ম্যালেরিয়া লইয়া উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অদ্যাবধি দূরীভূত হইল না। শুক্রবার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ১৩ জেলায় প্রাণঘাতী এই রোগটির আধিক্য বর্তমান। তন্মধ্যে বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায় আক্রান্ত ৮৮ শতাংশের অধিবাস। দেশে গত বৎসর ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয় ১৩ সহস্রাধিক জনের। তন্মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উক্ত দুই জেলায় শনাক্ত হয় সাড়ে ১১ সহস্র রোগী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুসারে, ২০২৩ সালে ম্যালেরিয়ায় ছয়জনের মৃত্যু হয়। শনাক্ত হয় ১৬ সহস্র ৬৭৭ রোগী। এই হিসাবে গত বৎসর রোগীর সংখ্যা হ্রাস পাইয়াছে ২০ শতাংশের কিঞ্চিদধিক। তবে ইহাতে আশ্বস্ত হইবার কিছু নাই। কারণ, অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০২১ সালে ম্যালেরিয়ায় শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৭ সহস্রাধিক এবং এ রোগে মৃত্যুবরণ করে ৯ জন। ২০২২ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা রীতিমতো লম্ফ দিয়া ১৮ সহস্রাধিকে উপনীত; মৃত্যুবরণ করে ১৪ জন। সান্ত্বনার বিষয়, ৮৮ শতাংশ ম্যালেরিয়া রোগী দুই জেলার। অর্থাৎ রোগটি নির্দিষ্ট এলাকায় আবদ্ধ, যে কোনো সংক্রামক রোগ নির্মূলের জন্য যাহা অত্যন্ত সহায়ক। তৎসহিত এই প্রশ্নও উত্থাপন করা যায়, এতৎসত্ত্বেও রোগটি নির্মূল করা যাইতেছে না কেন? আমরা জানি, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব হইতে ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করিতেছে। বাংলাদেশে একই লক্ষ্য অর্জনের অঙ্গীকার করিয়াছে ২০৩০ সালের মধ্যে। বিগত সময়ের অনুরূপ ধারায় কার্যক্রম চলিলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন দুরূহ হইবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলিতেছে, যে ১৩ জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাধান্য, সেই জেলাগুলি হয় পার্বত্যাঞ্চলে অথবা সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত। ইহাও সত্য, পার্বত্যাঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি এবং তথাকার অধিবাসীদের জীবনযাত্রার বিশেষ ধরনের কারণে রোগ নির্মূলে সমতল অঞ্চলের কার্যবিধি তথায় প্রযোজ্য নয়। সীমান্তের দুই পারের মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণে শৈথিল্য থাকায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলসমূহেও রোগ নিয়ন্ত্রণবিধি প্রত্যাশা অনুযায়ী কার্যকর হয় না। তবে পার্বত্য ও সীমান্ত অঞ্চলে সাধারণত দরিদ্র মানুষের বসবাস অধিক হইবার কারণে উহারা চাহিদানুযায়ী সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাসমূহের বিশেষ মনোযোগ পাইতেছে কিনা, উহাও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
ম্যালেরিয়া নির্মূলে পার্বত্য ও সীমান্ত অঞ্চলের গ্রামগুলির দিকে বিশেষ দৃষ্টিদান প্রয়োজন এই কারণে, রোগটি যে কোনো সময় আপাত-নিরাপদ অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হইতে পারে। ইহা সর্বজনবিদিত, দেশে মশকবাহিত রোগের মধ্যে ম্যালেরিয়া অন্যতম। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশক এই রোগের জীবাণু ছড়ায়। বাংলাদেশে মোট ৩৬ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশক দেখা যায়, যেগুলির মধ্যে সাতটি প্রজাতি ম্যালেরিয়ার বিস্তারে বিশেষ পটু। বিশেষজ্ঞদের মতে, ম্যালেরিয়ার এমনও ধরন রহিয়াছে, যাহার কারণে শরীরে তীব্র রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হয়। কিডনি, লিভার, ফুসফুস অকার্যকর হইয়া পড়ে। গুরুতর পর্যায়ে অচেতন হইয়া মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়ে রোগী। প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স নামক জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তির বারবার ম্যালেরিয়া হইতে পারে। এমনকি ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চল হইতে নিরাপদ অঞ্চলে প্রত্যাবর্তনের দীর্ঘকাল পরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হইবার শঙ্কা থাকিয়া যায়। বলা হইতে পারে, বিজ্ঞানের কল্যাণে ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিকার এখন দুরূহ নহে। অস্বীকার করা যাইবে না, কোনো ম্যালেরিয়ার ঔষধ বহু দেশেই অকার্যকর হইয়া পড়িয়াছে, যদ্রূপ আমাদের দেশেও অতি ও অপরিকল্পিত ব্যবহারের কারণে কোনো জীবন রক্ষাকারী ঔষধ একই পরিণতি বরণ করিয়াছে। এহেন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘাতক ব্যাধি যক্ষ্মার ক্ষেত্রে ঘটিয়াছে; ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রেও ঘটা অসম্ভব নহে। আর যে কোনো রোগের ক্ষেত্রে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধই উত্তম– কে না জানে!
