তখন মাত্র দশম শ্রেণিতে উঠেছেন আরিফুল। ক্লাসের দ্বিতীয় দিনে শ্রেণিশিক্ষক আবদুল হামিদ শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চান, কার কী হওয়ার স্বপ্ন। আরিফুল উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছার কথা বলেন। যা শুনে সহপাঠীরা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেন। অপমান বোধ করে আরিফুল উদ্যোক্তাই হবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। ২৪ বছরের ব্যবধানে আরিফুল এখন একজন সফল উদ্যোক্তার নাম।

৩৯ বছর বয়সী আরিফুল ইসলাম সফল পোলট্রি খামারি হয়ে কেবল নিজের স্বপ্ন পূরণ করেই থামেননি, তরুণ-যুবাদের অনুপ্রেরণা-পরামর্শ দিয়ে রীতিমতো ‘উদ্যোক্তা তৈরির কারিগর’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। আরিফুলের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামে। নিজের আয়ে গ্রামেই করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। উদ্যোক্তা গড়তে তিনি নারী-পুরুষদের বিনা মূল্যে দিচ্ছেন প্রশিক্ষণ। আরিফুলের চেষ্টায় স্থানীয় দুই শতাধিক মানুষ মুরগির খামার গড়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। আরিফুলের কল্যাণে এই গ্রামকে এখন ‘পোলট্রি পল্লি’ নামে চেনে লোকে।

আরিফুলের বাড়িতে ঢোকার রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাছ। সে বীথি পেরিয়ে তাঁর নান্দনিক ডুপ্লেক্স পাকা বাড়ি। আরিফুল তখন গ্রামের নারী-পুরুষদের মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে চার একর জমিতে গড়ে তোলা মাছ, মুরগি ও গাভির খামার ঘুরিয়ে দেখান আরিফুল। এর ফাঁকে ফাঁকে নিজের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শোনালেন।

আরিফুলের খামারে একদিন

তারাগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে নিভৃত এক গ্রাম হাজীপুর। কাঁচা-পাকা পথ ধরে আরিফুল ইসলামের বাড়ি যাওয়ার সময় একের পর এক খামার চোখে পড়ে। প্রতিটি বাড়ির আনাচকানাচে সবজি চাষ করা হয়েছে। উঠানেও হাঁস-মুরগি, গোয়ালে গরু-ছাগল-ভেড়া। ঘরের চালা, আঙিনাজুড়ে চোখে পড়ে বিভিন্ন জাতের কবুতর। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি যেন ছোট-বড় একেকটি খামার।

আরিফুলের বাড়িতে ঢোকার রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাছ। সে বীথি পেরিয়ে তাঁর নান্দনিক ডুপ্লেক্স পাকা বাড়ি। আরিফুল তখন গ্রামের নারী-পুরুষদের মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে চার একর জমিতে গড়ে তোলা মাছ, মুরগি ও গাভির খামার ঘুরিয়ে দেখান আরিফুল। এর ফাঁকে ফাঁকে নিজের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শোনালেন।

ডিম বিক্রির লাভের টাকায় আরিফুল আরও এক হাজার মুরগি আনেন খামারে। এভাবে একপর্যায়ে আয় বাড়ে, খামার বাড়ে; আরিফুল হয়ে ওঠেন সফল উদ্যোক্তা।

আরিফুলের প্রতিজ্ঞা

আরিফুলের বাবা মোবারক হোসেন সম্ভ্রান্ত কৃষক। সচ্ছল পরিবারের ছেলে চাকরিবাকরি করবেন—গ্রামে এটাই রীতি; কিন্তু আরিফুল তা হননি। ২০০১ সালে স্থানীয় লালচাঁদপুর দাখিল মাদ্রাসায় দশম শ্রেণিতে পড়তেন তিনি। ক্লাসের দ্বিতীয় দিনেই এই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নকে অপমানিত হতে দেখে তিনি স্বপ্নকে বাস্তব করে দেখিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে বসেন।

