জায়গাসংকটে পাশে নয়, উচ্চতায় বড় হচ্ছে সিইপিজেড
Published: 26th, April 2025 GMT
চার দশক আগে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে দেশের প্রথম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড)। গুটি কয়েক কারখানা ও মাত্র ৬২৪ জন শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড)। প্রথম অর্থবছরে (১৯৮৩-৮৪) সিইপিজেড থেকে রপ্তানি আয় আসে ১ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪২ বছর পর এসে সেই সিপিজেডের চিত্র পাল্টেছে।
শুরুতে কারখানা ১০টির কম থাকলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৪টিতে। প্রায় দেড় দশক আগেই চট্টগ্রাম ইপিজেডের সব প্লট শেষ হয়ে গেছে। তারপরও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এখনো আগ্রহের কেন্দ্রে সিইপিজেড। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সেই আগ্রহে বড় হচ্ছে সিইপিজেড। তবে সেটি পাশে নয়, বড় হচ্ছে ওপরের দিকে। অর্থাৎ বাড়ানো হচ্ছে ভবনের উচ্চতা। এতে রপ্তানি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও দেখছে দেশের ইপিজেডগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।
বেপজা বলছে, প্রায় ৪৫৩ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা সিইপিজেডে মোট প্লট ৫০১টি। বর্তমানে সিইপিজেডে প্লটের সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ নেই। তাই কারখানা ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত দুই বছরে একতলা বা দোতলা ভবনের মোট ১০টি কারখানা ভেঙে ওপরের দিকে বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ চার থেকে আটতলা করা হয়েছে।
কারখানার পরিধি বাড়ানোর কারণে সিইপিজেডে শ্রমিকসংখ্যাও বেড়েছে। গত ৯ মাসে সিইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক বেড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। এ সময় চারটি নতুন কারখানা চালু হয়েছে। তবে শুরুতে এমন ছিল না সিপিজেডের চিত্র। শুরুতে তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ছিল বেশি, এখনো তা–ই। তবে সময়ের পরিক্রমায় তৈরি পোশাকের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁবু, ইলেকট্রনিকস, বাইসাইকেল, ফেব্রিকস, জুতা, ক্রীড়া সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের কারখানা গড়ে উঠেছে। স্থায়ী–অস্থায়ী মিলিয়ে বর্তমানে সিইপিজেডে শ্রমিকসংখ্যা এখন প্রায় দুই লাখ। শুরুর দিকের একতলা কারখানাগুলো এখন সুউচ্চ বহুতল ভবনে পরিণত হয়েছে।
সিইপিজেডের পুরোনো বেশ কয়েকটি কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুর ২০ বছরে সিইপিজেডের চিত্র ছিল ভিন্ন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা অন্য কোনো কিছুর প্রভাব পড়ত না এখানকার শিল্পকারখানায়। তবে সম্প্রতি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও শ্রমিক বিক্ষোভের প্রভাব পড়েছে এখানকার কারখানাগুলোতে।
সিইপিজেডের শুরুর দিকের প্রতিষ্ঠান আলিটা (বাংলাদেশ) লিমিটেড। ১৯৯৪ সালে বাইসাইকেল উৎপাদন শুরু করে মালয়েশিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি। কারখানাটির মহাব্যবস্থাপক এ এইচ এম ফেরদৌস বলেন, আগে বাইরে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার প্রভাব সিইপিজেডের ভেতরে দেখা যেত না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাইরের বড় বড় সব ঘটনার প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে। শুরুতে এখানকার কারখানাগুলো ছোট ও একতলা আধা পাকা ছিল। এখন চিত্র পাল্টে গেছে। এখন অনেক কারখানা ওপরের দিকে বড় হচ্ছে। তাতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে।
একনজরে সিইপিজেড* যাত্রা শুরু- ১৯৮৩
* আয়তন- ৪৫৩ একর
* প্লটের সংখ্যা ৫০১, সব কটিই বরাদ্দ দেওয়া
* কারখানার সংখ্যা ১৪৪
* কর্মসংস্থান- ২ লাখের বেশি
* রপ্তানি- চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ১৮০ কোটি ডলার
উৎপাদনে নতুন চার কারখানা
সিইপিজেড সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে প্যাসিফিক গ্রুপের প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্স, কেবি আউটডোরস, টেকনিক্যাল অ্যাপারেলস ও গুয়াংডং ঢাকা নিটিং নামে চারটি প্রতিষ্ঠান নতুন করে তাদের কারখানা স্থাপন করেছে। আগে সব কটি কারখানা এক বা দোতলা ভবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে সেগুলো চার থেকে আটতলা। নতুন কারখানাগুলোর মধ্যে গত বছর থেকে সীমিত পরিসরে উৎপাদনে গেছে প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্স ও টেকনিক্যাল অ্যাপারেলস। দুটি কারখানাই পোশাক তৈরি করে।
টেকনিক্যাল অ্যাপারেলসে বর্তমানে প্রায় এক হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ বছর পুরোপুরি উৎপাদন শুরু করবে কারখানাটি। এতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়বে সিইপিজেডের।
প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্স এখনো পুরোপুরি উৎপাদনে যায়নি। সিইপিজেডের পাঁচ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত কারখানাটি আগে ছিল একতলা আধা পাকা ঘরে। এখন সেটি ৯ তলা ভবনের কারখানা। ভবনের একটি অংশে উৎপাদন শুরু হয়েছে। ফরমালওয়্যার (কোট, প্যান্ট) তৈরি হচ্ছে সেখানে। ২০২৪ সালে চালু হওয়া এই কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে দুই হাজার শ্রমিকের।
