শিক্ষার্থীদের থামানোর কি কোনো উপায় নেই
Published: 24th, April 2025 GMT
২২ এপ্রিল ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত সাতজন আহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবে আহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বেশি। একই সঙ্গে সেদিন সিটি কলেজে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এ রকম ঘটনা এই এলাকায় কিছুদিন পরপরই ঘটে। শিক্ষার্থীদের সংঘাতে মাঝেমধ্যে যুক্ত হয় আইডিয়াল কলেজের নাম। এই তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তো বটেই, এমনকি স্থানীয় ব্যবসায়ী ও গাড়ির চালক–সহকারীদের সঙ্গেও শিক্ষার্থীদের মারামারির ঘটনা ঘটে।
খুব যে বড় কোনো কারণ থেকে এসব সংঘাত-সংঘর্ষের সূচনা হয়, তা কিন্তু নয়। কিন্তু সংঘাতের কারণে প্রায়ই সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে নিউমার্কেট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। কলেজ তিনটি কাছাকাছি বলে এসব সংঘাত এড়ানোর উপায় থাকে না। এলাকাটি একটি ব্যবসাকেন্দ্র হওয়ায় সংঘর্ষের সময় এখানে আসা ক্রেতাদের আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। এলাকার আশপাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক ছোট-বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সংঘর্ষের কারণে সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-অভিভাবকদেরও সমস্যায় পড়তে হয়। একই কারণে এখানকার আবাসিক এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
আমাদের খেয়াল রাখা দরকার, সংঘাত-সংঘর্ষ যদি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হয়, তবে এসব দেখতে দেখতে ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরাও সংবেদনশীলতা হারাবেএবারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে বোঝার চেষ্টা করেছি, কীভাবে এর সুরাহা হতে পারে। কিন্তু কোনো কলেজের শিক্ষকেরাই আশার কথা শোনাতে পারেননি। তাঁদের কথা, এমন ঘটনা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। মীমাংসার জন্য বিভিন্ন সময় কলেজ কর্তৃপক্ষ আলোচনায় বসেছে। নানাভাবে প্রতিকারের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ যখন ছাত্রদের হাতে, তখন এসব ঘটনা কোনোভাবেই থামানো সম্ভব হয়নি।
প্রতিবারই দেখা যায়, ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করলে পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে কলেজগুলো বন্ধ ঘোষণা করার অসংখ্য নজিরও আছে। এভাবে কিছুদিন পরপরই পুরোনো কিংবা নতুন কোনো কারণে তাঁদের মধ্যে আবার সংঘাত বেধে যায়।
শিক্ষকেরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গ্রুপে একতাবদ্ধ থাকেন। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ বা এ–জাতীয় কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে তাঁরা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন। যখনই কোনো ঘটনার কথা এসব মাধ্যমে অন্যরা জানতে পারেন, তখনই তাঁরা বিরুদ্ধ পক্ষের ওপর হামলার প্রস্তুতি নেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমস্যার শুরু হয় ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে। সামান্য কথা–কাটাকাটি একপর্যায়ে হাতাহাতি ও মারামারিতে রূপ নেয়। প্রেম, ইভ টিজিং বা এ–জাতীয় সমস্যা থেকেও ঘটনার সূত্রপাত হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি আক্রমণাত্মক বক্তব্য বা কমেন্ট তাঁদেরকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। সবচেয়ে বড় কথা, এসব শিক্ষার্থীর বয়সটাই এমন যে তাঁর নিজের পক্ষেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুনকলেজ কর্তৃপক্ষের কি কোনো দায় নেই৬ ঘণ্টা আগেগাড়ির চালক বা সহকারীরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছেন, গাড়ির ভাড়া নিয়ে সমস্যা হয় বেশি। শিক্ষার্থীরা ছুটির দিনেও হাফ ভাড়া দেন, এমনকি ছাত্রত্বের প্রমাণ হিসেবে পরিচয়পত্র দেখান না। বিপরীতে শিক্ষার্থীদের কথা, সব সময়ের জন্যই তাঁরা হাফ ভাড়া দিতে চান। আবার, মার্কেটের দোকানদারদের সঙ্গে জিনিসের দরদাম করা থেকে শুরু করে বিচিত্র কারণে সমস্যা হয়। এর জবাবে শিক্ষার্থীরা তাঁদের সঙ্গে দোকানদারদের দুর্ব্যবহার করার কথা বলেন। ছাত্রদের বিরুদ্ধে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।
এখন জিজ্ঞাসা, যে সংঘাত জীবনের জন্য হুমকি তৈরি করে, যে সংঘাত শেষ পর্যন্ত ক্ষতি ও ক্ষয় ছাড়া আর কিছু দেবে না, সে সংঘাত নিরসনের উপায় কী। কলেজের শিক্ষকেরা ছোট ছোট ঘটনা সামাল দিতে সক্ষম হন বলে দাবি করেছেন।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা সংখ্যায় বেড়ে গেলে তাঁদের পক্ষেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। ঢাকা কলেজের ৯টি আবাসিক হোস্টেলে দুই হাজারের মতো শিক্ষার্থী থাকেন। ক্লাস চলাকালে আরও অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে অবস্থান করেন। আবার সিটি কলেজে একই সঙ্গে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ক্লাস করেন। ঘটনা শুরু হলে দুই পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দল ভারী করতে তাই সমস্যা হয় না।