আরিফুল বলেন, উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা তাঁকে সব সময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। ২০০৬ সালে ডিগ্রি পাসের পর তিনি মিঠাপুকুর উপজেলার শুকানের হাট গ্রামে আসাদুজ্জামানের খামার দেখতে যান। আসাদুজ্জামান ৫ হাজার মুরগি আর ২০টি গরুর খামার গড়ার গল্প শোনান, যা আরিফুলের ভাবনাকে নাড়া দেয়। ওই বছরের মে মাসে বাবার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে বাড়ির পাশে ঘর তুলে ৫০০ লেয়ার মুরগির বাচ্চা এনে খামার শুরু করেন। ৫ মাসের মধ্যে মুরগি ডিম দেওয়া শুরু করে। এক বছরে ডিম বিক্রি করে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় আসে। বাবা মোবারক হোসেনও ছেলের সাফল্য দেখে আরিফুলের সঙ্গে লেগে পড়েন।

ডিম বিক্রির লাভের টাকায় আরিফুল আরও এক হাজার মুরগি আনেন খামারে। এভাবে একপর্যায়ে আয় বাড়ে, খামার বাড়ে; আরিফুল হয়ে ওঠেন সফল উদ্যোক্তা। এখন তাঁর ৮টি ঘরে ২৫ হাজার লেয়ার মুরগি আছে। ২০ জন শ্রমিক নিয়মিত খামারে কাজ করেন। মুরগির খামার থেকে মাসিক আয় তাঁর চার লাখ টাকা। শুধু মুরগি নয়, আরিফুল দুই একর জমিতে পুকুর খনন করে ১০ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করছেন। এতে তাঁর বার্ষিক আয় হচ্ছে তিন লাখ টাকা। খামারে বিদেশি গাভি রয়েছে ৬টি, দিনে গড়ে ২০ লিটার দুধ পান। গরুর খামার থেকে বছরে আয় হচ্ছে আরও কয়েক লাখ টাকা।

সময় পেলে খামারের ডিম নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কোনো একটি স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ডিম উপহার দেন। তারপর উপদেশ দেন, কেবল চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার।

সংগঠক আরিফুল

নিজে উদ্যোক্তা হয়ে গ্রামের বেকার নারী-পুরুষের কথা ভুলে যাননি আরিফুল। ২০১৭ সালে মুরগি পালনকারী ১২৬ জনকে নিয়ে গঠন করে ‘ইকরচালী পোলট্রি উন্নয়ন সমিতি’। বর্তমানে তিনি সমিতির সভাপতি। মুরগি পালনকারীরা আসেন তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে। তাঁদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সময় পেলে খামারের ডিম নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কোনো একটি স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ডিম উপহার দেন। তারপর উপদেশ দেন, কেবল চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার।

বিভিন্ন স্থান থেকে মুরগির বাচ্চা, খাদ্য ও ওষুধ এনে খামারিদের মধ্যে সরবরাহ করছেন আরিফুল। ওই সব খামারের ডিম ও মুরগি দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিক্রিতেও সহায়তা করছেন তিনি। এসব খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে তিন শতাধিক মানুষের।

একাব্বার হোসেন স্থানীয় শলেয়াশাহ দাখিল মাদ্রাসায় দশম শ্রেণিতে পড়ে। আরিফুল তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর বাকিতে বাচ্চা ও খাদ্য দিয়ে খামার গড়তে সহায়তা করেন। একাব্বার বলে, পড়াশোনার ব্যয় বহন করতে বাবা হিমশিম খেতেন। এখন তার পাশাপাশি ছোট বোন লায়লা আক্তারও স্কুলে যায়। দুটি গাভি কেনা হয়েছে। বাড়ির সামনে করা হয়েছে সবজির বাগান। কবুতর, হাঁস-মুরগি, ছাগল পালন করে মাসে আয় হচ্ছে ১৮ হাজার টাকা।

আট বছর আগে হাজীপুর গ্রামের মেহেদী হাসান ও আবদুর রহমান ছিলেন বেকার। দুজনের কাছে কোনো পুঁজি ছিল না। আরিফুল তাঁদের ডেকে নিয়ে মুরগি পালনের কৌশল শিখিয়ে দেন। বাকিতে খাদ্য ও মুরগির বাচ্চাও দেন। মেহেদী ও আব্দুর রহমান শুরু করেন খামার। এখন তাঁরা লেয়ার মুরগির খামার করে ২৫ হাজার টাকা মাসে আয় করছেন।

