পেছনে তাকাতেই দেখি কিলিয়ান এমবাপ্পে
Published: 26th, April 2025 GMT
ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিকেএসপিতে (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) পড়াশোনা করেছি। একসময় জাতীয় দলে খেলার সুযোগও হলো। কিন্তু জাতীয় দলের ছোট্ট ক্যারিয়ারে বিশ্বখ্যাত কোনো স্টেডিয়ামে নিজে খেলা বা অন্য দলের খেলা দেখার সুযোগ হয়নি।
তারপর তো একসময় ক্রীড়া সাংবাদিকতা শুরু করলাম। বর্তমানে ফুটবল ক্লাব ফর্টিস এফসি লিমিটেডের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছি। ক্লাবের হয়েই হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে আছি। এখানে অলিম্পিক সলিডারিটির স্কলারশিপ নিয়ে আন্তর্জাতিক কোচিং কোর্স করছি। এর মধ্যেই ১৮ থেকে ২১ এপ্রিল টানা ছুটি পেলাম। এই সুযোগে কোর্সমেটরা বিভিন্ন দেশে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ল। আমার ইচ্ছা অন্য, বড় পরিসরে কোনো ফুটবল ম্যাচ দেখব।
সাংবাদিকতা করার সময় ক্রীড়া তারকাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছা হতো। কখনো সফলও হয়েছি, কখনো ব্যর্থ। তবে কাজটা করতে গিয়ে দেশ-বিদেশে একটা যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। এখনো ফুটবল অঙ্গনের অনেকের সঙ্গেই যুক্ত আছি। সেই পরিচয়ের সুত্রেই রিয়াল মাদ্রিদের এক কর্তার কাছে স্পেনের সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ম্যাচ দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। আন্তরিকতার সঙ্গেই তিনি কিছু তথ্যের সঙ্গে আমার ক্লাবের নাম ও পদবি জেনে নিলেন। তাঁর পক্ষ থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বার্নাব্যুতে স্বাগতও জানালেন।
তারপর আর সেই কর্তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। ১৬ এপ্রিল টিভিতে রিয়াল মাদ্রিদ বনাম আর্সেনালের ম্যাচ শুরুর অপেক্ষায় আছি। এমন সময় রিয়াল মাদ্রিদের অফিশিয়াল মেইল। তারা আমাকে ২১ এপ্রিলের রিয়াল মাদ্রিদ বনাম অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের ম্যাচটির পাস পাঠিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাবের সভাপতি শাহিন হাসানকে অবগত করে নিশ্চিত করলাম বিমানের টিকিট।
উত্তেজনায় নির্ধারিত দিন চার ঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেলাম স্টেডিয়ামে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে গিয়ে বুঝলাম, আমার চেয়েও বেশি উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সমর্থকেরা। খেলা শুরুর দেড় ঘণ্টা আগেই মাঠে ঢোকার সুযোগ হলো। চোখের সামনে মখমলের মতো সবুজ ঘাসের মাঠ আর থাকে থাকে সাজানো গ্যালারি দেখে মনে হচ্ছিল অষ্টমাশ্চর্য!
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর গ্যালারিতে লেখক.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ টবল
এছাড়াও পড়ুন:
হামাস যেভাবে ইসরায়েলের ‘অপরাজেয়তার মিথ’ ভেঙে দিল
ইসরায়েল ভয়াবহ মাত্রায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ভয়াবহতা শুধু গাজা নয়, পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর, এমনকি ইসরায়েলের ভেতরে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের জীবনের সঙ্গে হামাসের ভবিষ্যৎকে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছে। আজ হামাস আত্মসমর্পণ করলে অনেকের চোখে তা পুরো ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার পরাজয় বলে বিবেচিত হবে।
গাজার বর্তমান অবস্থা এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। একে কেউ কেউ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খোলা বন্দিশিবির বলছেন, কেউ বলছেন হত্যাক্ষেত্র। অথচ এর এক ঘণ্টার দূরত্বে তেল আবিব। তেল আবিবের অনেক বাসিন্দা নিশ্চিন্তে আরামে জীবন কাটাচ্ছেন, যেন কিছুই ঘটছে না।
