দেশি বিনিয়োগেই বেশি কর্মসংস্থান, তবু কেন বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে বেশি উৎসাহ
Published: 26th, April 2025 GMT
কর্মসংস্থানের প্রধান চালিকা শক্তি হলো বিনিয়োগ। যত বেশি বিনিয়োগ, তত বেশি উৎপাদন এবং সেই অনুপাতে সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান। বাংলাদেশে এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশি–বিদেশি—উভয় ধরনের বিনিয়োগই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিসংখ্যান বলছে, কর্মসংস্থান তৈরিতে দেশীয় বিনিয়োগের অবদানই তুলনামূলকভাবে বেশি।
যদিও এ অভিযোগ বেশ পুরোনো যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এ দেশে তুলনামূলকভাবে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। বিডার বিনিয়োগসংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে একটি স্পষ্ট চিত্র উঠে আসে।
বিডার বিনিয়োগবিষয়ক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৯-১০ সালে ৩৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশীয় বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৪১৮ জনের; সেই বছর ৮৯ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৫ জনের।
২০২০-২১ সালে ৬৬৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ১০০ মানুষের। এর বিপরীতকে ১০৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ হাজার ৬৮৬ জনের।
মেটা ১২ বছরে, অর্থাৎ ২০০৯-১০ থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত ১০ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলার স্থানীয় বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে মোট ২৮ লাখ ১৭ হাজার ৯০২ জনের। একই সময় ৫ হাজার ৯৪৩ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৮৭৫ জনের।
২০০৯-১০ থেকে শুরু করে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান দিয়েছে বিডা। সেখানে দেখা গেছে, বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে দেশে আনুষ্ঠানিক খাতে একজন মানুষের কর্মসংস্থান করতে যেখানে ৯৩ হাজার ৪২৮ ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়, সেখানে স্থানীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় ৩৭ হাজার ৫২৮ ডলার। অর্থাৎ একই পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে দেশি বিনিয়োগের তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ লাগে আড়াই গুণ।
বাস্তবতা হলো, দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত হারে তা বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট–সম্পর্কিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে দেশে নিট প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র ২১ কোটি ৩০ লাখ ইউএস ডলারের। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় নিট এফডিআই ৫৩ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৭১ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমেছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, স্থানীয় বিনিয়োগ থেকে সৃষ্ট মুনাফা সাধারণত দেশেই থাকে এবং পুনর্বিনিয়োগ হয়। ফলে দেশের সম্পদ দেশেই বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় সংযোগ ও সহযোগী শিল্প গড়ে ওঠার অবকাশ তৈরি হয়। অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানিগুলো মুনাফার একটি বড় অংশ নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যায়। ফলে স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে সংযোগে গভীরতা আসে না। স্থানীয় অর্থনীতি তা বিদেশি বিনিয়োগ থেকে যতটা উপকৃত হতে পারত, এসব কারণে ততটা পারে না। সে কারণে স্থানীয় বিনিয়োগ থেকে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হয়, বিদেশি বিনিয়োগ থেকে ততটা হয় না।
তবে বিদেশি বিদেশি বিনিয়োগেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে উচ্চ প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান আসে; ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশে আসে প্রতিযোগিতা। অনেক সময় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়নে অংশ নেয়। বিদেশি বিনিয়োগ আসলে দেশের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। এর মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধি পায়; অর্জিত হয় বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু স্থানীয় বিনিয়োগে গতি না এলে বিদেশি বিনিয়োগও গতি আসবে না বলে মনে কজরেন বিশ্লেষকেরা।