ম্যালেরিয়া সহজেই প্রতিরোধযোগ্য রোগ। মশকের কামড় হইতে মুক্ত থাকিলেই এই রোগে আক্রান্ত হইবার ঝুঁকি হ্রাস পায়। এতদ্বিষয়ে সরকারের যদ্রূপ দায়িত্ব রহিয়াছে, তদ্রূপ জনসচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ঔষধ এবং টিকা ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চলে সহজলভ্য করাও জরুরি বলিয়া আমরা মনে করি।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নিছক বায়বীয় নহে
রাজধানী ঢাকা যথা বিশ্বের শহরগুলির তালিকায় প্রায়শ বায়ুদূষণের শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করিয়া থাকে, তথায় নির্মল বায়ুপ্রাপ্তি সহজলভ্য নহে। ঢাকাবাসীর জন্য এই নির্মল বায়ু কতটা বিরল, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানই উহার প্রমাণ। ঢাকায় গত ৯ বৎসরে মানুষ মাত্র ৩১ দিবস নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করিয়াছে।
বায়ুর এহেন অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে নগরবাসীর জীবনযাপন কতটা নাজুক, বলিবার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত ঢাকার বায়ুদূষণ এমন ‘অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে উপনীত, উহা প্রায় প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমের ‘খবর’রূপে উপস্থাপিত হয়। বিশ্বের অপরাপর শহরের তুলনায় বায়ুদূষণ অধিক হইবার কারণে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের সূচকে কদাচ সর্বাপেক্ষা দূষিত নগরীর মধ্যে শীর্ষস্থানও দখল করিয়া থাকে ঢাকা। কলকারখানার ধোঁয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, নির্মাণকার্য, সড়ক খনন, বর্জ্য দহন ইত্যাদি কারণে বায়ু দূষিত হয়। এতদ্ব্যতীত মানবসৃষ্ট বিবিধ কারণও স্পষ্ট। এমনকি খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনে যে ব্যাপকভাবে বায়ু দূষিত হইয়া থাকে, উক্ত চিত্রও আমরা প্রত্যক্ষ করি নিয়মিত।
৯ বৎসরের তথ্য বিশ্লেষণ করিয়াছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র-ক্যাপস। সংস্থাটি ঢাকার মার্কিন দূতাবাস হইতে প্রাপ্ত ২০১৬ হইতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার বায়ুমানের সূচক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করিয়া জানাইয়াছে, দেশে প্রতি বৎসর বায়ুদূষণ পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পাইয়াছে। ৩ সহস্র ১১৪ দিবসের মধ্যে মাত্র ৩১ দিবস তথা মাত্র ১ শতাংশ দিবসে নির্মল বায়ু নগরবাসী সেবন করিয়াছে। দূষিত বায়ুর সহিত রাজধানীবাসীর বসবাসের কারণে উহা নীরব ঘাতকরূপে অবতীর্ণ হইয়াছে। কিন্তু হতাশাজনক হইলেও সত্য, দূষণ রোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে কর্তৃপক্ষের তৎপরতা দৃশ্যমান নহে।
ঢাকার বিষাক্ত বায়ুর প্রভাবে অকালমৃত্যু ও মানুষের রোগব্যাধি বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ বিবিধ সতর্কবার্তা প্রকাশ করিয়া আসিতেছেন। বায়দূষণের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, হাঁপানির ন্যায় তীব্র শ্বাসকষ্টের রোগীদের অধিক সংখ্যায় হাসপাতালে উপস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ করিতেছি। দীর্ঘ মেয়াদে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর বায়ুদূষণের প্রভাব ভয়ংকররূপে প্রতিভাত।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনুপযুক্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ করিয়া বৈদ্যুতিক ও সংকরায়িত যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি, তৎসহিত ইষ্টক দগ্ধীকরণের পরিবর্তে পরিবেশসম্মত ইষ্টক উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। বর্জ্য দহনের ফলে সৃষ্ট বায়ুদূষণ বন্ধে বর্জ্য হইতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যাইতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পকারখানায় বিশ্বমানের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নিঃসরণ মান নির্ধারণ এবং উহার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি নির্মল বায়ু আইন প্রণয়ন জরুরি।
বলিবার অপেক্ষা রাখে না, বায়ুদূষণ নিছক বায়বীয় নহে; উহা মোকাবিলায় দূষণের সকল উৎসে দৃষ্টিপাত করিতে হইবে। শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গঠন এবং জলাশয় বৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। রাজধানীর খালগুলি যেমন অবৈধ দখলে জীর্ণ, উহার সহিত নদীগুলিও দখল-দূষণে শীর্ণ। স্বস্তির বিষয়, ঢাকার দুইটি সিটি করপোরেশন রাজধানীর খালসমূহ সংস্কারে কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছে। উক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়িত হইলে উহা বায়ুমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখিবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।
ঢাকা এমনিতেই নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। বায়ু, পানি, শব্দ– সকল দিক হইতে পরিবেশদূষণের আয়োজন হেথায় বিদ্যমান। মানবস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় এই সকল দূষণ প্রতিরোধে প্রশাসনকে পরিকল্পিত পদক্ষেপ লইতেই হবে।
ঢাকার উপর চাপ হ্রাসকল্পে ঢাকামুখী জনস্রোত যদ্রূপ বন্ধ করিতে হইবে, তদ্রূপ দীর্ঘ মেয়াদে রাজধানীর বিকেন্দ্রীকরণেরও বিকল্প নাই। আমরা চাহি, বায়ুদূষণরোধে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করুক, যাহা আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করিতে অতীব জরুরি।