এসব খামারে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। হাজীপুর গ্রামের গৃহবধূ সাহিদা বেগম বলেন, ‘দিনমজুর স্বামীর যে আয়, তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর ছিল। এখন খামারে কাজ করি, বাড়িতে ২০টি মুরগি, ১০টি হাঁস পালি। এসব দিয়েই তেল-সাবানের খরচ হয়ে যায়।’

লোকজন যখন ছেলের কাজের প্রশংসা করে, তখন বাবা হিসেবে গর্ব লাগে।আরিফুলের বাবা মোবারক হোসেন

সবার অনুপ্রেরণা আরিফুল

২০১২ সালে একই গ্রামের তরুণী সুবর্ণা পারভিনকে বিয়ে করেন আরিফুল। তাঁদের তিন ছেলে-মেয়ে। স্ত্রী সুবর্ণাও আরিফুলের সঙ্গে খামার পরিচালনায় সহযোগিতা করেন। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী এলাকার বেকারদের স্বাবলম্বী করে তাঁদের পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। এমন কাজ তো গর্বের।

আরিফুলের বাবা মোবারক হোসেন বলেন, ‘লোকজন যখন ছেলের কাজের প্রশংসা করে, তখন বাবা হিসেবে গর্ব লাগে।’ আরিফুলকে অনুকরণীয় উল্লেখ করে ইকরচালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী বলেন, চাকরি পেছনে না ছুটে খামার গড়ে আরিফুল যে সাফল্য এনেছেন, তা অবিশ্বাস্য। দেশে শিক্ষিত বেকার-যুবকদের জন্য আরিফুলের সাফল্য অবশ্যই অনুকরণীয়।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কে এম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, ইচ্ছা থাকলে খামার করেও যে নিজের পাশাপাশি অন্যের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আরিফুল ইসলাম। প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে সব সময় তাঁকে সহযোগিতা করা হয় বলে জানান তিনি।

আরিফুল স্বপ্ন দেখেন, গ্রামের প্রতে৵কটি মানুষ যেন সচ্ছল হয়। সবাই যেন হাসিমুখে বাঁচেন। এক লাখ মুরগির খামার করার স্বপ্ন আরিফুলের। পুকুরের ওপর মাচা দিয়ে হাঁস-মুরগি পালনের ইচ্ছা আছে। এটি মাছ চাষে সহায়ক হতে পারে। তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘লেখাপড়া শেষ করে কেবল চাকরির পরীক্ষার জন্য যে সময় ব্যয় হয়, তা যদি নির্দিষ্ট কোনো কাজে ব্যয় করা যেত, তা হলে চাকরির থেকেও ভালো কিছু করা সম্ভব। শুধু চাকরির আশায় বসে না থেকে নিজে কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। তবেই ব্যক্তি, সমাজ তথা দেশের উন্নয়ন হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম রগ র খ ম র আর ফ ল র ব আর ফ ল ত খ ম র গড় ন আর ফ ল ল ইসল ম র ম রগ চ কর র করছ ন উপজ ল হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কার ও নির্বাচনের সমন্বিত রোডম্যাপ ঘোষণা করুন: আ স ম রব

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, রাষ্ট্রীয় রাজনীতির মৌলিক সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। সাংবিধানিক সংস্কারসহ জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সনদ প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল দল ও সমাজশক্তি তথা শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবী সংগঠনসমূহের সাথে আলোচনা করে ব্যাপকভিত্তিক ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা আবশ্যক।

জাতীয় সনদ নির্বাচনের আবশ্যিক শর্ত পূরণ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, সংস্কার ও নির্বাচন পারস্পরিক পরিপূরক বিধায় সংস্কার ও নির্বাচনের সমন্বিত রোডম্যাপ ঘোষণা করা আবশ্যক। এই পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতি একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্যে ধাবিত হবে। সংস্কার ও নির্বাচন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জাতীয় রাজনীতির মৌলিক প্রশ্নে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির অনৈক্য বা বিভেদ পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।

আজ শুক্রবার উত্তরাস্থ বাসভবনে জেএসডির স্থায়ী কমিটির সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সভার শুরুতে ক্যাথলিক গুরু ফ্রান্সিস পোপের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

সভায় দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন— দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, স্থায়ী কমিটির সদস্য 
মিসেস তানিয়া বর, অ্যাডভোকেট ছানোয়ার হোসেন তালুকদার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ সিরাজ মিয়া, মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন, অ্যাডভোকেট কে এম জাবির ও কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