আরও পড়ুনব্যাংকঋণের সুদহার কমলেই কি বিনিয়োগ বাড়বে০১ অক্টোবর ২০২৪এফডিআই বাড়ে নাবিশ্বব্যাংকের আইএফসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিদেশি বিনিয়োগ মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ (২০২৩)। সামগ্রিকভাবে যেখানে জিডিপির অনুপাতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ শতাংশের মতো সরকারি ও ব্যক্তি বিনিয়োগ মিলিয়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতির যে গতি প্রত্যাশা করে তার বিপরীতে বিদেশি বিনিয়োগের হার অপর্যাপ্ত। যে বিনিয়োগ আসছে, তা মূলত দেশে ব্যবসারত বিদেশি কোম্পানিগুলোই করছে। নতুন কোম্পানি আসছে কম। এমনকি স্যামসাংয়ের মতো কোম্পানি স্রেফ জমিসংক্রান্ত জটিলতার কারণে দেশে বিনিয়োগ করতে পারেনি।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিডার বিনিয়োগবিষয়ক সম্মেলনে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, দেশে ব্যবসার পরিবেশ তথা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনো পাঁচটি বড় বাধা রয়েছে। সেগুলো হলো বিদ্যুতের সমস্যা, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য ও উচ্চ করহার।
দেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈষম্যদেশের ব্যবসায়ীরা বলেন, দেশের ব্যাংকের সুদহার বেশি, যদিও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিদেশ থেকে কম সুদে ঋণ আনতে পারেন। সেই সঙ্গে তাঁরা মুনাফা অন্য দেশে নিয়ে যেতে পারেন; বাংলাদেশের স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা সাধারণত অন্য দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন না। করতে চাইলে হাজার রকম অনুমোদন নিতে হয়।
শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, সম্প্রতি বিডার বিনিয়োগ সম্মেলনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগজনিত সমস্যার সমাধান নিয়ে অনেক কথা বলা হলো। সম্প্রতি নতুন কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেল। কিন্তু যারা দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন, সেই স্থানীয় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের সমস্যার সমাধানে এমন উদ্যোগ দেখা যায় না।
দেশে সামগ্রিকভাবে যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তা বিনিয়োগের জন্য অনুকূল নয় বলেই মনে করেন শামস মাহমুদ। তিনি বলেন, সম্প্রতি বিডা এত ঘটা করে বিনিয়োগ সম্মেলন করল, কিন্তু সেই সম্মেলনের পরপরই শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। এমনকি নতুন দামে গ্যাস দেওয়া হবে বলে অনেক দিন ধরে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে তাঁর নতুন এক কারখানায় গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে বলে জানান তিনি।
দেশের স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে স্বস্তি না পেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আসতে চাইবেন না, এটাই বাস্তবতা বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বিনিয়োগের যথোপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় অধিকাংশ খাতে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি গঠনের সুযোগ থাকলেও কখনোই এফডিআই আকর্ষণে বাংলাদেশ ভালো করেনি। এমনকি দেশে কর্মরত বিদেশি কোম্পানিগুলোর মুনাফার হার ভালো হলেও দেশে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ খুবই কম। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা।
দেশের বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিবেশ বিনিয়োগের জন্য অনুকূল নয় বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। এ পরিস্থিতিতে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা আস্থা না পেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আস্থা পাবেন না বলে মনে করেন তিনি। সেই সঙ্গে দেশে বর্তমানে ব্যাংকঋণের সুদহার বেশি। পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে বিনিয়োগকারীরা হয়তো ঝুঁকি নিয়েও বিনিয়োগ করতেন, কিন্তু এই বাস্তবতায় বিনিয়োগকারীরা বেশি সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন না। বিনিয়োগ সম্মেলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিশ্রুতি তো অনেকই আসে, কিন্তু শেষমেশ তা কতটা বাস্তবায়িত হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
