বেচারা, কথা বলতে বলতে ক্যামেরার সামনেই কেঁদে ফেললেন। ‘আমার সন্তান যখন স্কুলে যায় আর তার সহপাঠীরা বলে, তার বাবা একজন চোর, তাতে তার কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে আসাটা কষ্টদায়ক। আমি ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে তার বাবা একজন সৎমানুষ, তিনি যে কোনো খেলোয়াড়ের মতোই ভুল করতে পারেন।’
রিকার্দো দে বুর্গোস বেনগোচিয়ার এই মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গী ছিলেন তাঁর পাশে বসা ভিএআরের দায়িত্বে থাকা পাবলো গঞ্জালেসও। কোপা দেল রের ফাইনালে থাকা এ দু’জনকে নিয়েই রিয়াল মাদ্রিদের জোর আপত্তি। তাদের দু’জনের দিকেই বার্সেলোনার প্রতি আনুগত্যের অভিযোগ এনেছিল এমবাপ্পেদের ক্লাব। এবং ক্লাবটির নিজস্ব টিভি চ্যানেল ‘আরএমটিভি’-তে রীতিমতো দুই ম্যাচ অফিসিয়ালের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। পাঁচ বছর ধরে ফিফার নথিভুক্ত হলেও বুর্গোসের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো ম্যাচ পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই।
সেই তাঁকে কেন কোপা দেল রের ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে? রেফারিকে নিয়ে এসব কাণ্ডে সায় দেওয়ার মতো কাউকে পাশে পাচ্ছে না রিয়াল মাদ্রিদ। রয়েল স্প্যানিশ ফুটবল সংস্থা এই ব্যাপারে চুপ, লা লিগা অনড়, নীরব বার্সেলোনা। বরং অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছে– ‘যথেষ্ট হয়েছে।’ রেফারিদের কান্নার দৃশ্য ভাইরাল হওয়ার পর এক্স হ্যান্ডেলে ‘স্টপ রেফারি হ্যারাসমেন্ট নাও’ হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড চলছে এখন স্পেনে।
রেফারিকে পাল্টানোর দাবিতে রিয়াল এতটাই প্রতিবাদী ছিল যে ফাইনালের আগে কোনো অফিসিয়াল ফটোসেশন, সংবাদ সম্মেলন, ট্রেনিং– কিছুই করেনি। সৌজন্যতা ও বহু বছরের রীতি ভেঙে তারা ম্যাচের আগের রাতে অফিসিয়াল ডিনারেও আসেনি। আর রিয়ালের এই পুরো ব্যাপারটিকে ‘নাটক’ মনে করছে বার্সা।
‘ডেইলি স্পোর্ট’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বার্সার অন্দরমহলে এই ব্যাপারটি নিয়ে কাউকে মিডিয়ার সামনে কিছু না বলার জন্য বলে দেওয়া হয়েছে। তারা মনে করছে, ফাইনালের আগে রেফারিকে মানসিক চাপে রাখতেই এসব নাটক করা হচ্ছে। তারা ম্যাচটিকে কলঙ্কিত করতেই রেফারিকে নিয়ে এসব গল্প তৈরি করেছে। রিয়াল মাদ্রিদ নাকি ফুটবলের চেয়ে মাঠের বাইরের এসব আলোচনা বেশি করে সামনে এনেছে নিজেদের সম্ভাব্য পরাজয়ের অজুহাত খুঁজতে!