তবে এক বিষয় তাঁরা বোঝেন না, হামাস আত্মসমর্পণ করবে না।
যে কেউ ভেবে নিচ্ছেন, হামাসের নেতারা অর্থ নিয়ে পালিয়ে যাবেন। যেমন একসময় ফাতাহ করেছিল। তাদের এ ভাবনা প্রমাণ করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাঁর প্রতিপক্ষকে কতটা ভুলভাবে বুঝেছেন। ১৮ মাসের যুদ্ধে, দুই মাসের অবরোধে ক্ষুধার যন্ত্রণায় নিপতিত এক জনগোষ্ঠীকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যা কার্যত আত্মসমর্পণের সমান। প্রস্তাব ছিল, সব বন্দী মুক্তির বিনিময়ে দেওয়া হবে ৪৫ দিনের খাবার ও পানি। আর হামাসকে নিরস্ত্র হতে হবে।
আরও পড়ুনইসরায়েলের জঘন্য মিথ্যাচার ও হামাসের বিজয় অর্জন২৮ জানুয়ারি ২০২৫হামাস পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছিল, বন্দী মুক্তির বদলে কিছু ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তি দিতে হবে, করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি, গাজা শাসনের ভার অন্য দলকে দিতে হবে। কিন্তু দুটি শর্তে হামাস এখনো অটল—তারা নিরস্ত্র হবে না ও ইসরায়েলি বাহিনীর গাজা পুরোপুরি ছাড়তে হবে।
এ অচলাবস্থার প্রধান কারণ নেতানিয়াহু নিজেই। আর আগে দুবার হামাসের সঙ্গে চুক্তি করে নিজেই তিনি তা ভেঙেছেন। জানুয়ারির এক চুক্তিতে যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৩৩ বন্দীর মুক্তি ঘটেছিল। এরপর আরও আলোচনার কথা ছিল, কিন্তু নেতানিয়াহু সে আলোচনায় কোনো গরজ দেখাননি। তাঁদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও তাতে কোনো বাধা দেয়নি।
এই যে নেতানিয়াহুর এমন ঔদ্ধত্য আচরণ, এর কারণ কিন্তু সামরিক নয়; বরং রাজনৈতিক। ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর যে রাজনৈতিক জোটের সরকার, তা রক্ষা করতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ছিল। এ পরিস্থিতিতে মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়ে খাদ্যগুদামও বোমায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল। ক্ষুধাকেই যেন অস্ত্র বানানো হয়েছে। অথচ এর মধ্যেও হামাস প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
আফগানিস্তানে তালেবান কিংবা ইরাকে প্রতিরোধ আন্দোলন বড় শক্তিগুলোকেও দেশ থেকে তাড়িয়েছিল। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ইসরায়েলের মতো ছোট দেশ গাজায় ‘চিরন্তন যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়া কতটা সম্ভব?যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি অ্যাডাম বোয়েলারও জানিয়েছেন, সব বন্দী মুক্তি দিলে যুদ্ধ থেমে যেতে পারে। কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নিজেই সে পথে বাধা। এমনকি সিআইএর প্রধান বিল বার্নসের মধ্যস্থতায় একসময় হামাস চুক্তিতে সই করেছিল; কিন্তু নেতানিয়াহু সেখান থেকেও সরে আসেন।
একটা কারণ মানবিক বিপর্যয় নিজেই। গাজায় গত ৭ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভাঙার পর থেকে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হামাসের নেতারা নিহত হয়েছেন। প্রশাসন, হাসপাতাল, স্কুল—সবকিছু ধ্বংস হয়েছে। রাফা শহরও এখন ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু অর্থের প্রলোভনেও ফিলিস্তিনিরা গাজা ছাড়ছেন না।
একসময় পিএলওর নেতা ইয়াসির আরাফাত বা ফাতাহ, অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে নির্বাসনে চলে যেতেন, কিন্তু হামাসের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। কারণ কী?
