ক্রস বর্ডার ই-কমার্স ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
Published: 25th, April 2025 GMT
পর্ব–৪
বিশ্ব এখন একটি গ্লোবাল ভিলেজ। প্রযুক্তির কল্যাণে দেশের সীমানা পেরিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে অনায়াসে। ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স বা সীমান্ত পেরিয়ে অনলাইন বাণিজ্য এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি শক্তিশালী চালিকা শক্তি। বাংলাদেশের জন্যও এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ। প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কতটা প্রস্তুত? সম্ভাবনা কতটুকু, আর করণীয় কী?
ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স: ধারণা ও বৈশ্বিক প্রসঙ্গ
ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স মানে হলো দেশের সীমানার বাইরে পণ্য বা সেবা বিক্রি করা। আলিবাবা, অ্যামাজন, এটসি, ইবের মতো বৈশ্বিক বাজারে (গ্লোবাল মার্কেটপ্লেস) এখন লাখ লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নিজস্ব পণ্য সরবরাহ করছেন। বিশ্বের ই-কমার্স রপ্তানি বাজার ২০২৩ সালে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে (সূত্র: আঙ্কটাড প্রতিবেদন ২০২৩)।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ থেকে এখনো তুলনামূলক কমসংখ্যক উদ্যোক্তা সরাসরি গ্লোবাল মার্কেটপ্লেসে অংশ নিচ্ছেন। ই–ক্যাবের তথ্য মতে, প্রায় দুই হাজারের বেশি উদ্যোক্তা অ্যামাজন, এটসি, ইবের মতো মাধ্যমে সক্রিয়। প্রধান রপ্তানি পণ্যসমূহ হলো পোশাক, হস্তশিল্প, চামড়াজাত পণ্য, ডিজিটাল সার্ভিস ও হালকা ইলেকট্রনিকস।
ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সে বাংলাদেশের সম্ভাবনা
বিশাল তরুণ জনশক্তি: ৬০ শতাংশের বেশি জনসংখ্যা কর্মক্ষম বয়সী।
ডিজিটাল সংযোগ: ১২ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী (সূত্র: বিটিআরসি, ২০২৪)।
বৈচিত্র্যময় পণ্য: জামদানি, নকশিকাঁথা, মসলিন, হস্তশিল্প, চামড়া, আইটি সার্ভিস ইত্যাদি।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন উৎস তৈরির সম্ভাবনা।
আরও পড়ুনফিনটেক ও ই-কমার্স ইকোসিস্টেম: বাংলাদেশের নতুন বাণিজ্যবিপ্লব২৪ এপ্রিল ২০২৫মূল চ্যালেঞ্জ
আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে সীমাবদ্ধতা (পেপ্যাল, স্ট্রাইপ অনুপস্থিত)।
কাস্টমস ও শুল্ক জটিলতা।
পণ্যের মান নিরীক্ষা ও সার্টিফিকেশনের ঘাটতি।
রিটার্ন পলিসি ও আন্তর্জাতিক লজিস্টিক ব্যয় বেশি।
উদ্যোক্তাদের দক্ষতার ঘাটতি ও গ্লোবাল মার্কেট বোঝার অভাব।
বিশ্বের সফল উদাহরণ
চীন: আলিবাবা ও জেডি ডটকম ছোট উদ্যোক্তাদের বিশ্ববাজারে পৌঁছে দিয়েছে।
ভারত: অ্যামাজন গ্লোবাল সেলার প্রোগ্রামের মাধ্যমে লাখ লাখ এসএমই উদ্যোক্তা রপ্তানিতে যুক্ত হয়েছে।
ভিয়েতনাম: ই–কমার্স এক্সপোর্ট হাব গড়ে স্থানীয় পণ্য রপ্তানিতে সহায়তা করেছে।
আরও পড়ুনই-কমার্সে ডিজিটাল নিরাপত্তা ও গ্রাহক আস্থা২৩ এপ্রিল ২০২৫বাংলাদেশের জন্য করণীয়
পেপ্যাল বা বিকল্প আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে আনয়ন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) অধীন ক্রস-বর্ডার ফ্যাসিলিটেশন সেল গঠন।
উদ্যোক্তাদের জন্য অ্যামাজন, এটসি সেলার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা।
পণ্য সার্টিফিকেশন ও ব্র্যান্ডিং সহজ করা।
ক্রস-বর্ডার লজিস্টিক ও ফাসিলিটেশন পার্ক স্থাপন।