বার্সেলোনা এফসির সভাপতি জোয়ান লোপার্তো তাদের অফিসিয়াল ভিডিও বার্তায় এটুকু বলেছেন, ‘রেফারিদের সম্মান দেখাতে হবে এবং ম্যাচে যে কোনো পরিস্থিতি মেনে নিতে হবে।’ কিন্তু নির্দিষ্ট এই রেফারিকে নিয়ে কেন এত আপত্তি রিয়াল মাদ্রিদের? এক পরিসংখ্যানে তারা দেখিয়েছে, এই রেফারি যে ম্যাচগুলো পরিচালনা করেছেন, তাতে রিয়ালের জয়ের ৬৪ শতাংশ, সেখানে বার্সেলোনার ৮১ শতাংশ। কিছু ভিডিও ফুটেজ প্রচার করে তারা দেখিয়ে দিয়েছে, ম্যাচে কী সব ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন তিনি।
রেফারিং নিয়ে রিয়ালের অসন্তুষ্টি নতুন কিছু নয়। গেল ফেব্রুয়ারিতেই লা লিগায় এস্পানিওলের ডিফেন্ডার কার্লোস রোমরোকে লাল কার্ড না দেখানো আর ভিনিসিয়ুসের গোল বাতিল নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল রিয়াল। রিয়াল মাদ্রিদের টিভিতে একটি রিপোর্ট প্রচার করা হয়, যেখানে তারা দাবি করে, এসব করা হচ্ছে রেফারিদের টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান লুইস মোদিনার ইশারায়। তাঁকে পদ থেকে সরানোরও চেষ্টা করছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবের সভাপতি ফ্লোরিন্তিনো পেরেজ। কোনো ম্যাচে রেফারিং নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকলেই লা লিগা ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দেন তিনি।
তবে স্প্যানিশ মিডিয়ায় এর আগে এমনও খবর এসেছে যে, প্রতি মৌসুমেই রেফারিং প্রভাবিত করার চেষ্টা করে রিয়াল মাদ্রিদ। যা নিয়ে বিরক্ত লা লিগা সভাপতি ও রয়েল স্প্যানিশ ফুটবল সংস্থার সহসভাপতি হাভিয়ের তেভাস, ‘এটি ফুটবল নয়, ক্ষমতা দেখানোর খেলা। তিনি (ফ্লোরিন্তিনো পেরেজ) তেভাসকে পছন্দ করেন না। কারণ তিনি যা চান, তেভাস সেটি করেন না। তিনি উয়েফা সভাপতিকেও পছন্দ করেন না। কারণ তিনি যা চান, তা সেফেরিনও করেন না। তিনি সংবাদ সম্মেলন বাতিল করেছেন, তিনি ফাইনালের সব আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করেছেন। তিনি প্রতিবাদ করেন না, চাপ দেন। তিনি অভিযোগ করেন না, হুমকি দেন।’
রিয়াল সভাপতির নাম না করেই এক্স হ্যান্ডেলে এভাবে তীব্র ভাষায় রিয়াল মাদ্রিদকে আক্রমণ করেন তেভাস। বিরক্ত রিয়ালের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদও। এক্স হ্যান্ডেলে একটি বিবৃতি দিয়েছে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ, ‘এটি অসহনীয় হয়ে উঠেছে। স্প্যানিশ ফুটবলের ইমেজকে যথেষ্ট কলুষিত করা হচ্ছে।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এল ক ল স ক ফ ইন ল র অফ স য় ল কর ন ন ফ টবল
এছাড়াও পড়ুন:
লেখক যখন শল্যচিকিৎসক