ইসরায়েলি বর্বরতায় গাজা ধ্বংস হয়ে গিয়ে পুরো ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার একটি পবিত্র প্রতীক হয়ে গেছে। আজ আর হামাস আলাদা কোনো সংগঠন নয়। তারা সেই জনগণের অংশ, যাঁদের প্রত্যেকে এক বা একাধিক প্রিয়জন হারিয়েছেন। সেই অর্থে এ প্রতিরোধও একটি জাতিগত সংকল্প।
আর এ প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় কারণ ইসরায়েল নিজেই। যে ইসরায়েল রাষ্ট্র কখনো থামে না, আরও জমি চায়, অন্য ধর্ম ও জনগণের অস্তিত্ব মুছে দিতে চায়। খ্রিষ্টান, মুসলিম—সবাই এখন নিপীড়নের শিকার। শান্তিকালে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বেড়েছে—ওসলো চুক্তির পরও থামেনি। ইসরায়েল নামের রাষ্ট্রটি কোনো সময়ই দুই রাষ্ট্র সমাধানে আগ্রহী ছিল না।
এখন যাঁরা ক্ষমতায়—নেতানিয়াহু, ইতামার বেন গাভির, বেজালেল স্মোত্রিচ—তাঁরা মূলত ডেভিড বেন গুরিয়নের অসমাপ্ত কাজ শেষ করছেন। সেই কাজ হলো ‘ইসরায়েলের ভূমি’ থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়া। ইসরায়েলের ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মভিত্তিক—সব পক্ষই যেন এ লক্ষ্যে একমত।
সম্প্রতি আল-আকসা মসজিদে রেকর্ডসংখ্যক ইহুদিকে প্রার্থনার করবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। ইসরায়েল রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান এক হয়ে ফিলিস্তিনকে নির্মূল করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
এ প্রেক্ষাপটে হামাস যদি আত্মসমর্পণ করে, তাহলে ফিলিস্তিনিদের কাছে তা হবে তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে পরাজিত হওয়া। কারণ ধর্মীয় নয়, কৌশলগতভাবেই হামাস এখন প্রতিরোধের একমাত্র বাস্তব পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হামাস ফাতাহর মতো নয়। এ সংঘাত শুরু হয়েছিল আল-আকসায় ইহুদি উপদ্রব নিয়ে। গাজার অনেক মানুষ হামাসের সদস্য না হয়েও এ নির্মমতার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ধর্মের মধ্যেই সান্ত্বনা খুঁজছেন। যেমন ২৩ বছর বয়সী প্যারামেডিক রিফাত রাদওয়ান। তিনি মারা যাওয়ার আগে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইছিলেন, তিনি নিয়মিত নামাজ আদায় না করায় অনুতপ্ত ছিলেন। শেষ মুহূর্তে বিশ্বাসটাই ছিল তাঁর শেষ আশ্রয়।
তবে আত্মসমর্পণ না করার আরেকটি কারণ আছে। আর তা হলো হামাস তাদের লক্ষ্য ইতোমধ্যে কিছুটা অর্জন করেছে বলে মনে করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার দাবি বিশ্বমঞ্চে আবার জোরালোভাবে তুলে ধরা।
সেই অর্থে আন্তর্জাতিক পরিসরে হামাস যেন সত্যিই ছাপ ফেলতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আজ ৫৩ শতাংশ মানুষ ইসরায়েলের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। মাত্র কিছুদিন আগেও এ সংখ্যা ছিল অনেক কম।
পশ্চিমা আইন হয়তো হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু অনেক সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিরোধকারী হিসেবে দেখছেন। তাঁরা হয়তো হামাসের হামলাকে অন্যায় ভাবছেন। কিন্তু ইসরায়েলকেও আর সমর্থন করতে পারছেন না।
এ যুদ্ধ ইসরায়েল বলপ্রয়োগে চিরতরে শেষ করতে চায়। এর মানে, এ যুদ্ধ এখন প্রত্যেক ফিলিস্তিনির আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে উঠেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একাধিক জটিল মধ্যস্থতা করতে ব্যস্ত। যেমন গাজা, ইরান আর সৌদি-ইসরায়েল সমঝোতা। কিন্তু এর একটিও সহজ নয়। একদিকে চলছে ইরানে হামলার প্রস্তুতির গুঞ্জন। অন্যদিকে গাজা থেকে জনগণকে স্থানান্তরের পরিকল্পনায় প্রতিবেশীরা একমত নয়। মিসর আর ইসরায়েল, এমনকি সিনাই নিয়ে খোলাখুলি দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে।
আফগানিস্তানে তালেবান কিংবা ইরাকে প্রতিরোধ আন্দোলন বড় শক্তিগুলোকেও দেশ থেকে তাড়িয়েছিল। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ইসরায়েলের মতো ছোট দেশ গাজায় ‘চিরন্তন যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়া কতটা সম্ভব? তাই নেতানিয়াহুকে দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলের ‘অপরাজেয়তার মিথ’ ভেঙে গেছে। সেই ভাঙন আর জোড়া দেওয়া সম্ভব নয়। এখন সময়, পরাজয়ের আগেই নিজ থেকে সরে দাঁড়ানোর।
ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আই-র সম্পাদক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