চট্টগ্রামে অটোরিকশায় পেট্রলবোমায় দগ্ধ সেই নারীর মৃত্যু
Published: 25th, April 2025 GMT
চট্টগ্রামে চলন্ত একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় দুর্বৃত্তদের ছুড়ে মারা পেট্রলবোমায় দগ্ধ সেই নারীর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর নাম লায়লা বেগম (৫০)। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে রাউজান পৌরসভা এলাকার গ্রামের বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়। লায়লার শ্বাসনালিসহ শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে যায়।
লায়লার স্বামী মো. আব্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় অবস্থার অবনতি হলে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। কারা তাঁর স্ত্রীকে পেট্রলবোমা মেরেছে তাদের বিচার চান তিনি।
২০ এপ্রিল ভোর সাড়ে চারটার দিকে নগরের মুরাদপুর-অক্সিজেন সড়কের আতুরার ডিপোর তিন রাস্তার মাথা এলাকায় পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন লায়লা ও তাঁর পুত্রবধূ ঝর্ণা বেগম। দুজনকেই প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে লায়লা বেগমকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেওয়া হয় ঝর্ণাকে।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় একটি মাজারে যাওয়ার জন্য গ্রামের বাড়ি রাউজান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রওনা হয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের বহনকারী অটোরিকশাটি আতুরার ডিপো এলাকায় পৌঁছালে সড়কে আগুন দেখতে পান। চালক আগুন পাশ কাটিয়ে গাড়িটি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় মুখোশ পরা তিন ব্যক্তি গাড়িতে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে। এতে অটোরিকশার পেছনের সিটে বসা লায়লা বেগম ও পুত্রবধূ ঝর্ণা বেগম আহত হন।
জানতে চাইলে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ভুক্তভোগীর পরিবার চট্টগ্রামে না থাকায় এত দিন মামলা করা যায়নি। পুলিশ মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ট রলব ম
এছাড়াও পড়ুন:
আসছে ঘূর্ণিঝড় মৌসুম, কতটা প্রস্তুত আমরা?
আমাদের চারপাশে সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ডসহ নানা দুর্যোগ প্রতিনিয়ত ঘটছে। তাই নাগরিক জীবনে এগুলো প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তবে যতক্ষণ এ ধরনের বিপর্যয় আমাদের ব্যক্তিজীবনে নেমে না আসে, ততক্ষণ তা নিয়ে আমরা ভাবি না। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় এক ভয়াবহ বাস্তবতা। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি এক আতঙ্কের নাম।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার (ন্যাপ) তথ্যমতে, দেশে ১৫টি দুর্যোগের হার সময়ের সঙ্গে বাড়বে। এর মধ্যে জলবায়ু ঝুঁকি ছাড়াও রয়েছে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, নদনদীতে বন্যা, নদীভাঙন, আকস্মিক বন্যা ও শহরাঞ্চলের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, তীব্র তাপপ্রবাহ, তীব্র শীত, বজ্রপাত, ভূমিধস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও অম্লতা। সময়ের পরিক্রমায় আবারও আসছে ঘূর্ণিঝড় মৌসুম। কিন্তু আমরা এ নিয়ে কতটা সচেতন?
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে বাতাসের প্রচণ্ড ঘূর্ণায়মান গতি ও বায়ুমণ্ডলীয় উত্তাল অবস্থার ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। সাধারণত মার্চ থেকে জুলাই এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। এর মধ্যে মে এবং নভেম্বরে সবচেয়ে বেশি ঝড় আঘাত হানে। একটি গবেষণায় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ১৯৪৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৭৫ বছরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপ বিশ্লেষণ করেছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, এই সময়ে বঙ্গোপসাগরে ১৫১টি প্রবল ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বরে সর্বোচ্চ ৫১টি, মে মাসে ৩০টি এবং অক্টোবরে ২৯টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে।
এ ছাড়া ১৯৭০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৫৫ বছরে বাংলাদেশে মোট ৪২টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। সময় অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়: ১৯৭০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত (৩০ বছর) → ২১টি ঘূর্ণিঝড়, গড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ১৩৮ কিমি/ঘণ্টা এবং ২০০০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত (২৫ বছর) → ২২টি ঘূর্ণিঝড়, যেখানে গড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ১৪১ কিমি/ঘণ্টা। উপরোক্ত পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা দুটোই বেড়েছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ চারটি ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে, যা অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় বেশি। এ ছাড়া ১৯৭১, ২০০৭ এবং ২০২৪ সালে তিনটি করে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশ একাধিক উচ্চ তীব্রতার ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ১৯৭০, ১৯৯১, ২০০৭, ২০১৯ এবং ২০২৩ সালের ঘূর্ণিঝড়, যেগুলো ছিল অত্যন্ত বিধ্বংসী। বিশেষ করে ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রভাব নির্দেশ করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বের অন্যান্য সাগরের পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ঘূর্ণিঝড় আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং ভূমিতে আঘাত হানার পর ক্ষতির মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠ এবং ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা একসঙ্গে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসছে, যা ভবিষ্যতে আরও বিধ্বংসী ঝড়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য এই ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ প্রশমন এবং অভিযোজনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।
প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় আমাদের অর্থনীতি, পরিবেশ ও জনজীবনকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই দুর্যোগের মাত্রা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। আমরা যদি এখন থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা না নিই, তাহলে ভবিষ্যতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এখন আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা– ১. আমরা কি প্রতিবার দুর্যোগের পরে ক্ষতি সামলাতে ব্যস্ত থাকব? ২. নাকি আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে জানমাল রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেব?
দেশের কৃষির ওপর ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব এতই ব্যাপক, এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন, কৃষকের জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনসহ সামাজিক নিরাপত্তা অর্জনে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ সারাবিশ্বে প্রশংসিত। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দায় না যতটা আমাদের, তার চেয়ে বেশি বৈশ্বিক। আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশকে বাঁচাতে উন্নত দেশগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। তেমনি ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই জানমাল রক্ষায় সরকার থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ জরুরি। এতে দেশের মানুষ যেমন নিরাপদ থাকবে, তেমনি অর্থনীতিও রক্ষা পাবে।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (কৃষি পরিসংখ্যানবিদ, আবহাওয়ার তারতম্য ও জলবায়ু পরিবর্তন গবেষক) এবং সদস্য, এগ্রোমেট ল্যাব, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)
niaz.sust@gmail.com