মাগো,
আর ন’টা দিন। তোমার ৯২ পূর্ণ হলো না। পেলাম না তোমাকে নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের আরেকটা উপলক্ষ। চার দিন পরেই তোমার হাত ধরে আমার জীবনতরি বাওয়ার ৬৭ পূরণ হতো। সে–ও হলো না। বড্ড কষ্ট। কিন্তু তার চেয়েও স্বস্তি বেশি। আনন্দও।
জন্মাবধি তুমি আমার সাথি। কখনো মা, একটা সময় থেকে একই সঙ্গে মা ও বাবা। তবে, আজীবনই আছ বন্ধু হয়ে। মনে পড়ে? বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি বিয়ে করেছ?’ উত্তর শুনে আমার সে কী কান্না! অবুঝ মনের প্রশ্ন, ‘আমাকে নিয়ে যাওনি কেন?’ পরে বুঝ হলেও, সেই অন্ধ বন্ধুত্ব কখনো কমেনি! বিপদ-আপদ-সংকট, সুখ-দুখে অবিচ্ছেদ্য, চির-নির্ভর। তুমি আমার সব থেকে দীর্ঘকালীন সাথি। আমি তো তোমারও তা-ই। কারও বিদায়ে কি মনের বিচ্ছেদ ঘটে! জানো তো? পরম্পরায় গাঁথা বিনি সুতোর মালা কখনো শিথিল হয় না। সুতো কাটেনি তোমার সঙ্গে আমার, আমাদের, বাঙালির।
বছরখানেক ধরে তুমি বলে চলেছ, ‘এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ?’ বুকটা কেঁপে উঠত। তবু নির্বিকার থাকতাম। ভাব দেখাতাম, শুনতে পাইনি। ভাবতাম, তোমাকে তোমার মতো করে বাঁচতে দিতে আমি কী রসদ জোগাতে পারি! মুক্তিলাভের আকুল আকাঙ্ক্ষা পূরণেও কি হাত বাড়াতে পারি!চোখ মেলে পৃথিবীর আলো প্রথম দেখার পর তোমার কোল থেকে কাছে-পিঠেই একটানা ৪৬–৪৭ বছর। একান্তই নিজের মতো করে চলবে বলে সংসারী আমায় ঠেলে দিলে। সরাওনি মনের আসন থেকে। সেই থেকে স্বাধীন তুমি, একাকী। জীবনের নানান পরিচ্ছেদে যেমন নিভৃতবাস, একান্ত তোমারই বৈশিষ্ট্য। পাশে নেই, তবু প্রত্যহের দেখায় কত কথা—দেশ-দশের ভালোমন্দ, ছায়ানটের কাজ, সংগীত, আচরণ, ভাষা, উচ্চারণ, লেখালেখি, ফেলে আসা জীবনকথা রোমন্থন। নিছক পারিবারিক খোঁজখবরও বাদ পড়েনি। ব্যক্তি আমি থেকে সেই তুমি আজ বহুদূরে। তবে তোমার প্রাণের পরশ দিয়ে, অদৃশ্য হয়েও সকলকে ঘিরে, সকলের বড় কাছের।
আশৈশব ব্যক্তি ‘আমি’র বাইরে তোমার স্বচ্ছন্দ বসবাস। সমাজকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ, খানিক পরিবারবিবাগি। সহযাত্রীদের মধ্যেও কি তুমি বারেবারে একা হয়ে পড়নি? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জীবনসাথির সঙ্গে বিচ্ছেদ তোমাকে বিচলিত করেনি, একাই সামলেছ তিন সন্তানকে। তবু সমাজের চাহিদায় তুমি যেন সংসারকাজে উদাসীনও। জেনো, সন্তানেরা অমানুষ হয়নি। তোমার শিখার আঁচেই বড় হয়েছে। একরোখা মেয়ে তুমি সব মাড়িয়ে ছাড়িয়ে কায়মনোবাক্যে বাঙালি সত্তা জাগিয়ে রাখার কাজে এগিয়ে চলেছ। তোয়াক্কা করনি কে সঙ্গে আছে, কে নেই, কে বিরোধী!
