ইউক্রেনে রুশ যুদ্ধশিবির থেকে দুর্বিষহ জীবনের গল্প বললেন এই বাংলাদেশি তরুণ
Published: 26th, April 2025 GMT
যুদ্ধশিবিরে আজ আমার ২৯তম দিন। ইউক্রেনের রুশনিয়ন্ত্রিত শহর দোনেৎস্কে আছি। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুভয়। এই তো সেদিন আমাদের গাড়িবহরে গোলা আঘাত হানল। দিগ্বিদিক ছুটে কোনোরকম বেঁচে ফিরলাম। এখানে রুশ সৈনিক আছেন ৩০-৪০ জন। আমি সবার ছোট বলে সবাই স্নেহ করেন। অভিযানে না নিয়ে বেশির ভাগ দিন শিবিরেই কাজ করি। কমান্ডারের নির্দেশে কখনো অস্ত্রশস্ত্র, কখনো গোলাবারুদ টানি, আবার কখনো সৈনিকদের খাবার সরবরাহ করি।
বিভিন্ন যুদ্ধশিবিরে আমার মতো আরও কয়েকজন বাংলাদেশি আছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই গোপনে যোগাযোগ আছে। সেদিন একজনের মৃত্যুর খবরও পেলাম। দুর্বিষহ জীবন, তবু বাড়িতে কথা বলার সময় হাসিমুখে থাকি। মা-বাবাকে বলতেও পারি না কোথায় আছি, কত কষ্টে সবার অগোচরে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছি।
অথচ এক সুন্দর জীবনের স্বপ্ন নিয়ে রাশিয়ায় এসেছিলাম।
উন্নত জীবনের খোঁজেএসএসসির পর থেকেই ইউরোপের কোনো একটি দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কাজসহ উত্তর মেসিডনিয়ার ভিসা করিয়ে দেওয়ার আশ্বাসে আমার পাসপোর্টও নিয়ে যান এক দালাল।
পরে গত বছর দালাল জানান, মেসিডনিয়ায় ভিসা হবে না। রাশিয়ায় ভালো একটি কোম্পানিতে উচ্চ বেতনে কাজের একটি ভিসা আছে। মাসিক বেতন ৪০-৪৫ হাজার রুবল (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০–৭০ হাজার টাকা)। খরচ লাগবে আট লাখ টাকা। আমার পরিবার তাতেও রাজি।
আমার তখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছিল। এর মধ্যেই গত বছর রাশিয়ায় আসি। মাস দেড়েক পর চীন সীমান্তবর্তী ব্লাগোভেশচেনস্ক শহরের এক প্রতিষ্ঠানে আমাকে কাজে পাঠানো হয়। রাশিয়ায় ওয়েল্ডিংয়ের কাজে পাঠানো হলেও সিনোপ্যাক নামে চীনা কোম্পানিতে আমি ছিলাম ইলেকট্রিশিয়ান। তারপরও মেনে নিই। কাজ শেখায় মনোযোগী হই।
মাস দুয়েক ভালোই চলছিল। এরপর বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ভেবেছিলাম, হয়তো সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে, ঠিক হয়ে যাবে; কিন্তু না, ফেব্রুয়ারির শুরুতে কোম্পানি পাসপোর্ট হাতে ধরিয়ে বের করে দেয়। শুধু আমি না, আরও প্রায় ২০ জনের সঙ্গেও একই কাজ করে। তাঁদের দুজন নেপালি, দুজন ভারতীয়, বাকিরা বাংলাদেশি।
ইউক্রেনের মারিওপোলে রুশ ট্যাংক বহর.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় নেতাদের মুখোমুখি জেলার নেতারা
ঝালকাঠি জেলা বিএনপির কাউন্সিলে শীর্ষ দুই পদে কেন্দ্রীয় দুই নেতার প্রার্থিতা ঘোষণার পর জটিল হয়ে পড়েছে পরিস্থিতি। দিনক্ষণ ঠিক না হলেও শান্তিপূর্ণ কাউন্সিল অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন নেতাকর্মীরা। একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কাঁঠালিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেন নিজাম মীর বহরের দলীয় পদ স্থগিত করেছে জেলা কমিটি। এ নিয়ে বাড়াবাড়ির অভিযোগ তুলে সদস্য সচিব শাহাদাত হোসেনকে হুমকি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুল হক নান্নু। শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও অভিযোগ দিয়েছেন জেলার চার উপজেলার সাবেক নেতারা।
জেলা বিএনপি সূত্রে জানা যায়, কাউন্সিলের জন্য সম্ভাব্য দিন হিসেবে তারা ২৮ এপ্রিল নির্ধারণ করেছিলেন। তারা অপেক্ষা করছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সবুজ সংকেতের। কিন্তু গতকাল শনিবার পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেননি।
জেলা বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০১৭ সালে। ১৫১ সদস্যের কমিটিতে মোস্তফা কামাল মন্টুকে সভাপতি ও মনিরুল ইসলাম নুপুরকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। সেই কমিটি ভেঙে ২০২০ সালের নভেম্বরে গঠন করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। এতে সৈয়দ হোসেনকে আহ্বায়ক ও শাহাদাত হোসেন সদস্য সচিব হন।
গত ফেব্রুয়ারিতে দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য হায়দার আলী লেলিনকে জেলা বিএনপির কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। সেই অনুযায়ী, কাজও শুরু করে কমিটি। এরই মধ্যে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠলে ৫ এপ্রিল কাঁঠালিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেন নিজাম মীর বহেকে শোকজ করে আহ্বায়ক কমিটি। এতে একই উপজেলার আমুয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলে খোদা সুমন খলিফার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবির বিষয়ে জবাব চাওয়া হয়। বিএনপি সূত্রের দাবি, ওই টাকা না দেওয়ায় ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর করা এক মামলায় সুমন খলিফাকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সঙ্গে আসামি করা হয়। এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিতে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়ার মিন্টুও জেলার নেতাদের অনুরোধ করেন। কিন্তু তা উপেক্ষা করেই কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনায় ২৩ এপ্রিল নিজাম মীর বহরের দলীয় পদ স্থগিত করে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। এতে উল্লেখ করা হয়, নিজাম মীর বহরের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