তবে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি, তাঁরা কেবল নিজেদের পক্ষেই যুক্তি তুলে ধরছেন। অর্থাৎ শিক্ষকদের পর্যায়েও পারস্পরিক বিদ্বেষ আছে। প্রকারান্তরে শিক্ষার্থীরা এখান থেকেও সংঘর্ষে উৎসাহিত হচ্ছে। তাই সমস্যার সমাধান চাইলে এখান থেকেই শুরু করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হলে আগে শিক্ষকদের মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নিয়মিত বসতে হবে। নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ ও আচরণ বিষয়ে নিয়মিত তাঁদেরকে কাউন্সেলিং করতে হবে। পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা–সহায়ক কার্যক্রমে যুক্ত রাখতে হবে। তা ছাড়া আন্তকলেজ পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে কলেজগুলো পরস্পরকে আমন্ত্রণ জানাতে পারে। কোনো কোনো অনুষ্ঠান একসঙ্গে করা যায় কি না, এটাও ভাবা যায়।
কেবল এই তিন কলেজ নয়, দেশের অন্যান্য কলেজও এ রকম গঠনমূলক ও সৃজনশীল অনুষ্ঠান ও আয়োজনে পরস্পরকে যুক্ত করতে পারে। এরপরও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। সে ক্ষেত্রে দায়ী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কলেজ প্রশাসন থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। সংঘাতের কারণ ও সূত্র উদ্ঘাটনের জন্য এই এলাকা নিবিড়ভাবে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা প্রয়োজন। আমাদের খেয়াল রাখা দরকার, সংঘাত-সংঘর্ষ যদি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হয়, তবে এসব দেখতে দেখতে ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরাও সংবেদনশীলতা হারাবে।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কল জ র শ ক ষ র জন য স ঘর ষ সমস য ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
দেশের বিভিন্ন স্থানে ফ্যাসিস্টদের গলার স্বর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে: রিজভী
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পলাতক কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের গলার স্বর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, দেশের জনগণের পাচার করা টাকা পতিত স্বৈরাচারের ‘টনিক’ হিসেবে কাজ করছে। শেখ হাসিনার একটি ভরসা হচ্ছে পাচার করা টাকা। সেই টাকার জোরে দেশে নানা ঘটনা ঘটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাচ্ছে। একটি প্রবাদ আছে ‘টাকায় কথা কয়’ শেখ হাসিনা এই প্রবাদটি কাজে লাগাতে চাচ্ছে।
অপরাধী আওয়ামী নেতাদের জামাই আদরে আদালতে হাজির করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন রিজভী। তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছর বিভিন্ন পাতানো মামলায় বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা ও আলেম-ওলামাকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে তোলা হয়েছিল। আর এখন কারাগারে ভয়াবহ অপরাধী আওয়ামী নেতাদের জামাই আদরে আদালতে হাজির করা হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হাসিনার অলিগার্করা ‘শর্ষের ভিতর ভূত’ হয়ে থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির এই নেতা বলেন, ভারতে পলাতক হাসিনা একের পর এক হুংকার দিচ্ছেন। জুলাই-আগস্টের শাজাহান খান গংরা আদালতে এসে সরকারকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। আদালতকে ভেংচি কাটছেন। পুলিশকে থোড়াই কেয়ার করছেন। হাসিনার দোসররা আসামি হয়েও আদালতে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছেন, তা মূলত অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অকার্যকর’ প্রমাণের এক গভীর চক্রান্ত।
রিজভী বলেন, দীর্ঘ রক্তঝরা আন্দোলনের অব্যবহিত পর থেকে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির প্রত্যাশার প্রতিফলন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি থাকলেও গণতন্ত্রকে মজবুত কাঠামো তৈরির প্রস্তুতির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তিনি বলেন, পতিত স্বৈরাচারের দোসর, খুনের আসামিরা প্রকাশ্যে আদালতে মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়া, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিচার চেয়ে বক্তব্য রাখেন। হাসিনার গণহত্যাকারী বাহিনীর নেতারা দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ভয়াবহ অপশাসনের জন্য ক্ষমা চাওয়া তো দূরে থাক, উল্টো আদালতে হুমকি দিচ্ছেন। হাজারো শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আরও বড় ফ্যাসিস্ট হয়ে ফিরে আসার হুমকি দিচ্ছেন।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, মাফিয়া অর্থনীতির জোরে শেখ হাসিনা দেশের যে সম্পদ পাচার করেছেন, সেই সম্পদের মুনাফা দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চান। পতিত ফ্যাসিবাদের বড় বড় দোসররা অনেকেই প্রশাসনের হেফাজতে ছিলেন, কিন্তু তাঁরা কীভাবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন? নিশ্চয়ই এখনো প্রশাসনের মধ্যে অনেকেই ঘাপটি মেরে আছেন, ফ্যাসিবাদের খুনি দোসরদের সহযোগীরা।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।