অকালে অপালাকে হারানোর শোক দমিয়ে তুমি নিজের লক্ষ্যপথে অবিচল ছিলে। ওই মনোবলই আমাদের পাঠ। প্রস্তুত হতে থাকি। কায়াতে থাকলেও মনে সে সময় থেকেই তুমি যেন ক্রমান্বয় অপস্রিয়মাণ দূরপথযাত্রী।জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখেছি—নিজের সংসার, সে সীমানা ভেঙে বিশ্বাসের বিস্তৃত পরিসরে অগ্রজ আর অনুজ আপনদের বড় পরিবার, গোটা বাঙালি সমাজ, বিশ্বমানবসমাজ—কোনো না কোনো, কারও না কারও কাজ নিয়ে তুমি সদাব্যস্ত। তোমার মত–পরামর্শের জন্য অযুতজন উন্মুখ হয়ে থাকে। নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ, সততা—সব মেনে মানুষকে ভালোবেসে কাছে টানাই তোমাকে সবার মনে জায়গা করে দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম, নশ্বর দেহে বয়সের ভার চেপে বসছে। ক্ষীণবল। কাজে নামা হয় না। তবে মন চাঙা, সে শক্তিতেই শরীরকে ঠিক চালিয়ে নিয়েছ।
বছর কয় ধরেই তুমি নির্জীব হয়ে পড়ছিলে। ২০১৮ সালে স্ট্রোককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তোমার চমকজাগানো প্রত্যাবর্তন। তবু ধীরে ধীরে ক্ষয় জেঁকে বসে। করোনা পেরিয়েও হাঁটুর বিশ্বাসঘাতকতায় চলাফেরা সীমিত। চোখের জ্যোতি যাচ্ছে বলে পড়া বন্ধ। আঙুলগুলো অসাড় তাই লেখা আসে না। ভালো শুনতে পাও না, নিজের ওপর বিরক্ত। কেউ পছন্দের লেখা পড়ে শোনালেও মন ভরে না। প্রিয় শিল্পীদের প্রিয় গানও আগের মতো আনন্দ দেয় না। তোমার কথা শুনে কেউ লিখে দেবে, তাতে তৃপ্তি হয় না। সবার জন্য কাজ করে তোমার ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছ বহুজনকে। নিজে আজীবন স্বাবলম্বী। পরনির্ভর ছিলে না বলেই বুঝি অত খামতি তোমার সয়নি। নিভে চলেছ দিনে দিনে? হাল বুঝি ছেড়েই দিচ্ছ!
ডাক্তার সাহেবের আচমকা জিজ্ঞাসা, তুমি এবং আমরা ‘লাইফ সাপোর্ট’ চাই কি না। স্বজনদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তুমি জানিয়ে দাও, কোথায় তোমার দেহদানের দলিল। তোমার একরোখা উত্তরও আসে, ‘না চাই না।’সমাজের মনোগ্রাহী কিছু কাজে নিবিষ্ট মনোযোগ ছাড়া, সেই হ্রস্বকর্ম দুঃসময়ে, তোমার একমাত্র আনন্দযোগ, জীবনের সকল সংগীতসঞ্চয় নবীনের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া। অসহজ দেহ আর সজীব মন নিয়ে দিনের পর দিন অক্লেশে অনুসারীদের তুমি সুর–বাণী–ছন্দের নির্যাসে আপ্লুত করেছ। কমজোরি কিডনি আর ঘন ঘন ইউরিন ইনফেকশন তোমাকে দুর্বল করার পর বৈঠকঘরে তেমন আর যাওনি। তবু দুর্মর ছিল তোমার শিষ্যসঙ্গ বাসনা। দল বেঁধে নয়, তখন নবীনেরা বিছানার ধারে একা একা গান শুনিয়ে তোমার প্রসাদবাণী পেয়েছে। অকাতরে তুমি বিলিয়ে চলেছ নিজেকে।
