কাশ্মিরে সন্ত্রাসী হামলায় স্বামীহারা নারীকে নিয়ে চলছে এখন রাজনীতি
Published: 25th, April 2025 GMT
মাত্র তিন দিন আগে জম্মু-কাশ্মিরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় স্বামী বিতান অধিকারীকে হারিয়েছেন স্ত্রী সোহিনী অধিকারী। গত বুধবার প্রশাসনের চেষ্টায় তিন বছরের ছেলে হৃদানকে নিয়ে কলকাতায় ফেরেন তিনি। কিন্তু তার পর থেকেই সদ্য বিধবাকে ঘিরে শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। তাতে বাদ যায়নি রাজনীতিও।
‘বৌমা’ অর্থাৎ সোহিনীকে ‘বাংলাদেশি’ বলে দাবি করেছে বিতানের পরিবার। যদিও সোহিনীর ভাইয়ের দাবি, তার বোনকে নিয়ে যে সব অভিযোগ করা হচ্ছে, তার সবই মিথ্যা।
গত বুধবার সন্ধ্যায় কলকাতা বিমানবন্দরে সোহিনীরা নামার পরে রাজ্য সরকারের পক্ষে মন্ত্রী, বিধায়কেরা যেমন গিয়েছিলেন, তেমনই সেখানে উপস্থিত হন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং তার কয়েক জন রাজনৈতিক সঙ্গী। শুভেন্দুকে সোহিনী জানান, হিন্দু বলে তার স্বামীকে গুলি করে মেরেছে সন্ত্রাসীরা এবং তিনি শুভেন্দুর ভরসায় কলকাতায় এসেছেন।
পরের দিন, বৃহস্পতিবার সোহিনীর সঙ্গে দেখা করতে তার পাটুলির বাড়িতে যান শুভেন্দু, অগ্নিমিত্রা পালরা।
শুভেন্দু জানান, প্রায় আধ ঘণ্টা সোহিনীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তবে সেগুলো জনসমক্ষে বলা যাবে না এবং তারা সোহিনীর পাশে আছেন।
বৃহস্পতিবার নিহত বিতানের ভাই বিভু দাবি করেছেন, তার ভ্রাতৃবধূ আদতে ভারতের নাগরিকই নন!
পেশায় আইনজীবী বিভুর মন্তব্য, ‘তার (সোহিনীর) পরিচয় দিতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে।” এমনকি, ভ্রাতৃবধূকে ‘ইন্টারন্যাশনাল জালিয়াত’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
বিভু জানান, বছর দুয়েক আগে সোহিনী এবং তার মা ভারতী রায়ের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছিল। সেই মামলা এখনো চলছে। ভারতী বাংলাদেশ চলে গেছেন। তবে এ দেশে থেকে যান তার মেয়ে।
বিভুর আরো দাবি, পরিচয় গোপন করে তার ভাই, পেশায় আইটি কর্মী বিতানকে বিয়ে করেছিলেন সোহিনী।
তিনি বলেন, “সোহিনীর দুটো জন্ম সনদ রয়েছে। উনি আদতে বাংলাদেশের নাগরিক। পরে তারা এ দেশের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ইত্যাদি বানিয়েছিলেন। অবশ্য পরে প্রমাণ হয়েছে, সেগুলো ভুয়া।”
বিতানের পরিবারের দাবি, সোহিনী যেখানে থাকেন সেই বাড়ির ‘অবৈধ মালিক’ তিনি। কারণ, ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে তার মা ওই বাড়িটি কেনেন। পরে সেটি মেয়েকে উপহার দেন।
ভাইয়ের মৃত্যুতে সরকার আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিলে সেটা স্ত্রী হিসাবে সোহিনীর পাওয়ার আইনি অধিকার নেই বলে মনে করেন বিভু।
তার ভাষ্য, “তার তো ভারতে থাকার কথাই নয়। আইনগতভাবে দেখলে কোনো ক্ষতিপূরণ তার পাওয়ার কথা নয়। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলে সেটা আমাদের বাবা-মায়ের পাওয়া উচিত।”
ঢাকা/শাহেদ
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
স্মৃতি ও শ্রদ্ধার অনন্য আয়োজন
তাঁর শারীরিক উপস্থিতি ছিল না অনুষ্ঠানে। তবে তাঁর উপস্থিতি ছিল আরও ব্যাপক বিপুল বিস্তারে। ‘নতুন করে পাব বলে’ নামে অনুষ্ঠান হলো তাঁকে স্মরণ করে, তাঁরই হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ছায়ানট মিলনায়তনে। তিনি সন্জীদা খাতুন। বাংলাদেশের সংস্কৃতির অন্যতম বিনির্মাতা, সংগীতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সংগঠক সন্জীদা খাতুনকে স্মরণ করে যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ছায়ানট, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, নালন্দা উচ্চবিদ্যালয়, কণ্ঠশীলন ও ব্রতচারী।
গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে’ সম্মেলক কণ্ঠে গানের সঙ্গে সমবেত নৃত্যের পরিবেশনা দিয়ে। মঞ্চ সাজানো হয়েছিল অনাড়ম্বর, কিন্তু শুচিস্নিগ্ধ সজ্জায়। সবুজ গাছ আর ফুল দিয়ে। মঞ্চের নেপথ্যে বড় ডিজিটাল পর্দায় একের পর এক হচ্ছিল পরিস্ফুটিত সন্জীদা খাতুনের তারুণ্যের কাল থেকে বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবির পর ছবি।