মারিও বার্গাস য়োসার মহাকাব্যিক উপন্যাস দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড দিয়ে শুরু করা যাক। উপন্যাসের পটভূমি ব্রাজিলের কানুদোস নামের এক বিরাট এলাকা। উনিশ শতকের শেষ দিকে এই কানুদোসেই ব্রাজিলের সেনাবাহিনী নিষ্ঠুরভাবে দমন করে এক গণবিদ্রোহ। লড়াইয়ের একদিকে কানুদোসের অধিবাসী—তারা এক বিশেষ ধর্মীয় সংগঠন, মূলত আদিবাসী, সাবেক ক্রীতদাস ও সমাজচ্যুত লোক দিয়ে ভরা এক বড় জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে নতুন জন্ম নেওয়া ব্রাজিলিয়ান রিপাবলিকের এলিট সেনাবাহিনী। কানুদোসবাসীরা কোনোভাবেই এই নতুন সরকারের কর্তৃত্ব, করব্যবস্থা ও ধর্মনিরপেক্ষ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেনে নেবে না। আবার সরকারও কোনোভাবেই মানবে না তার ভূখণ্ডের মধ্যে গজিয়ে ওঠা ‘বিপজ্জনক’ এই ধর্মমুখী ইউটোপিয়াকে। অতএব শুরু হলো পৃথিবী শেষ হওয়ার যুদ্ধ। কানুদোস হয়ে দাঁড়াল আদর্শিক বিরোধের মঞ্চ, মানুষ থেকে মানুষে নিয়তির ফারাকের নিষ্ঠুর উদাহরণভূমি। ব্রাজিলের সেনাবাহিনী চারটি সামরিক অভিযান চালাল সেখানে, যার শেষটায় গিয়ে আমরা দেখলাম পুরো ভূখণ্ডটারই গুঁড়িয়ে যাওয়া। য়োসা উপন্যাসের শেষ ভাগে লিখেছেন, ‘কানুদোস আত্মসমর্পণ করেনি। একে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, অ্যাটম-বাই-অ্যাটম একে ধ্বংস করা হয়েছে, নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। কাদা ও আশা দিয়ে গড়া, প্রার্থনা ও রক্ত দিয়ে বানানো এই নতুন জেরুজালেম প্রতিরোধ করে গেছে একেবারে শেষ পাথরখণ্ডটাও সেখানে খাড়া থাকা পর্যন্ত। কানুদোস এমনভাবে হাওয়া হয়ে গেল যেন সে কখনো ছিলই না, যদিও তার প্রতিধ্বনি—অন্য সব অন্যায়ভাবে খুন হওয়া জিনিসের মতোই—ভেসে থাকল নৈঃশব্দ্যের গা বেয়ে।’
য়োসার গদ্য লক্ষ করুন, দেখুন কীভাবে তিনি গড়ে তুলছেন নারকীয় এক বাস্তবতাকে। ‘নতুন জেরুজালেম’ নামের ধর্মীয় অনুষঙ্গ আনার পাশাপাশি তিনি নিয়ে এলেন সহিংসতার গা–ছমছমে সব শব্দবন্ধ—‘অ্যাটম-বাই-অ্যাটম’, ‘ধ্বংস’, ‘নিশ্চিহ্ন’, ‘রক্ত’। আর আনলেন একদম ঐতিহাসিক এক চিরসত্য—পৃথিবীর ইতিহাস অবিচারের ইতিহাস।
একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি এবার। য়োসার উপন্যাস অনেকগুলো, প্রায় ২০টা। গুনে দেখলাম, আমি পড়েছি মাত্র ৯টা। তখন আমার বয়স বিশ কিংবা একুশ। ওই সময় ভারতে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এলাম, ঘাঁটি গাড়লাম শাহবাগের সাহিত্য পাড়ায়। কানুদোসের ধুলো ভরা পথে তত দিনে আমার হেঁটে আসা শেষ। বার্গাস য়োসার হিংস্র, রাগী আর গোলকধাঁধায় ঢোকার বোধ জাগানো গদ্যে তখন আমার মাথা একদিকে কাত, আর হাতে তাঁর উপন্যাস দ্য রিয়াল লাইফ অব আলেহান্দ্রো ম্যায়তা। পুরো শাহবাগ সে দিনগুলোয় মেতে আছে লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতা নিয়ে। আর এরই মধ্যে আমি কিনা ঘোষণা করে বসেছি, বার্গাস য়োসা মার্কেসের চেয়েও শক্তিশালী লেখক! এরপর ১৯৯২ সালের দিকে, তখনকার নামজাদা সাহিত্যপত্রিকা মাটিতে বেরোল বার্গাস য়োসা পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা আমার এক দীর্ঘ নিবন্ধ, যেখানে প্রচ্ছন্নভাবে আমি বলে দিলাম যে তোমরা পড়ে থাকো তোমাদের মার্কেসিয়ান লিরিক্যাল, বর্ণিল-উজ্জ্বলতার মধ্যে; আমি ঢুকছি য়োসার অন্ধকার নরকে—এখানে নরক মানে আসলে এক ঝড়, আকাশ-কালো-করা ঝড়। সেই ঝড় অর্থাৎ বার্গাস য়োসার মধ্যেই প্রথমবারের মতো আমি আবিষ্কার করলাম, কথাসাহিত্য একই সঙ্গে মানুষের নিষ্ঠুর ইতিহাস, আবার কোনো জমকালো হ্যালুসিনেশনও হতে পারে। আমি লিখেছিলাম, ‘মার্কেস তাঁর পাঠকদের প্রেমময় প্রলোভনে ফেলেন, আর য়োসা তাঁর পাঠকদের সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসেন।’
তিনি যে চ্যালেঞ্জই করেন, সে বিষয়টা আমার মাথায় এসেছিল তাঁর দ্য রিয়াল লাইফ অব আলেহান্দ্রো ম্যায়তা পড়ে। এখানেও সেই একই বিপ্লব-বিদ্রোহের গল্প। আলেহান্দ্রো ম্যায়তা এক ট্রটস্কিপন্থী বিপ্লবী, পঞ্চাশের দশকের পেরুতে ব্যর্থ এক অভ্যুত্থানের নেতা। উপন্যাসজুড়ে কথক সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন ম্যায়তাকে চেনা অসংখ্য মানুষের, উদ্দেশ্য বোঝা যে পেরুর আন্দেজে ঘটা সেই অভ্যুত্থান আসলে ব্যর্থ হয়েছিল কী কারণে? সব বার্গাস য়োসাতেই যেটা হয়, আস্তে আস্তে ফ্যাক্ট ও ফিকশনের সীমারেখা ভেঙে যেতে লাগল। আমরা দেখলাম, এক আলেহান্দ্রো ম্যায়তা আসলে অনেক আলেহান্দ্রো ম্যায়তা—বামপন্থী বীর, কিন্তু কাজকর্ম বাস্তবের সঙ্গে সংগতিহীন; বিশ্বাসে আন্তরিক কিন্তু বাস্তবে একদম কাঁচা এক নেতা; সমকামী, কিন্তু সেটা এমন এক সামাজিক পরিমণ্ডলে যেখানে সমকাম ও সশস্ত্র বিপ্লব একসঙ্গে যায় না। উপন্যাসটিতে ম্যায়তা সব অর্থে বিভ্রান্ত এক বিপ্লবী।
চ্যালেঞ্জটা পাঠকের দিকে এখানেই ছুড়লেন য়োসা। ম্যায়তার মধ্য দিয়ে তিনি চ্যালেঞ্জ করে বসলেন লাতিন আমেরিকার বামপন্থীদের। মার্ক্সবাদী তকমা বুকে লাগিয়ে ঘোরা মানুষগুলো জানেনই না যে তাঁরা আদতে স্রেফ রোমান্টিক বিপ্লবী, একরকম এটাই য়োসার মোদ্দাকথা।
বাস্তবেও এই উপন্যাস লেখার কাছাকাছি সময় থেকে য়োসার নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসেরও বাঁকবদল শুরু হয়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বামপন্থী লেখকের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে, কিউবা ও ফিদেল কাস্ত্রোতে সম্মোহিত হয়ে থাকাকে বিদায় জানিয়ে, তিনি নিজেকে শাণিত করতে থাকলেন কর্তৃত্ববাদী বাম ও স্বৈরাচারী সমাজতন্ত্রের কড়া সমালোচক হিসেবে। ওই শুরু বার্গাস য়োসার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এক নতুন যাত্রার—লেখালেখি রাজনৈতিকই থাকবে, কিন্তু ওই তখন থেকেই তিনি বলা শুরু করবেন লিবারেল ডেমোক্রেসি, বাক্স্বাধীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, আর ব্যক্তির সার্বিক মুক্তির সপক্ষে।