বিদ্যমান এই অনিশ্চয়তা থেকে উত্তরণে গণতান্ত্রিক উত্তরণের রূপরেখা প্রয়োজন বলে মত দেন সেলিম রায়হান। অর্থাৎ সংস্কার কবে নাগাদ করা হচ্ছে, এরপর যাঁরা ক্ষমতার আসতে পারেন, তাঁরা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কী ব্যবস্থা নেবেন—এসব বিষয় বোঝার জন্য বিনিয়োগকারীরা মুখিয়ে আছেন।
আরও পড়ুনবাংলাদেশে বিনিয়োগ কম, বড় বাধা পাঁচটি ০৯ এপ্রিল ২০২৫আর যত কারণএদিকে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের রিটার্ন অন ইক্যুইটি ভালো হলেও রিটার্ন অন অ্যাসেট বৈশ্বিক গড় মানের চেয়ে কম। দ্য গ্লোবাল ইকোনমির হিসাবে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রিটার্ন অন অ্যাসেট ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশ, যেখানে বৈশ্বিক গড় মান ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০১০ সালে দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রিটার্ন অন অ্যাসেট ছিল সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ; ২০২১ সালে তা কমে ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এই পরিসংখ্যান দেখে বিনিয়োগ করে থাকেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ন য় গ র ব পর ত ব ন য় গ কর র ট র ন অন পর স খ য ন পর ব শ ২১ স ল দশম ক ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
জায়গাসংকটে পাশে নয়, উচ্চতায় বড় হচ্ছে সিইপিজেড
চার দশক আগে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে দেশের প্রথম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড)। গুটি কয়েক কারখানা ও মাত্র ৬২৪ জন শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড)। প্রথম অর্থবছরে (১৯৮৩-৮৪) সিইপিজেড থেকে রপ্তানি আয় আসে ১ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪২ বছর পর এসে সেই সিপিজেডের চিত্র পাল্টেছে।
শুরুতে কারখানা ১০টির কম থাকলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৪টিতে। প্রায় দেড় দশক আগেই চট্টগ্রাম ইপিজেডের সব প্লট শেষ হয়ে গেছে। তারপরও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এখনো আগ্রহের কেন্দ্রে সিইপিজেড। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সেই আগ্রহে বড় হচ্ছে সিইপিজেড। তবে সেটি পাশে নয়, বড় হচ্ছে ওপরের দিকে। অর্থাৎ বাড়ানো হচ্ছে ভবনের উচ্চতা। এতে রপ্তানি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও দেখছে দেশের ইপিজেডগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।
বেপজা বলছে, প্রায় ৪৫৩ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা সিইপিজেডে মোট প্লট ৫০১টি। বর্তমানে সিইপিজেডে প্লটের সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ নেই। তাই কারখানা ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত দুই বছরে একতলা বা দোতলা ভবনের মোট ১০টি কারখানা ভেঙে ওপরের দিকে বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ চার থেকে আটতলা করা হয়েছে।
কারখানার পরিধি বাড়ানোর কারণে সিইপিজেডে শ্রমিকসংখ্যাও বেড়েছে। গত ৯ মাসে সিইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক বেড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। এ সময় চারটি নতুন কারখানা চালু হয়েছে। তবে শুরুতে এমন ছিল না সিপিজেডের চিত্র। শুরুতে তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ছিল বেশি, এখনো তা–ই। তবে সময়ের পরিক্রমায় তৈরি পোশাকের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁবু, ইলেকট্রনিকস, বাইসাইকেল, ফেব্রিকস, জুতা, ক্রীড়া সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের কারখানা গড়ে উঠেছে। স্থায়ী–অস্থায়ী মিলিয়ে বর্তমানে সিইপিজেডে শ্রমিকসংখ্যা এখন প্রায় দুই লাখ। শুরুর দিকের একতলা কারখানাগুলো এখন সুউচ্চ বহুতল ভবনে পরিণত হয়েছে।
সিইপিজেডের পুরোনো বেশ কয়েকটি কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুর ২০ বছরে সিইপিজেডের চিত্র ছিল ভিন্ন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা অন্য কোনো কিছুর প্রভাব পড়ত না এখানকার শিল্পকারখানায়। তবে সম্প্রতি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও শ্রমিক বিক্ষোভের প্রভাব পড়েছে এখানকার কারখানাগুলোতে।
