বান্দরবানে মারমা জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব ‘সাংগ্রাইং’ শেষ হবে শনিবার মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসবের মধ্য দিয়ে। শহরের বালাঘাটা এলাকায় দিনব্যাপী এই উৎসবে একে অপরকে পানি ছিটিয়ে বন্ধনের বার্তা ছড়িয়ে দেবে মারমা সম্প্রদায়।

‘মৈতা রিলং পোয়ে’ নামে পরিচিত এই পানির উৎসবে থাকবে বয়স্ক পূজা, তৈলাক্ত বাঁশে ওঠা, পাহাড়ি পিঠা উৎসব এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি।

বান্দরবান, রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ির মারমা জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি কক্সবাজারের রাখাইনদের মাঝেও এই উৎসব পালিত হয়। সাংগ্রাইং উৎসব শুরু হয়েছিল ১৫ এপ্রিল, এবং জেলা শহরে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় পরদিন রাজার মাঠে। 

মারমা সমাজের প্রবীণরা জানান, বুদ্ধমূর্তি স্নানের আগে পানি বর্ষণের আয়োজন করা হয় না— এটি একটি ধর্মীয় রীতি। প্রবীণ শিক্ষাবিদ থোয়াইংচ প্রু মারমা বলেন, “পানি মারমা সংস্কৃতিতে অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ। এটি ধর্মীয় এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতীক।”

বাংলাদেশ উদীচি শিল্পীগোষ্ঠীর বান্দরবান জেলা স্যসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ক্যসামং মারমা বলেন, আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে মৈতা রিলং পোয়ে ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে। 

এই উৎসবটির উৎপত্তি ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি, যখন কিছু মারমা যুবক মিয়ানমার থেকে এই ঐতিহ্য দেখে দেশে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭৪ সালে বান্দরবান শহরে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসব পালিত হয়।

মারমা শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি চথুই প্রু মারমা বলেন, মারমাদের মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসবে "সাংগ্রাইংমা ঞি ঞি ঞা ঞা রিকোজাই পামে" (এসো হে সাংগ্রাইংয়ে মৈত্রী পানি বর্ষণে) এই গানটি দীর্ঘদিন ধরে উৎসবের প্রধান গান হয়ে আছে। এই গানটির গীতিকার ও সুরকার ছিলেন প্রয়াত উপঞা জোত মহাথের। যিনি উ চ হ্লা ভান্তে নামে অধিক পরিচিত। 

আগের দিনে তরুণ-তরুণীরা প্রবীণদের পানি দিয়ে স্নান করিয়ে আশীর্বাদ গ্রহণ করতেন। সেই টাকা দিয়ে তৈরি হতো উৎসবের পিঠা। সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে উৎসবের ধরন, তবে অপরিবর্তিত রয়েছে তার সৌহার্দ্য ও ঐতিহ্যবাহী তাৎপর্য।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব ন দরব ন ব ন দরব ন উৎসব র

এছাড়াও পড়ুন:

ভেড়াডহর গ্রামে উরিগানের আসরে

এক পক্ষে প্রায় ৫০০ মানুষ। আরেক পক্ষে অন্তত ৭০০। চলছে পাল্টাপাল্টি গানের লড়াই। তা দেখতে জড়ো হয়েছেন আরও হাজারো নারী-পুরুষ। মধ্যচৈত্রের চামড়াপোড়া গরমে শিল্পী-দর্শনার্থী সবাই দরদর করে ঘামছেন। কিন্তু বিরামহীনভাবে দুই পক্ষই পাল্লা দিয়ে গান গাইছে। কোনো পক্ষই অন্য পক্ষকে ‘বিনা যুদ্ধে’ ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’ ছাড় দিতে নারাজ!

ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এমন গানের লড়াই চলে সুনামগঞ্জের হাওর-অধ্যুষিত শাল্লা উপজেলার ভেড়াডহর গ্রামের নতুন হাটিতে। সেদিন ছিল ১৪৩১ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র। খ্রিষ্টাব্দের হিসাবে ২৮ মার্চ ২০২৫। খুব সকালে সিলেট থেকে রওনা দিই। সঙ্গী ছিলেন বন্ধু প্রদীপ রঞ্জন বৈষ্ণব ও সংবাদকর্মী দীপ্ত বৈষ্ণব। প্রদীপের গ্রামের বাড়ি মুছাপুর। তাদের গ্রামের পাশেই ভেড়াডহর। মূলত প্রদীপের আমন্ত্রণেই সেখানে উরিগান দেখতে যাওয়া।

হিন্দুধর্মীয় উৎসব দোলযাত্রাকে উপলক্ষ করে বসন্তকালে গাওয়া হয় উরিগান। এসব গান ‘হোরিগান’ বা ‘দোলের গান’ নামেও পরিচিত। বিশেষত সুনামগঞ্জের শাল্লা, দিরাই ও জগন্নাথপুর, হবিগঞ্জের বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন আর নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলায় উরিগানের প্রচলন বেশি। এর বাইরেও হাওরাঞ্চলের নানা গ্রামে দোল উৎসবে উরিগান গাওয়া হয়। তবে বৈষ্ণব ও কৈবর্ত সম্প্রদায়ভুক্তদের মধ্যে এ গানের চর্চা তুলনামূলকভাবে বেশি।