আলোচনার এই অংশের শুরুটা করেছিলাম য়োসা পড়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে। সারাংশে এসে বলতে চাইছি যে এই নতুন ‘বামবিরোধী লিবারেল পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ য়োসাকে পড়াটাই পাঠকের জন্য ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
সারা জীবন বড় ঘটনা হয়েই থেকে গেছেন বার্গাস য়োসা—যেমন লেখক হিসেবে, তেমন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, নাট্যকার ও পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের ভূমিকায়। ৮৮ বছর বয়সে এই সেদিন তিনি প্রয়াত হলেন। আর আমরা একটা ‘ফেনোমেনন’-এর ইতি দেখলাম। ১৯৯০ সালে পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিততে জিততে শেষে হেরে গিয়ে তিনি যে রাজনৈতিক ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেই ব্যর্থতাকে পরে কী করে সাহিত্যের মাঠের সফলতায় রূপ দিতে হয়, সে চ্যালেঞ্জে জেতারই ‘ফেনোমেনন’ তিনি।
তাঁর সর্বসেরা উপন্যাস দ্য ফিস্ট অব দ্য গোট পড়ার পরে আমার কাছে এটুকু পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে য়োসার নিজের রাজনৈতিক আদর্শের বদল কোনো সুবিধাবাদের আলিঙ্গন কিংবা কোনো চারিত্রিক বিসংগতি নয়, এটা তাঁর গূঢ়তম অবসেশনেরই এক বর্ধিত রূপ। কী সেই অবসেশন?
য়োসার অবসেশন ক্ষমতার অঙ্গব্যবচ্ছেদ করা, ক্ষমতার অ্যানাটমি নিয়ে কাজ করা। তিনি সামরিক শাসককে নিয়ে লিখুন কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি বামপন্থী বিপ্লব বা গণ–আন্দোলন নিয়েই লিখুন, তাঁর কলম অপারেশন থিয়েটারে অঙ্গব্যবচ্ছেদের ছুরি হয়ে একদিকেই যায়—শাসক কীভাবে শাসিতের সঙ্গে আচরণ করে এবং ওই শাসনের নিচে পড়ে ব্যক্তিমানুষ কী করে হয় গ্রাসিত, অথবা সো-কলড ‘প্রগতিশীল’ হয়ে ওঠার নামে কী করে সে নৈরাজ্যবাদী ধরনের গোঁড়া-অন্ধ দানবে রূপ নেয়, সেটা বোঝার দিকেই ছিল তাঁর ক্লিনিক্যাল ঝোঁক।
এক্ষণে সাহিত্যে য়োসার ঘরানা নিয়ে কিছু বলা যাক। তিনি সেই দুর্লভ গোত্রের লেখকদের একজন, যার সাহিত্য বাস্তববাদী ঘরানার ইতিহাসনির্ভর ফিকশন, কিন্তু তার পুরোটা আবার দার্শনিক বৈপরীত্য এবং নানা সংশয় দিয়ে মোড়া। তিনি না উত্তর-আধুনিক, না জাদুবাস্তববাদী। তবে এই দুই ঘরানা থেকে উদার হাতে নিয়ে ভয়ংকর-বাস্তববাদের সাহিত্যিক নির্মাণে তাঁর ওপরে সম্ভবত কেউ নেই। এ বিচারে তাঁর লেখকসত্তার নাড়ি যেমন ধরা নিজের