ই-কমার্স রপ্তানির জন্য বিশেষ শুল্ক ছাড় ও প্রণোদনা।
বিশেষ উদ্যোগের প্রস্তাবনা
‘মেইড ইন বাংলাদেশ অনলাইন’ প্রচারণা চালু করা।
ই–ক্যাবের অধীন বৈশ্বিক বিক্রেতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করা।
আইসিটি বিভাগের অধীনে ই–কমার্স এক্সপোর্ট স্টার্টআপ তহবিল গঠন করা।
আরও পড়ুনবাংলাদেশের ই-কমার্স: কোথায় আছি, কোথায় যেতে চাই২২ এপ্রিল ২০২৫২০৩০ সালের লক্ষ্য
১ লাখ ক্রস বর্ডার ই-কমার্স উদ্যোক্তা তৈরি করা।
ই-কমার্স রপ্তানি আয় ২০০ কোটি ডলারে উন্নীত করা।
অন্তত এক হাজারটি এমএসএমই উদ্যোক্তাকে গ্লোবাল মার্কেটপ্লেসে যুক্ত করা।
বাংলাদেশের ই-কমার্স রপ্তানি সম্ভাবনা বিশাল। সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি করতে পারি, উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে পারি এবং বাংলাদেশের গৌরবময় পণ্যগুলো বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিতে পারি।
(আগামীকাল সমাপ্য)
ড.
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সফটওয়্যার পাইরেসি বন্ধে দরকার সমন্বিত পদক্ষেপ
অধিকার হরণ ও অধিকার আদায় উভয়ের মাঝেই দুনিয়ার বহু কর্মকাণ্ড ঘটেছে। সামাজিক ভারসাম্য ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানুষের তৎপরতাও কম নয়। কিন্তু তার বিপরীত চেষ্টাও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। এ জন্য আধুনিক বিশ্বে কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব আইনের উদ্ভব ঘটে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় সমাজের দুষ্টচক্র শুধু মেধাজাত সম্পদের অধিকারই হরণ করছে না, বরং পরিসর
বাড়িয়ে পাইরেসির মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে পুনরুৎপাদন করে মেধাসম্পদ, সৃজনশীলতা ও অর্থনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন করছে। সাম্প্রতিক বিশ্বে কম্পিউটার প্রযুক্তিনির্ভর সফটওয়্যার খাতেও পাইরেসি জেঁকে বসেছে।
মোটাদাগে, সফটওয়্যার হলো এক ধরনের প্রোগ্রাম বা নির্দেশনার সমষ্টি, যা কম্পিউটার হার্ডওয়্যারকে বিভিন্ন কাজ করতে নির্দেশ দেয়। বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে মানুষ হিসাব-নিকাশ থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র, সংগীতসহ নানা ক্ষেত্রে সফটওয়্যারের মাধ্যমে সৃজন প্রতিভার প্রসার ঘটিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ২০২৩ সালে প্রণীত কপিরাইটে পূর্বতন আইনের সীমাবদ্ধতা কাটাতে আর্থসামাজিক অবস্থা আমলে নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সফটওয়্যার পাইরেসির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। কপিরাইট আইন ২০২৩-এর প্রথম অধ্যায়ের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।
সফটওয়্যার বানাতে সোর্স কোড লাগে, ভাষা লাগে। সোর্স কোডের মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপিত হয়। এ জন্য এর সুরক্ষায় কপিরাইট প্রয়োজন। যে কোনো ধরনের সফটওয়্যার চাহিদার প্রয়োজনে উন্নত ভার্সনের দরকার পড়ে। আপগ্রেড করে নতুন সংযোজিত মেধার জন্য নবায়নকৃত সফটওয়্যারও কপিরাইট করা যেতে পারে। তবে পুরোনো সফটওয়্যার মোটাদাগে ৫০ শতাংশের বেশি নতুন সংযোজন না হলে কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে।
সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে সোর্স কোড বিন্যাস করে নতুন নামে সামনে আসে। তখন এর সুরক্ষার জন্যও কপিরাইট আবশ্যক। সফটওয়্যারের সুরক্ষার জন্যও ন্যারেটিভের কপিরাইট প্রয়োজন, পাশাপাশি বাণিজ্যিকীকরণের জন্য ব্র্যান্ড হিসেবে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এই দুই সুরক্ষা কবচ সফটওয়্যারের সুরক্ষা দেয়। কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর সফটওয়্যার তৈরিতে প্রযুক্তিবিদরা যেমন মেধার কর্ষণে সৃজনের আনন্দ পান, বিপরীতক্রমে পর্দার আড়ালে থাকে পাইরেসি চক্র। তারাও প্রযুক্তির সহায়তায় পাইরেসির মাধ্যমে কপিরাইট লঙ্ঘন করে।
সফটওয়্যার পাইরেসির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নতুন কৌশল নেওয়া হচ্ছে। তাই আইনের মোটাদাগের পরিধির ভেতর সরল ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের কপিরাইট অফিস সফটওয়্যার পাইরেসির ক্ষেত্রে আইনের বিধির মান্যতার অনুশাসন ও অনুসরণ রক্ষা ছাড়াও কপিরাইট বোর্ড এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে ইতোপূর্বে বিরোধ নিষ্পত্তির নজির রয়েছে। সফটওয়্যার পাইরেসির ক্ষেত্রে স্রষ্টা কিংবা বাণিজ্যিক ব্যবহারের স্বত্ব গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের জনতুষ্টির বিষয় অনেক সময় লোভী পাইরেট চক্রকে আরও প্রলুব্ধ করে।
উন্নয়নশীল দেশের জন্য বড় কিছু কোম্পানি অনেক সফটওয়্যার পাবলিক ডোমেন হিসেবে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। সেই সুযোগে সাধারণ গ্রাহক তুষ্ট হলেও অতিলোভী চক্র সংরক্ষিত সফটওয়্যার অবৈধ উপায়ে পাইরেসি করে আয় করতে চায়। বাংলাদেশে এই প্রবণতা এখন বেশ তীব্র। এ জন্য বর্তমান আইনের বুনন বেশ মজবুত ও প্রতিকার রক্ষায় সাজা ও দণ্ড পূর্বতন অবস্থার চেয়ে ঢের বেশি। কপিরাইট আইন ২০২৩-এর ষোড়শ অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ ৭৮-এ দেওয়ানি, সপ্তদশ অধ্যায়ে ফৌজদারি প্রতিকারের বিধান আছে। ৮৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি চলচ্চিত্রের কপিরাইট বা এই আইনে বর্ণিত অন্য কোনো অধিকার ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
বর্তমানে সফটওয়্যার পাইরেসির ফলে প্রযুক্তিবিদদের সৃজনের বিনিময়ে আনন্দ, স্বস্তি, স্বীকৃতি ও যথার্থ বিনিময়মূল্য দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে শুধু মেধাস্বত্বের স্রষ্টা নয়; পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করে আপাতদৃষ্টিতে ব্যবহারকারী সুবিধা ভোগ করে, কিন্তু তারা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন। অনেক ক্ষেত্রে সামান্য অর্থ প্রদান করে অরিজিনাল সফটওয়্যার পাওয়া গেলেও পাইরেটেড কপির প্রতি নজর বাড়ছে।
ব্যক্তিগত কাজে ড্রপবক্স অ্যাকাউন্ট খুলে তথ্য, ছবি, নথি ইত্যাদি ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা অনেকাংশে গুগল ড্রাইভের চেয়ে সহজতর। ধারণা করা হচ্ছে, সফটওয়্যারের ওপর নির্ভরতা আমাদের যাপিত জীবনে আরও থিতু হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে শুধু কপিরাইট আইনের বিধিবিধানের কঠোরতা নয়; জনসমাজে কপিরাইট আইনের ফাঁকফোকর না খুঁজে বরং তা মেনে চলা জরুরি।
এ জন্য বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ব্যাপারে পাঠ্যক্রম ও আলাদা বিভাগের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদবিষয়ক পাঠদানে তত্ত্বীয় দিকের চেয়ে প্রায়োগিক দিককে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক বিষয়টির গুরুত্ব থাকে। তবেই পাইরেসি প্রতিরোধে জাগরণ ঘটবে জনসমাজে।
খান মাহবুব: কপিরাইট বিশেষজ্ঞ ও প্রাবন্ধিক