কিডনি যখন বিকল, ডায়ালাইসিসের শুরু। তুমি মেনে নিয়েছ। অফুরান প্রাণ! যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণই সকলের কল্যাণকামনা। মনের শক্তিতে মানুষকে প্রাণিত করা। সপ্তাহে তিন দিন হাসপাতাল। বিরামের দিনগুলোতেও সময় দিলে কাছের কাজের মানুষদের। কিন্তু অত ধকল কি নবতিপূর্ণার সয়! জানবার বলবার আগ্রহগুলো মরে আসে। এমনকি দেশ-সমাজের অভূতপূর্ব পরিবর্তনও তোমাকে নাড়া দেয় না, জাগায় না। ডাক্তার সাহেব কিডনিদানের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন, এই বয়সে নাকি সম্ভব নয়। শঙ্কা জাগে, মুক্তি কি আসন্ন! অকালে অপালাকে হারানোর শোক দমিয়ে তুমি নিজের লক্ষ্যপথে অবিচল ছিলে। ওই মনোবলই আমাদের পাঠ। প্রস্তুত হতে থাকি। কায়াতে থাকলেও মনে সে সময় থেকেই তুমি যেন ক্রমান্বয় অপস্রিয়মাণ দূরপথযাত্রী।
আমার হুতাশ আছে, কান্না নেই। অকস্মাৎ দমক আসে না তা নয়। কিন্তু তুমি মুক্ত হয়েছ, শান্তি পেয়েছ ভাবলেই শুকিয়ে আসে অশ্রুধারা। বরং স্বস্তির আনন্দ ছেঁকে ধরে। বড্ড সুসময়ে তোমার প্রস্থান! আমি কি নিষ্ঠুর?বছরখানেক ধরে তুমি বলে চলেছ, ‘এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ?’ বুকটা কেঁপে উঠত। তবু নির্বিকার থাকতাম। ভাব দেখাতাম, শুনতে পাইনি। ভাবতাম, তোমাকে তোমার মতো করে বাঁচতে দিতে আমি কী রসদ জোগাতে পারি! মুক্তিলাভের আকুল আকাঙ্ক্ষা পূরণেও কি হাত বাড়াতে পারি! ধিক। কিছুই করিনি, কিছুই পারিনি। বিহ্বল, বিবশ হয়ে দিন যাপন করে গেছি। নিরন্তর কাজের মধ্যে ডুবে থাকা সতেজ তোমার কর্ম-অক্ষমতার কষ্টকেই বাড়িয়ে চলেছি!
ঘোর দুর্দিনে পায়ের হাড় ভাঙল। ভাঙল মনের অবশিষ্ট জোরটাও। অকারণেই কি? ডাক্তার সাহেবের আচমকা জিজ্ঞাসা, তুমি এবং আমরা ‘লাইফ সাপোর্ট’ চাই কি না। স্বজনদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তুমি জানিয়ে দাও, কোথায় তোমার দেহদানের দলিল। তোমার একরোখা উত্তরও আসে, ‘না চাই না।’ জানি, সারা জীবন তুমি আমাদের সংস্কৃতি-মানবতা-সম্প্রীতির বোঝা বয়েছ, নিজে বোঝা হতে চাওনি। সব কাজ গুছিয়ে, সেরে, বন্ধ করে দিলে ভাব-মতবিনিময়। ঘুমিয়ে পড়লে অচিরেই। সবই হুটহাট!
আমার হুতাশ আছে, কান্না নেই। অকস্মাৎ দমক আসে না তা নয়। কিন্তু তুমি মুক্ত হয়েছ, শান্তি পেয়েছ ভাবলেই শুকিয়ে আসে অশ্রুধারা। বরং স্বস্তির আনন্দ ছেঁকে ধরে। বড্ড সুসময়ে তোমার প্রস্থান! আমি কি নিষ্ঠুর?