জানতে চাইলে প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিইপিজেডে এখন নতুন করে প্লট বাড়ানোর সুযোগ নেই। আমাদের একটি কারখানার পরিধি আমরা বাড়িয়েছি উচ্চতায়। সেখানে একটি অংশে উৎপাদনও শুরু হয়েছে। উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিও হচ্ছে। আরেকটি অংশ এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চালু হবে।’
এ ছাড়া কেবি আউটডোরস ও গুয়াংডং ঢাকা নিটিংয়ে ২০২৩ সালে উৎপাদন শুরু হয়েছে।
কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বৃদ্ধির আশা
সিইপিজেড কর্তৃপক্ষ নিজেদেরই সাতটি একতলা ভবন ভেঙে প্রতিটি ছয়তলা করেছে। আরও চারটির নির্মাণকাজ চলছে। এর মধ্যে কারখানা, গুদাম ও বাণিজ্যিক ভবনও রয়েছে। এসব ভবনের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়বে কর্মসংস্থানও। সিইপিজেডে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বেপজার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে সিইপিজেডে শ্রমিক ছিলেন ৬২৪ জন। ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ২০ হাজার ৮১৪ জনে। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ৮৫ হাজার ৬৯৮, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ লাখ ৮২ হাজার ৬২১ জন ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৫ হাজার জনে। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়েছে।
কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রপ্তানিও বাড়বে বলে জানিয়েছে সিইপিজেড কর্তৃপক্ষ। সিইপিজেড কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সিইপিজেড থেকে ১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১৮০ কোটি ডলারের সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ধাপে ধাপে তা আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানতে চাইলে সিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মো.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ওপর র দ ক নত ন ক উৎপ দ ভবন র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশে ভোটের সময় নিয়ে উত্তেজনা বাড়তে পারে
সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতানৈক্য; তাতে রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে এখনও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। এসব কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ব্যাহত হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে নির্বাচন এবং রাজনীতি নিয়ে শঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
গত বুধবার ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। নীতিগত অনিশ্চয়তা ও উচ্চ সুদের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগে তেমন গতি আসার সম্ভাবনা নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে রাজনীতি প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ধীরগতি ও মূল্যস্ফীতির চাপ অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে। এতে আরও বলা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানোসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অনেকগুলো কমিশন, কমিটি ও টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে। প্রস্তাবিত অনেক সংস্কার এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এখনও তেমন উন্নতি হয়নি। এ বছরের ডিসেম্বর এবং আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের ঘোষণার পরও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংক মনে করে, কিছু কিছু খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার করতে হবে। সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, সরকারি ও করপোরেট খাতে সুশাসন আরও সুসংহত করা। তৃতীয়ত, দেশে উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের যে চাহিদা, তা মেটাতে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বিকল্প নেই।
তারা মনে করছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এই রাজস্ব দিয়ে দেশের প্রয়োজনীয় উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। চতুর্থত, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা নিয়ে কথা বলেছে বিশ্বব্যাংক। তারা বলেছে, দেশে আর্থিক খাত যেভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে, তাতে জরুরি ভিত্তিতে এই খাতের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা দরকার।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর এই বাণিজ্যনীতির প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেমন একটা পড়বে না। আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পুরোপুরি অনুভূত হবে। সংস্থাটি বলেছে, প্রভাব ঠিক কতটা পড়বে, তা এখনই সুনির্দিষ্ট হয়ে বলা যাবে না। কারণ, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ও নীতি ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। সেই অনিশ্চয়তা মাথায় রেখেও তাদের হিসাব, বৈশ্বিক এই বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি ও প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ১ দশমিক ৭ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে কমবে।