সংগীতজ্ঞের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজনে গান তো থাকবেই। সেই সঙ্গে আরও ছিল তাঁর না থাকার শূন্যতার বোধ, তিনি যে চেতনার আলো জ্বালিয়ে গেলেন, তা প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয়। তাঁর জীবনী আলোচনা, তাঁর নিজের লেখা থেকে পাঠ, তাঁর নিজের গাওয়া গান, স্মৃতিচারণা, কবিতা আবৃত্তি, গীতি-আলেখ্যর সমন্বয়ে সাজানো টানা তিন ঘণ্টার অনুপম পরিবেশনা। সন্জীদা খাতুন তাঁর জীবিতকালে ছায়ানটের অনুষ্ঠানগুলো বরাবরই ত্রুটিহীন ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করার রীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতা থাকল তাঁর অনুপস্থিতিতেও। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা থেকে পরিবেশনা অবধি, যাঁরাই যে কাজে ছিলেন সবাই যেন নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন এই অনুষ্ঠানে।
প্রথম পরিবেশনার পর ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী বললেন, ‘আমরা যেন এক মহিরুহের ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়েছি। সংস্কৃতির মধ্যমে সর্বজনের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণের অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি। সেই কাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।’ সব বাধা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে সন্জীদা খাতুনের দেখিয়ে যাওয়া পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানালেন তিনি।
এরপর সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত হলো ‘পান্থ তুমি পান্থ জনের সখা হে’। সন্জীদা খাতুনের জীবনী তুলে ধরেন জয়ন্ত রায়। এরপর মঞ্চ আঁধার করে নেপথ্যে সন্জীদা খাতুনের ছবি রেখে পরিবেশন করা হলো তাঁর রেকর্ড করা গান ‘এখনো গেল না আঁধার’। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ে শোনালেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করে সন্জীদা খাতুনের লেখা ‘একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে’।
ছায়ানটের উপদেষ্টা মফিদুল হক আলোচনা করলেন সন্জীদা খাতুনের বহুমাত্রিক জীবন ও কর্ম নিয়ে। তিনি বললেন, শিক্ষা, গবেষণা, সংগঠন পরিচালনাসহ বহুবিধ কাজে সন্জীদা খাতুন আত্মনিয়োগ করলেও গান নিয়েই মূলত তিনি পথ চলেছেন। গানের ভেতর দিয়েই সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করেছেন। মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন মঙ্গলের চেতনা। ষাটের দশকে আইয়ুব খানের কঠিন সামরিক শাসনের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করেছেন তিন দিনের অনুষ্ঠান করে। সেই সূত্রে ছায়ানট ও পরে রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখে নববর্ষের অনুষ্ঠান। বাঙালি সংস্কৃতির জাগরণে তাঁর ভূমিকা অম্লান থেকে যাবে।
আলোচনার পর তানিয়া মান্নান গেয়েছেন ‘মালা হতে খসে পড়া’। কণ্ঠশীলনের জহিরুল হক আবৃত্তি করেন ‘পুরস্কার’ কবিতার অংশবিশেষ। এভাবেই একক ও সম্মেলক গান, ব্রতচারীর গান, আবৃত্তি পাঠ, স্মৃতিচারণার পরিবেশনা দিয়ে এগিয়েছে অনুষ্ঠান।
নালন্দার শিক্ষার্থীরা পরিবেশন করেছে সন্জীদা খাতুনের প্রবন্ধ অবলম্বে গীতি-আলেখ্য ‘সবারে বাস রে ভালো’। ত্রপা মজুমদার পড়েছেন মুক্তিযুদ্ধকালের স্মৃতিচারণা করে সন্জীদা খাতুনের লেখা, তাঁর সংস্কৃতি ভাবনা নিয়ে প্রবন্ধ পড়েছেন সুমনা বিশ্বাস। স্মৃতিচারণা ও গান করেছেন লিলি ইসলাম। একক গান পরিবেশন করেছেন রোকাইয়া হাসিনা নীলি, মহিউজ্জামান চৌধুরী, খায়রুল আনাম শাকিল, ইফফাত আরা দেওয়ান, শারমিন সাথী ইসলাম, প্রমীলা ভট্টাচার্য, এ টি এম জাহাঙ্গীর, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বুলবুল ইসলাম ও লাইসা আহমদ লিসা।
সম্মেলক কণ্ঠে ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে’ গানটির পর জাতীয় সংগীত দিয়ে শেষ হয়েছিল স্মৃতি ও শ্রদ্ধার এই অনন্য আয়োজন।