সিইপিজেডের শুরুর দিকের প্রতিষ্ঠান আলিটা (বাংলাদেশ) লিমিটেড। ১৯৯৪ সালে বাইসাইকেল উৎপাদন শুরু করে মালয়েশিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি। কারখানাটির মহাব্যবস্থাপক এ এইচ এম ফেরদৌস বলেন, আগে বাইরে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার প্রভাব সিইপিজেডের ভেতরে দেখা যেত না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাইরের বড় বড় সব ঘটনার প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে। শুরুতে এখানকার কারখানাগুলো ছোট ও একতলা আধা পাকা ছিল। এখন চিত্র পাল্টে গেছে। এখন অনেক কারখানা ওপরের দিকে বড় হচ্ছে। তাতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে।
একনজরে সিইপিজেড* যাত্রা শুরু- ১৯৮৩
* আয়তন- ৪৫৩ একর
* প্লটের সংখ্যা ৫০১, সব কটিই বরাদ্দ দেওয়া
* কারখানার সংখ্যা ১৪৪
* কর্মসংস্থান- ২ লাখের বেশি
* রপ্তানি- চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ১৮০ কোটি ডলার
উৎপাদনে নতুন চার কারখানা
সিইপিজেড সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে প্যাসিফিক গ্রুপের প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্স, কেবি আউটডোরস, টেকনিক্যাল অ্যাপারেলস ও গুয়াংডং ঢাকা নিটিং নামে চারটি প্রতিষ্ঠান নতুন করে তাদের কারখানা স্থাপন করেছে। আগে সব কটি কারখানা এক বা দোতলা ভবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে সেগুলো চার থেকে আটতলা। নতুন কারখানাগুলোর মধ্যে গত বছর থেকে সীমিত পরিসরে উৎপাদনে গেছে প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্স ও টেকনিক্যাল অ্যাপারেলস। দুটি কারখানাই পোশাক তৈরি করে।
টেকনিক্যাল অ্যাপারেলসে বর্তমানে প্রায় এক হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ বছর পুরোপুরি উৎপাদন শুরু করবে কারখানাটি। এতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়বে সিইপিজেডের।
প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্স এখনো পুরোপুরি উৎপাদনে যায়নি। সিইপিজেডের পাঁচ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত কারখানাটি আগে ছিল একতলা আধা পাকা ঘরে। এখন সেটি ৯ তলা ভবনের কারখানা। ভবনের একটি অংশে উৎপাদন শুরু হয়েছে। ফরমালওয়্যার (কোট, প্যান্ট) তৈরি হচ্ছে সেখানে। ২০২৪ সালে চালু হওয়া এই কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে দুই হাজার শ্রমিকের।
জানতে চাইলে প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিইপিজেডে এখন নতুন করে প্লট বাড়ানোর সুযোগ নেই। আমাদের একটি কারখানার পরিধি আমরা বাড়িয়েছি উচ্চতায়। সেখানে একটি অংশে উৎপাদনও শুরু হয়েছে। উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিও হচ্ছে। আরেকটি অংশ এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চালু হবে।’
এ ছাড়া কেবি আউটডোরস ও গুয়াংডং ঢাকা নিটিংয়ে ২০২৩ সালে উৎপাদন শুরু হয়েছে।
কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বৃদ্ধির আশা
সিইপিজেড কর্তৃপক্ষ নিজেদেরই সাতটি একতলা ভবন ভেঙে প্রতিটি ছয়তলা করেছে। আরও চারটির নির্মাণকাজ চলছে। এর মধ্যে কারখানা, গুদাম ও বাণিজ্যিক ভবনও রয়েছে। এসব ভবনের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়বে কর্মসংস্থানও। সিইপিজেডে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বেপজার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে সিইপিজেডে শ্রমিক ছিলেন ৬২৪ জন। ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ২০ হাজার ৮১৪ জনে। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ৮৫ হাজার ৬৯৮, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ লাখ ৮২ হাজার ৬২১ জন ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৫ হাজার জনে। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়েছে।
কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রপ্তানিও বাড়বে বলে জানিয়েছে সিইপিজেড কর্তৃপক্ষ। সিইপিজেড কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সিইপিজেড থেকে ১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১৮০ কোটি ডলারের সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ধাপে ধাপে তা আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানতে চাইলে সিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুস সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের নির্মিত অন্তত ১০টি ভবন ওপরের দিকে বা উচ্চতায় বড় করা হয়েছে। এসব ভবনে কারখানাও গড়ে উঠছে। এতে কর্মসংস্থানও বাড়বে, রপ্তানিও বাড়বে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমাদের রপ্তানির লক্ষ্য ২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন বা ২৫০ কোটি ডলার। বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছেন।’