মহাদেশের মার্কেস ও কোর্তাসারের সঙ্গে, তেমন সেটা প্যাঁচানো কনরাড, দস্তয়েভস্কি, কাম্যু, ফকনার আর জর্জ অরওয়েলের সঙ্গেও। ‘আমার সব লেখালেখি তিন ইংরেজি “R” অক্ষর দিয়ে ঘেরা—রিপ্রেশন, রেজিস্ট্যান্স, রেভল্যুশন—দমন–পীড়ন, প্রতিরোধ ও বিপ্লব। আমার ভালো লেখাগুলো, যেমন দ্য ফিস্ট অব দ্য গোট কিংবা দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড তরঙ্গ তোলে একই অস্তিত্ববাদী ঢেউয়ের ওপরে: বীরত্বের ভেতরকার ফাঁপাটুকু, আদর্শবাদের মধ্যকার পচনটুকু, আর আমাদের চেতনার গভীরে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা একাকিত্ব—এই তিন ঢেউয়ে ভেসেই আমার লেখালেখি।’ মাত্র দুই বছর আগে নিজের সাহিত্যকর্মের সারকথা তিনি বলে গেছেন এভাবে।
তাঁর লেখার প্রকরণ বা শৈলীতে আসি। মার্কেসের মতোই য়োসা তাঁর গদ্যে আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার ক্ষমতা রাখেন। যদিও প্রকরণে তা একেবারেই লিরিসিজমবর্জিত। তিনি বাক্যের কাঠামোর আদি বা ধ্রুপদিরূপে বেশি বিশ্বাসী। আর প্রায়ই সেগুলো যেন অনেকটা ইচ্ছা করে দীর্ঘ করা লম্বা-টানা কোনো নকশার মতো। এটাই য়োসার বিখ্যাত পলিফোনিক বা বহুস্বরিক বর্ণনা প্রকরণ, যেখানে যেকোনো জিনিসের ওপর আলো ফেলা হচ্ছে একের অধিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ফলে সময়ের কালানুক্রমিক চেহারাটা হাওয়া, আর ইতিহাস সেখানে খণ্ডিত বা পা-ভাঙা; এবং সংলাপগুলো এই মুখ চেপে ধরা, আবার এই জোর চিৎকারের। য়োসা পড়তে আপনার ধৈর্য লাগবে, কিন্তু তাঁর অধিকাংশ উপন্যাস শেষ করে আপনার মনে হবে আপনি জীবনে সত্যি এবার পড়ার মতো কিছু একটা পড়লেন! বাংলা সাহিত্যের পটভূমি ধরলে য়োসা পড়া অমিয়ভূষণ মজুমদার পড়ার মতো কিছু—একই বহুস্তরবিশিষ্ট সময় ও ইতিহাসের বয়ান, দারিদ্র্য নিয়ে রোমান্টিসিজম করার দিকে একই রকমের সোজাসাপটা ‘না’, আর ব্যক্তি ও রাষ্ট্র—দুই তরফ থেকেই ঘটানো সমান নিষ্ঠুরতার এক ক্যাটাগরিক্যাল বয়ানকৌশল। তাঁর উপন্যাস দ্য ফিস্ট অব দ্য গোট, যেটা হাতে নিলেই ভয় লাগে, যেহেতু ভয়ই ছিল প্রেসিডেন্ট রাফায়েল ট্রুহিয়োর স্বৈরশাসনের মূলমন্ত্র, সেখানে য়োসা লিখছেন, ‘একনায়কসুলভ স্বৈরশাসনগুলো অজাচারের মতো (অর্থাৎ রক্তের সম্পর্কের মধ্যে যৌনসংসর্গ); যত বেশি দিন ওই জিনিসটা চলতে থাকবে, ততই খোঁড়া-পঙ্গু-লুলা ধরনের কিছু হয়ে ওঠার আগে বিষয়টার শেষ হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।’
একজন বাংলাদেশি হিসেবে, গত জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলি নিজ চোখে দেখার পর কী রকম আধিভৌতিক সত্যতা নিয়ে আমার কানে বাজে য়োসার এই বাক্য। গার্সিয়া মার্কেস আমাদের দিয়েছিলেন স্বৈরশাসনের স্বপ্নভুবনে বিচরণের কথামালা। আর বার্গাস য়োসা দিয়ে গেছেন ওই একই শাসনের রক্ত, হাড্ডি ও আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর নির্মম বিবরণ।