২১ এপ্রিল এক সভায় জেলা বিএনপির সভাপতি পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন দলের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জামাল। সেখানেই সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থিতার জানান দেন কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুল হক নান্নু। বিএনপি সূত্র জানায়, দলীয় গঠনতন্ত্রের ১৫(খ) ধারায় উল্লেখ আছে, জাতীয় নির্বাহী কমিটির কোনো কর্মকর্তা এবং দলীয় অঙ্গ দল বা সংগঠনের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক অন্য কোনো পর্যায়ের কমিটিতে কর্মকর্তা নির্বাচিত হতে পারবেন না। ওই দুই কেন্দ্রীয় নেতার জেলা কমিটির শীর্ষ দুই পদে প্রার্থিতার ঘোষণাকে গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
রাজাপুরের বাসিন্দা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক দক্ষিণ শাখার সভাপতি সেলিম রেজা কাউন্সিলে সদস্য হতে আগ্রহী। তিনি মোবাইল ফোনে বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশেই জেলা বিএনপির কাউন্সিলের প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু দুই কেন্দ্রীয় নেতার প্রার্থিতা ঘোষণায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে। মাঠ পর্যায়ে তাদের তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই দাবি করে তিনি বলেন, পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে কেন্দ্রীয় প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন এই নেতারা। নানা অভিযোগ তৈরি করে তারা কাউন্সিল বানচালের পাঁয়তারা করছেন।
ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আজম সৈকতের বাড়ি কাঁঠালিয়ায়। তাঁর ভাষ্য, ‘নিজাম মীর বহরের পদ স্থগিতে ক্ষুব্ধ হন নান্নু ভাই। তাই বিভাগীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য ও জেলা কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হয়েও সদস্য সচিবের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দিয়ে যান।’ অভিযোগ দেওয়ার সময় তিনিও সেখানে ছিলেন দাবি করে সৈকত বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ও বর্তমান কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট শাহাদাত হোসেন বলেন, “আমি (নিজাম মীর বহরের) পদ স্থগিতের চিঠি দেওয়ায় নান্নু ভাই আমাকে হুমকি দিয়েছেন। এমনকি আমার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে এসেছেন। নিজাম মীর বহরের জবাব সন্তোষজনক ছিল না ও জবাবের কোনো প্রমাণও দেননি। তাই কেন্দ্রকে জানিয়েই তাঁর পদ স্থগিতের চিঠি দিয়েছি। ওই চিঠির নিচে ‘বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে’ লিখে নান্নু আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছেন।” তিনি দাবি করেন, মীমাংসিত বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সম্মেলন বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। যারা এতে সই করেছেন, তারা সবাই বিগত ১৫ বছর ছিল নিষ্ক্রিয়। তাদের কাউন্সিলে ভোট নেই। তাই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছেন তারা।
জেলা কমিটির সভাপতি প্রার্থী ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম নুপুর শনিবার সন্ধ্যায় সমকালকে বলেন, সভাপতি হতে না পারলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকবেন বলে রফিকুল ইসলাম জামাল হুমকি দিয়েছেন। তিনি প্রার্থী হতে চাইলে কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। না হলে কাউন্সিলররা স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না।
শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলে কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুল হক নান্নু বলেন, শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে রাজাপুর, কাঁঠালিয়া, নলছিটি উপজেলার বর্তমান ও সাবেক নেতারা চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি (শাহাদাত) জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল্লাহ পনিরের আইনজীবী হিসেবে অতীতে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর জামিনও করিয়েছেন।
তাঁর ভাষ্য, ‘কাঁঠালিয়ার নিজাম মীর বহরের বিষয়ে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দিতে বলেছিলেন দলের বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমপ্রধান ও কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। তাঁর নির্দেশ উপেক্ষা করে তদন্তের আগেই নিজামের পদ স্থগিত করেছেন শাহাদাত। তাই আমি বলেছি, এটা বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আমি তো তাঁকে গালাগাল করিনি।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে আসন্ন কাউন্সিল সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হায়দার আলী লেলিন বলেন, ‘কয়েকদিনের ব্যবধানে কিছু ঘটনায় ও ভুল বোঝাবুঝির কারণে বিষয়গুলো নিয়ে কিছু জটিলতা হয়েছে। আমাদের টিমপ্রধান আবদুল আউয়াল মিন্টুর তদন্ত করার আগেই কাঁঠালিয়ার নিজামের পদ স্থগিতের চিঠি কেন দেওয়া হয়েছে– সে বিষয়ে শাহাদাত সাহেবের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। এরপর মিন্টু ভাই সিদ্ধান্ত দেবেন।’ তিনি মনে করেন, শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে উপজেলা নেতাদের অভিযোগ ও পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়েছে। এর প্রভাব পড়বে কাউন্সিলে। তার পরও সব সমস্যার সমাধান করে শিগগিরই কাউন্সিল করার আশা করছেন।