাচ দেখতে যাব। সেবার মেলায় সত্যিই পুতুলনাচ বসল; ‘ঝুমুর ঝুমুর পুতুলনাচ’। চড়কপূজার পরের দিন, পয়লা বৈশাখের পড়ন্ত বিকেলে দাদা আর আমি মেলায় গেলাম। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা তখন লাল আভা ছড়াচ্ছে। মাঠের চারপাশ ঘিরে ছোট ছোট দোকানে নানান রকম জিনিস। মাটির পুতুল, টিনের খেলনা, ঘর-গৃহস্থালির জিনিসপত্র আর মোয়া-মুড়কি, নকুলদানা, বাতাসা, মিষ্টি, রসগোল্লার দোকান। চারদিকে হাঁকডাক, হইহুল্লোড়, গানবাজনার শব্দ। মেলায় ঢোকার পথে হরেক রঙের পান-মসলা দিয়ে পান সাজিয়ে বিক্রি করছে একজন পানওয়ালা।

দাদা আর আমি ঘুরে ঘুরে মেলা দেখছি। দুটি টিনের বাঁশি কিনলাম দুজনে। দাদা টিনের তৈরি একটা মাছের চরকা কিনে দিল আমাকে। সেটা ঘুরালে ক্রমাগত পট পট শব্দ হয়। হঠাৎ দেখি, মাঠের মাঝখানে সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছে। ভিড় ঠেলে সামনে গেলাম। একটা বিশাল জলভরা চাঁড়ি। তাতে ছোট্ট একটা টিনের লঞ্চ ভটভট শব্দ করে ঘুরছে। এ রকম খেলনা আমি প্রথম দেখলাম। খুব ভালো করে লঞ্চটির ভেতরে তাকিয়ে দেখি, পিদিমের মতো ছোট্ট একটা শিখা জ্বলছে। পেছনে বুদ্‌বুদ জল ঠেলে এগিয়ে চলছে খেলনা লঞ্চটি। পছন্দ হলেও লঞ্চটা কিনতে পারলাম না। কারণ, আমাদের হাতে লঞ্চটা কেনার মতো টাকা ছিল না।

দাদা আমার হাত ধরে নিয়ে গেল পুতুলনাচের প্যান্ডেলের দিকে। সেখানে মাইকে বলছে, ‘আসুন, আসুন। ঝুমুর ঝুমুর পুতুলনাচ দেখুন। ছোট-বড়, ছেলে-মেয়ে, সবাই আসুন। এক টাকা টিকিটের দাম।’

তাঁবুঘেরা বিশাল প্যান্ডেল। ভেতরে ঢোকার জন্য পর্দা দেওয়া ছোট পথ। টিকিট কিনে ভেতরে ঢুকলাম। ঘাসের ওপর খড় বিছিয়ে বসার জায়গা করা। জায়গা পেয়েছি পেছনের দিকে। বাইরে তখন সন্ধ্যা। গোটা কয়েক হ্যাজাকের আলোয় ভেতরটা আলোকিত। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি সামনের ছোট কাপড়ে ঘেরা মঞ্চের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্যান্ডেলটা অন্ধকার হয়ে এল। মঞ্চের আলোয় দেখা গেল, দুদিকে সরে যাচ্ছে সামনের পর্দা। আর তখনই শুরু হলো গান। রংবেরঙের একদল পুতুল সারবেঁধে মঞ্চে প্রবেশ করল। কী অদ্ভুত! পুতুলগুলো গানের তালে নাচছে, গাইছে! গান শেষে পুতুলগুলো নাচতে নাচতে চলে গেল।

এবার একটা রাজা পুতুল আর একটা রানি পুতুল কথা বলতে ঢুকল। পরপরই অন্য রাজ্যের আরেক রাজা, আরেক রানি পুতুল। দুই রাজ্যের দুই রাজপুত্র আর রাজকন্যার মধ্যে কীভাবে বিয়ে হলো, পুতুলনাচে দেখানো হলো সেই কাহিনি। দুই রাজ্যের পুতুলদের আনন্দ নাচে শেষ হলো পুতুলনাচের পালা। আমরা বেরিয়ে এলাম।

বাইরে তখন দোকানে দোকানে আলো। ক্রেতার ভিড়। আমার চোখে তখনো পুতুলনাচের দৃশ্য। পুতুলগুলো এত জীবন্ত নাচল কী করে! বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে শুনতে হবে। মা নিশ্চয়ই জানে এই পুতুলনাচের রহস্য।

আরও পড়ুনজীবনের প্রথম উপার্জন, তা–ও আবার বছরের পয়লা দিনে১৯ এপ্রিল ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