কবিগান কিংবা মালজোড়া গানের মতোই উরিগান হলো প্রতিযোগিতামূলক গান। পার্থক্য কেবল এটাই, কবিগান ও মালজোড়াগানের আসর বসে গ্রামীণ মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য, অন্যদিকে উরিগান পরিবেশিত হয় অনেকটা হিন্দুধর্মীয় আচার-রীতির অংশ হিসেবে। অবশ্য আরেকটু পার্থক্য রয়েছে, কবিগান ও মালজোড়া গানে মাত্র দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী পাল্টাপাল্টি গান-কথায় বাহাস জমান, বিপরীতে উরিগানে একেকটি পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কমসে কম কয়েক শ শিল্পী থাকেন! এমন বর্ণিল আর প্রাণবন্ত গানের ধারা সংগীত-সংস্কৃতিতে কমই আছে।

উরিগানকে সংগীতের একটি পরিচ্ছন্ন ধারা বলে মনে করা হয়ে থাকে। এ গানের চারটা পর্ব রয়েছে—ঝুমুরগান, লাসগান, চাইলগান ও চলতিগান। এসব মূলত নারীবর্জিত গানের ধারা। পুরুষেরাই নৃত্যসংবলিত এ গানের শিল্পী। বাড়ির উঠানে কিংবা মাঠে সমবেতভাবে কয়েক শ শিল্পী একই সঙ্গে এ গান পরিবেশন করেন। এক পক্ষের পরিবেশনার পর অপর পক্ষ একই আঙ্গিকের পাল্টা গান পরিবেশন করেন। এভাবেই দিনভর গান শেষে উপস্থিত দর্শনার্থীদের বেশির ভাগের মতামতের ভিত্তিতে একটি পক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। নারীরা উরিগানে অংশ না নিলেও শ্রোতা হিসেবে তাঁদের অংশগ্রহণ ঠিকই থাকে।

২.

ভেড়াডহর গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের দুপুর হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য গ্রামটিতে পৌঁছার আগেই প্রদীপের সুবাদে প্রাথমিক অনেক তথ্য জানা হয়ে যায়। যেমন ভেড়াডহর গ্রামবাসীর আমন্ত্রণে পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার কবিরপুর গ্রামের বাসিন্দারা উরিগান গাইতে ভেড়াডহরে এসেছেন। রীতি অনুযায়ী এক গ্রামের মানুষ আরেক গ্রামের মানুষকে উরিগান গাইতে আমন্ত্রণ জানান। সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে নির্দিষ্ট ওই গ্রামের পুরুষদের প্রায় সবাই সাতসকালে গাইতে আসেন।

পরম্পরা অনুযায়ী কবিরপুর গ্রামের মানুষেরাও সেদিন সাতসকালে ঝুমুরগান গাইতে গাইতে নিজেদের গ্রাম থেকে ভেড়াডহর গ্রামে প্রবেশ করেন। ভেড়াডহর গ্রামে ঢুকে ঝুমুরগান গেয়ে তাঁরা মূলত নিজেদের উপস্থিতি জানান দেন। দুপুরে পৌঁছার কারণে সে আনুষ্ঠানিকতা আমাদের দেখা হয়নি, তবে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মানুষের আলাপ থেকে তা ঠিকই জেনে যাই। আমরা যখন গ্রামটিতে পা রাখি, ততক্ষণে লাসগানের পরিবেশনা শুরু হয়েছে।

হিন্দি-বাংলামিশ্রিত লাসগান মগ্ন হয়ে গাইছেন কবিরপুর গ্রামের শিল্পীরা। লাসগান শেষ করেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে কয়েক শ মানুষ সমবেত কণ্ঠে চাইলগান পরিবেশন করেন। চাইলগানে নৃত্যসংবলিত শারীরিক কসরতের পাশাপাশি শিল্পীরা দুই হাত ওপরে তুলে হর্ষধ্বনিসহযোগে লাফানোর মতো করে অনবদ্য এক দৃশ্যের জন্ম দেন। তাঁদের পরিবেশনার পর একই রকমভাবে ভেড়াডহরের গ্রামবাসীও গানে গানে কবিরপুরবাসীকে পাল্টা জবাব দেন।

শিল্পীরা জানান, ভেড়াডহরের লোকেরা উরিগানের আয়োজক হওয়ায় রীতি অনুযায়ী তাঁরা রাইপক্ষ, আর কবিরপুরের মানুষ আমন্ত্রিত দল হওয়ায় তাঁরা শ্যামপক্ষ। সে ধারা মোতাবেকই গান পরিবেশিত হয়।

উরিগান উপলক্ষে এভাবেই সাজানো হয়েছিল দোলবেদি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সহজ-সরল পাত্রী, বিয়ে করতে এসে পাত্র দেখলেন উল্টো চিত্র
  • পাত্রী সহজ সরল ও কম কথা বলে, বিয়ে করতে এসে পাত্র দেখলেন উল্টোচিত্র
  • আর্সেনালের ড্র, শিরোপা উৎসবের অপেক্ষায় লিভারপুল
  • লোকনৃত্য, দেব আরাধনে শুরু লাই-হরাউবা
  • কানের ইতিহাসে এবারই প্রথম
  • অষ্টগ্রামের বিস্তীর্ণ হাওরের বুকে ধান কাটার উৎসব
  • এবার রিশাদের ২ উইকেট ও ২ রান, রান উৎসবের ম্যাচে হেরে গেল লাহোর
  • ভেড়াডহর গ্রামে উরিগানের আসরে
  • এমপিওভুক্ত পৌনে ৫ লাখ শিক্ষকের বোনাস বাড়ছে