এ বছর প্রায় ৫০ দশমিক ৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। এই তথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। ২০০৫ সালে বোরো ধান আবাদের আওতায় জমি ছিল ৪০ দশমিক ৬৪ লাখ হেক্টর। ২০১০ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ দশমিক ৭৮ লাখ হেক্টর, ২০২০ সালে ৪৮ দশমিক ১৫ লাখ হেক্টর, ২০২৩ সালে ৪৮ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর।

বাংলাদেশে পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তি ও দুর্বল ‘ডেটা ইনটিগ্রিটি’ প্রবল। তাই বোরো ধান আবাদের আওতায় জমির পরিমাণ ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধির এই তথ্য নিয়ে সন্দেহ করার কারণ আছে। অস্থির চালের বাজারের অস্থির সময়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বিবিএস, ডিএইয়ের মধ্যে তথ্যবিতর্ক পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে বোরো ধান আবাদের আওতায় জমির পরিমাণকে তথ্য-উপাত্ত ও বাস্তবতার নিরিখে চ্যালেঞ্জ করে এই লেখা।

২০০৫ সালে বাংলাদেশে আবাদি জমি ছিল ৮১ লাখ হেক্টর। ২০২৫ সালে এসে এই পরিমাণ জমি নিশ্চয় নেই। বছরে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ হারে (কোনো কোনো গবেষকের মতে ১ শতাংশ) আবাদি জমি কমলেও গত ২০ বছরে কমেছে ১২ শতাংশ। সেই হিসাবে বর্তমানের নিট ফসলি জমি হওয়ার কথা প্রায় ৭১ লাখ হেক্টর। বোরো ধানের আওতায় ৫০ লাখ হেক্টর বাদ দিলে অন্যান্য ফসলের আওতায় জমি অবশিষ্ট থাকে মাত্র ২১ লাখ হেক্টর। ওভারলেপিং ক্রপ যেমন শর্ষে ও আলু বিবেচনায় নিলেও বাকি ২১ লাখ হেক্টর জমিতে অনেকগুলো ফসলের হিসাব মেলানো কঠিন হচ্ছে।

ভেতো বাঙালির ভাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেচনির্ভর উচ্চফলনশীল বোরো ধান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বোরো ধান এখন দেশের প্রধান ধানের মৌসুম। বোরো মৌসুমে মোট জাতীয় উৎপাদনের ৬০ শতাংশ উৎপাদিত হয়। যদিও ব্যাপকভিত্তিতে বোরো ধানের আবাদ বেশি দিনের নয়। সেচপ্রযুক্তি সম্প্রসারণের আগের জামানায় ধানের প্রধান মৌসুম ছিল আমন ও আউস। উন্নত সেচ ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ, উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ফলে আউস ধানের আবাদ কমতে থাকে এবং অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে সেচনির্ভর বোরো ধানের। কিন্তু যৌক্তিক কারণেই বোরো ধানের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ার সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে। ২০১০ সালের পর থেকে বোরো ধানের আবাদ বৃদ্ধির তথ্য বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।

বোরো মৌসুমে মাঠভরা বোরো ধান দেখা গেলেও জলবায়ু পরিবর্তন, সেচের পানির সংকট ও আন্তফসল প্রতিযোগিতার ফলে আস্তে আস্তে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বোরো চাষ। এ ছাড়া তুলনামূলক লাভ–ক্ষতির হিসাব ও বিকল্প ফসলের সম্ভাবনা বিবেচনা করে কৃষক অতিরিক্ত সেচনির্ভর বোরো ধান চাষ থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাওয়ার তথ্য গবেষণা প্রবন্ধ ও গণমাধ্যামে আছে। তাই বোরো ধানের আবাদ অব্যাহতভাবে বাড়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে রবি মৌসুমে বাংলাদেশে ফসলের বৈচিত্র্য বেড়েই চলেছে। কৃষক নানা রকম উচ্চমূল্য ফসলের দিকে ঝুঁকবে, এটাই স্বাভাবিক। ধান চাষ করে অব্যাহত লোকসানের কবলে পড়ে কৃষকেরা শুধুই বিকল্প আবাদ খুঁজছে। বোরো ধানের ফলন বেশি হলেও উৎপাদন খরচ সবচেয়ে বেশি। প্রতি হেক্টর জমিতে সেচ বাবদ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। হেক্টরপ্রতি নিট মুনাফা শীতকালীন অন্যান্য ফসলের চেয়ে অনেক কম। কৃষক বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকবে, এটাই স্বাভাবিক। মনে হতে পারে, বোরো ধানের আওতায় জমির হিসাব একটু গরমিল হলে কৃষি অর্থনীতির, খাদ্যনিরাপত্তার কী এমন ক্ষতি হবে। না, বৈশ্বিক ‘রাইস ইকোনমিতে’ বাংলাদেশের সঠিক তথ্যটাও খুব প্রয়োজন বৈশ্বিক বাজার পরিকল্পনায়।