য়োসা লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের বিখ্যাত ‘বুম’ জেনারেশনের লেখকদের একজন। তাঁরা চারজন মূলত এই ‘বুম’-এর চার স্তম্ভ। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, হুলিয়ো কোর্তাসার, কার্লোস ফুয়েন্তেস ও মারিও বার্গাস য়োসা। এর মধ্যে দুজন—মার্কেস ও য়োসা—সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জেতা লেখক। আর চারজন একসঙ্গে মিলে তাঁরা বিশ্বসাহিত্যে উপন্যাসের অভিমুখ, রূপ ও শৈলীতে বিপ্লবই ঘটিয়ে দিলেন। চারজনই কসমোপলিটন, সাহিত্যে নিরীক্ষার পক্ষে এবং ‘আমাদের সব লেখালেখি ক্ষমতা ও রাজনীতি নিয়েই হতে হবে’—এমন ধারণায় তাড়িত। তবে এত মিল সত্ত্বেও য়োসা এই ‘বুম’ দলে এক বিরাট ব্যতিক্রম। তিনি মানুষের বিপ্লবকে সাহিত্যে রোমান্টিসাইজ করার ঘোর বিপক্ষের লোক; এবং যেকোনো ধরনের আদর্শিক ইউটোপিয়া নির্মাণের বিরোধী। মার্কেস সে অর্থে মরমি—রিয়ালিজমের মধ্যে তিনি বুনে চলেন ম্যাজিক্যাল ও মিথিক্যালকে; আর য়োসা, আগেই বলেছি, একজন শল্যচিকিৎসক—ক্ষমতা, রাজনীতি, গণচেতনা, প্রাতিষ্ঠানিক চেতনা ও ব্যক্তিচেতনাকে কেটেকুটে একাকার করা এক নিবিষ্টমনা সার্জন। মরমি মার্কেস বলেছিলেন, ‘যা আপনি যাপন করছেন, তা আপনার জীবন নয়, যার আপনি স্মৃতিচারণা করছেন এবং যেভাবে তা করছেন, সেটাই আপনার জীবন।’ অন্যদিকে য়োসার কথা, ‘সাহিত্য একটা মিথ্যা জিনিস, যা কিনা সত্য বলছে।’
সত্য ও মিথ্যার কথা যে–ই আসছে, আপনি বুঝে যাচ্ছেন, তিনি পার্থিব কংক্রিট বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছেন, রাষ্ট্র বা শাসক যা বলছে সেগুলোকে মিথ্যা ভেবে নিয়ে সেসবের বিরুদ্ধে আপনার বিশ্বাসের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার এক যোদ্ধা-চেতনার কথা সেটা। এক সাক্ষাৎকারে য়োসা মিশেল ফুকোর সবকিছুতে খুঁত ধরার বাতিকের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি লিখি যাতে করে আমি পাগল হয়ে না যাই।’ সাহিত্য তাঁর জন্য ওইটাই ছিল—পৃথিবীতে ঘটতে থাকা নানা পাগলামির বিরুদ্ধে তা ছিল এক জোর ঘোষণা দেওয়া লড়াই।
য়োসা মারা গেছেন। তাঁর বিখ্যাত কথা—‘আত্মার জন্য সবচেয়ে ভালো খাদ্য সেই গল্প, যার শেষটা ভালো—শেষটা খারাপ হলে কিন্তু হবে না।’ তাঁর গল্প কি শেষ? খারাপভাবে শেষ নাকি ভালোভাবে শেষ? জানতে হলে য়োসা আপনার পড়তে হবে, কারণ মানুষটা নেই, কিন্তু তাঁর উপন্যাসগুলো আছে। ওরা আছে এবং থেকে যাচ্ছে আপনাকে জ্বালাতে, উসকানি দিতে। আর অনবরত বলতে যে অন্যায় থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ো না, তবে জেনো তোমার চোখও ভুল দেখতে পারে।