দেশ-জাতি-ভাষা-সংগীত-সংস্কৃতি নিয়ে আমার, আমাদের অনিশ্চয়তা কাটানো; কোনো জিজ্ঞাসার সদুত্তরের নিশ্চিন্ত ভরসা তুমি। তাই গেয়ে চলি, ‘তোমায় নতুন করে পাব ব’লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ/ ও মোর ভালোবাসার ধন।’মান কোরো না মাগো, বলি, তোমাকে কত কিছু দেখতে হয়নি! দুঃশাসন, হানাহানি, হিংসা, লোভ, প্রবঞ্চনা। তুমি কি জানো? তুমি পরিবার, নিজের নাকি জাতির সম্পদ! জেনে খুশি হবে, এই সমাজে তোমার অপরিসীম প্রভাব। তোমার বিদায় নিয়ে খোলাখুলি ভালো-মন্দ বাদ-প্রতিবাদ চলে! বাক্স্বাধীনতার কাছে পাত্তা পায় না ব্যক্তি-অধিকার, ব্যক্তি-ইচ্ছা। এত জন-আলোচনা আর অলস পড়ে থাকা কি সইতে পারতে! তাই নির্দয়ের মতোই বলি, তোমার চলে যাওয়া এক পরম স্বস্তি, পরমানন্দ।
দেশ-জাতি-ভাষা-সংগীত-সংস্কৃতি নিয়ে আমার, আমাদের অনিশ্চয়তা কাটানো; কোনো জিজ্ঞাসার সদুত্তরের নিশ্চিন্ত ভরসা তুমি। তাই গেয়ে চলি, ‘তোমায় নতুন করে পাব ব’লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ/ ও মোর ভালোবাসার ধন।’
—তোমার পাত্থুলি
পরিচয়সূত্র: সন্জীদা খাতুনের তিন সন্তান—অপালা, পার্থ, রুচিরা; জীবনসাথি—ওয়াহিদুল হক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র র প রস পর ব র আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
সাতক্ষীরায় ঘুমন্ত শিশুকে কুপিয়ে হত্যা, মা আটক
সাতক্ষীরার কলারোয়ায় ঘুমন্ত শিশুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় ওই শিশুর মাকে আটক করে পুলিশে দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দাবি পরিবারের সদস্যদের। আজ শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বাটরা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত শিশুটির নাম খাদিজা খাতুন (দেড় বছর)। সে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কুশোডাঙা গ্রামের তৌহিদুজ্জামানের মেয়ে। গ্রেপ্তার নারীর নাম আসমা খাতুন (২৪)।
আটক আসমার বোন রেশমা খাতুন জানান, ২০২১ সালের জুন মাসে তাঁর বোন আসমার সঙ্গে একই উপজেলার কুশোডাঙা গ্রামের তৌহিদুজ্জামানের বিয়ে হয়। পরে তাঁর বোনের তানভির হোসেন ও খাদিজা খাতুন নামের দুটি সন্তান হয়। সম্প্রতি আসমা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এ কারণে গতকাল বৃহস্পতিবার আসমাকে চিকিৎসার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি আনা হয়। আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আসমা তাঁর শিশুমেয়ে খাদিজাকে ঘরের বারান্দায় রেখে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর আসমা রান্নাঘর থেকে ধারালো বঁটি নিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় খাদিজাকে কুপিয়ে হত্যা করেন।
পরে প্রতিবেশীরা আসমাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। জালালাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোজাব্বর হোসেন জানান, শিশুসন্তানকে হত্যার পর আসমা সেখানেই বসে ছিলেন। মানসিক ভারসাম্য হারানোর কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।
কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, আসমা মানসিক ভারসাম্যহীন বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। তাঁকে আটক করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য শিশু খাদিজার লাশ সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।