বাংলাদেশ ‘গ্লোবাল রাইস ইকোনমি’র প্রধান অভিনেতা, পার্শ্ব অভিনেতা বা খলনায়ক নয়। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী ও চালের ভোক্তাদেশ। উৎপাদন তথ্যের গরমিল আন্তর্জাতিক বাজারে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে বাংলাদেশ হঠাৎ ২৬ লাখ টন চাল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করেছিল, যেটা বৈশ্বিক আমদানি–রপ্তানি পরিকল্পনায় ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক চালের বাজারে বাংলাদেশের পরিচিতি আমদানিকারক হিসেবে নয়।

ভুট্টার ব্যাপক আবাদ বোরো ধানের আওতায় জমির পরিমাণকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এ বছর শীতকালীন ভুট্টার আবাদ হয়েছে ৫ দশমিক ২৮ লাখ হেক্টর, যেটা ২০০৫ সালের তুলনায় প্রায় ৪ লাখ হেক্টর বেশি। সাধারণত গম ও বোরো ধানের জমি প্রতিস্থাপিত হয়েছে ভুট্টা দিয়ে। গমের আওতায় জমি কমেছে প্রায় ১ লাখ হেক্টর। কাজেই যৌক্তিক কারণে অন্তত ৩ লাখ হেক্টর বোরো ধানের জমি চলে গেছে ভুট্টা আবাদে।

সারা দেশে গত ২৫ বছর স্থায়ী ফলবাগান (আম, লিচু, পেয়ারা, ড্রাগন ফল, কুল) বেড়েছে। শীতকালীন ডাল ফসলের আবাদ বেড়েছে। শীতকালীন সবজির আবাদ বেড়েছে। মসলা ফসলের আবাদ বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাণিজ্যিকভিত্তিকে ফুলের আবাদও বেড়েছে। এসব শস্য বহুমুখীকরণের প্রভাব অবধারিতভাবে পড়ার কথা বোরো আবাদে। তাহলে রবি মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ অব্যাহতভাবে বড়ার গাণিতিক যুক্তিটা কী?

সম্প্রতি ফসলি জমিতে পশুখাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব ও প্রাক্কলন অনুযায়ী দেশে অন্তত ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক লাখ হেক্টর জমিতে পশুখাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে। গরুর মাংসের বাজারমূল্য ভালো হওয়ায় দেশে প্রতিবছর প্রায় এক কোটি গরু মোটাতাজাকরণ করা হচ্ছে। সবুজ ঘাসের অব্যাহত জোগান দিতে গিয়ে ফসলি জমিতে ঘাসের চাষ বাড়ছে। এর ফলে বোরো ধানের আওতায় জমির পরিমাণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

তিন ফসলি জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কোনো আইন নেই। তাই প্রতিবছর নতুন পুকুর করতে ধানের জমি হারিয়ে যাচ্ছে। ধান চাষের চেয়ে মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় এবং ঝুঁকি কম হওয়ায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ধানের জমি। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম অভিঘাত নদীভাঙন। পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা অববাহিকায় প্রতিবছর ৮-১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি বিলীন হয়। নতুন চর জেগে উঠলেও সেখানে মাটির গুণাগুণ অনুযায়ী কিছু ফসল (শর্ষে, গম, ভুট্টা, সবজি) হলেও বোরো ধানের আবাদ কমই হয়।

জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন ফসলের আওতায় আবাদি জমির পরিমাণ জরিপ নিয়ে কাজ করেছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, স্পারসো, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। ফ্রি ভার্সনের যে স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করা হয়, সেটাতে ত্রুটিমুক্ত ফলাফল পাওয়া যায় না। কিছু গবেষক তাঁদের গবেষণাপত্রে ধান চাষের আওতায় জমির পরিমাণ নির্ণয় করেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিছু টেকনিক্যাল সীমাবদ্ধতা আছে। রবি মৌসুমে শস্যবৈচিত্র্য এত বেশি যে স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করা যায় না। খণ্ড খণ্ড জমিতে কোনোটাতে বোরো ধান, কোনোটাতে রসুন, গম, যব অথবা ভুট্টা। কাজেই জরিপের ক্ষেত্রে ম্যানুয়াল সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কৃষি বিভাগ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাঠকর্মীরা নিয়মিত ফসল আবাদের তথ্য দেন, কিন্তু সেখানেই বড় ত্রুটি রয়ে যায়।

গবেষণা প্রবন্ধ ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখ যায়, বাংলাদেশে ছয়টি জলবায়ু হটস্পটে বোরো ধানের আবাদ বিঘ্নিত হচ্ছে। হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের আবাদ বিঘ্নিত হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চল বোরো চাষের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। লবণাক্ততার অব্যাহত বৃদ্ধি ও স্বাদুপানির সংকটে এখানে বোরোর আবাদ সংকটের মুখে। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটে বোরো চাষ বিঘ্নিত হওয়ার খবর। খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চল পানিসাশ্রয়ী বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকছে। এত গবেষণা, পরিসংখ্যান, যুক্তি ও বাস্তবতার পরও বোরো ধান আবাদের আওতায় জমি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

উন্নয়নের অতিরঞ্জিত বয়ান শুনে আত্মতৃপ্ত হওয়ার এক সর্বনাশা নেশায় পেয়ে বসেছিল এই জাতিকে। জিআইএস, রিমোট সেন্সিং ও এআইয়ের যুগেও তথ্য-উপাত্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বাহাস সত্যিই হাস্যকর। সবকিছুতেই চ্যাম্পিয়ন হতে হবে, পদক পেতে হবে কেন? কেনই–বা বাম্পার ফলন আর রেকর্ড উৎপাদন সেলিব্রেশন করতে হবে প্রতিবছর? ট্রেড ও ট্যারিফ যুদ্ধের বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকতে হলে ডেটা ইনিটিগ্রিটি খুব দরকার। চাল উৎপাদনের ভুল তথ্য দিয়ে শক্তিশালী ‘রাইস পলিসি’ প্রণয়ন অত্যন্ত কঠিন হবে। ‘হালের গরু গোয়ালে না থাকলেও কেতাবে থাকতে হবে,’ এই দিন তো আর নেই। ইউএসডিএ অথবা এফএওর রিপোর্টের সঙ্গে আমাদের রিপোর্ট মিলে না। বাম্পার উৎপাদনও হবে আবার বিশ্ববাজারে আমদানির ঝুলি নিয়ে যেতে হবে—এ কেমন কথা?

ভবিষ্যতে ‘রাইস সিকিউরিটি’ পরিকল্পনা প্রণয়নের ধান চাষের আওতায় জমির সঠিক পরিমাণ জানা খুব জরুরি। ধানের পাশাপাশি পেঁয়াজ, আলু, তৈল–জাতীয় ফসল, ভুট্টা, পশুখাদ্য ফসল সত্যিকারের কত হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান থাকা অত্যাবশ্যক। কাজেই ম্যানুয়াল পদ্ধতি, জিআইএস, ক্রপিং সিস্টেম বিশ্লেষণ ও ভূমি ব্যবহারের ধারা বিবেচনায় নিয়ে ধান চাষের আওতায় জমির সঠিক পরিসংখ্যান উপস্থাপনের সময় এখনই।

ড.

মো. রওশন জামাল কৃষিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর স খ য ন ব যবহ র ব কল প দশম ক উৎপ দ আমদ ন য ফসল ফসল র

এছাড়াও পড়ুন:

‘তামাকে প্রতিদিন ৪৪২ মৃত্যু, এসডিজি অর্জনে বড় বাধা’

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ তামাক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিদিন ৪৪২জন মানুষ মারা যায়। তামাক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অসংক্রামক রোগে মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনাসহ এসডিজির অন্যান্য লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।

অবিলম্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণের দাবি জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদ, চিকিৎসক, অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা। আইন শক্তিশালী করতে যত দেরি হবে তামাকজনিত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি ততই বাড়বে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।

বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) আয়োজিত ‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়নে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণ: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব বিষয়ে আলোচনা করেন।

আরো পড়ুন:

গোপালগঞ্জে নারীসহ ২ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার

সাড়ে ৬ কেজি হেরোইন উদ্ধার, কারবারি গ্রেপ্তার

গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়, ২০১৫ সালে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) গৃহীত হয় যেখানে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য ডব্লিওএইচও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-এর বাস্তবায়ন সরকারসমূহের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম ১ম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০৩ সালে এফসিটিসি স্বাক্ষর করে।

গোলটেবিল বৈঠকে আরো জানানো হয়, তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু এবং অসুস্থতা শুধু এসডিজির ৩য় লক্ষ্যমাত্রা-সুস্বাস্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রেই বাধা নয়, বরং অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনেও বাধা হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারী পরিবারগুলোর মাসিক খরচের ৫ শতাংশ তামাক ব্যবহারে এবং ১০ শতাংশ তামাক ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হয়। তামাক ব্যবহারের স্বাস্থ্য ব্যয় ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তামাকের কারণে দরিদ্র মানুষ, আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে, যা এসডিজির দারিদ্র্য নির্মূল সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা-১ অর্জনে বড় বাধা।

তামাক চাষে বছরে ব্যবহৃত হয় এক লক্ষ একরের বেশি জমি, যা দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির (লক্ষ্যমাত্রা-২) জন্য ক্রমশ: হুমকি তৈরি করছে। তামাক পাতা পোড়াতে এবং প্রক্রিয়াজাত করতে উজাড় হচ্ছে দেশের ৩০ শতাংশ বন। বিড়ি এবং জর্দা-গুল তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে নারী ও শিশুশ্রম। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়া সিগারেটের অবশিষ্টাংশসহ পলিথিনের মোড়ক ও জর্দা-গুলে ব্যবহৃত প্লাস্টিক কৌটা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছে। এভাবে তামাকের উৎপাদন এবং ব্যবহার টেকসই উন্নয়নের প্রায় সবকটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “নারী শিশুসহ অধূমপায়ীদের সুরক্ষায় শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আইন শক্তিশালীকরণের কোন বিকল্প নেই ।”

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, “তামাক ক্যানসার, হৃদরোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। এসডিজির লক্ষ্য পূরণে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।”

স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস)-এর রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, “কোম্পানিগুলো আইন শক্তিশালীকরণের সাথে রাজস্ব আয় হারানোর যে যুক্তি দেখায় তার কোনো ভিত্তি নেই। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের চিত্রে এটি প্রমাণিত। তবে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের চিন্তা করতে হবে কিভাবে তামাক রাজস্বের নির্ভরতা কমিয়ে অন্য খাতগুলো থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানো যায়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, “জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করতে হবে। এতে জনগণ ও সরকার উভয়ই লাভবান হবে।”

চিকিৎসক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেন, “শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থায় মনোযোগ না দিয়ে রোগের কারণ চিহ্নিত করে প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।”

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. অনুপম হোসেন বলেন, “তরুণদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করছি। এটির স্বাস্থ্য ক্ষতি তামাকের মতোই। আইন সংশোধনের মাধ্যমে এগুলো নিষিদ্ধ করতে হবে।”

এনটিভির হেড অফ নিউজ জহিরুল আলম বলেন, “তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের গণমাধ্যম খুবই শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। খসড়া সংশোধনী দ্রুত পাস করতে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।”

গোলটেবিল বৈঠকে আরো বক্তব্য রাখেন আত্মা’র কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন ও প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়েরসহ বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানে প্ল্যাকার্ড হাতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রতি সমর্থন জানায় প্রত্যাশা ইয়ুথ ক্লাবের সদস্যবৃন্দ। আত্মা’র কো-কনভেনর নাদিরা কিরণের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল উপস্থাপনা তুলে ধরেন প্রজ্ঞা’র তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার।

বাংলাদেশে ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করেন। তামাকের সার্বিক ক্ষতি বিবেচনা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০২১ সালে এফসিটিসি-এর আলোকে আইন শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ নেয়। বর্তমানে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন উপদেষ্টা কমিটি খসড়া সংশোধনীতে প্রয়োজনীয় পরিমার্জনের কাজ করছে। খসড়াতে সকল পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান রাখার বিধান বিলুপ্তকরণ, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য বা প্যাকেট প্রদর্শন নিষিদ্ধ, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধকরণ, খুচরা বা খোলা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ, ই-সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ এ ধরনের সব পণ্য উৎপাদন, আমদানি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করাসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ঢাকা/হাসান/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