ঘূর্ণিঝড়ের নতুন বিপদে বাংলাদেশ, ঝুঁকি বাড়তে পারে ১০ গুণ
Published: 24th, April 2025 GMT
সাগরপাড়ের বাসিন্দা আবদুল গফুরের (৫৬) কাছে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা নতুন কিছু নয়। জন্মের পর থেকেই এসব দুর্যোগ দেখে আসছেন তিনি। কিন্তু এখন যেভাবে জলোচ্ছ্বাস কিংবা সাগরের ঢেউয়ে বসতভিটা বা জমিজিরাত নষ্ট হচ্ছে, আগে তেমনটা দেখেননি।
আবদুল গফুরের বাড়ি কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের জালিয়াপাড়া গ্রামে। তিনি মৎস্যজীবী। এই গ্রামে অন্তত দুই হাজার মানুষের বসবাস। বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষা এ গ্রামের পশ্চিমে কোহেলিয়া নদী।
কয়েক বছর ধরে এ গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে গত পাঁচ বছরে এ গ্রামে বসতবাড়ি হারিয়েছে অন্তত ১০০ পরিবার। বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে তাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। ফলে বসতবাড়ি হারিয়ে গ্রামের অনেকেই এখন পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। গফুরও ঘরবাড়ি হারিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে নতুন শঙ্কার জানান দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আর্থ, অ্যাটমোস্ফিয়ারিক এবং প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের একদল গবেষক।গৃহহারা ১০০ পরিবারের মধ্যে আছেন গ্রামের মৎস্যজীবী নূর হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক যুগ ধরে তাঁরা ওই গ্রামে বসবাস করছেন। বর্ষার মৌসুমে জলোচ্ছ্বাসের সময় তাঁদের ঘরবাড়িতে আগে তেমন পানি উঠত না। কিন্তু পাঁচ-ছয় বছর ধরে জলোচ্ছ্বাস নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই একবার বড় জলোচ্ছ্বাসের কবলে তাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। এখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকছেন।
স্থানীয় মাতারবাড়ী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে এই জালিয়াপাড়া। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আলীর কথা, বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করলে সামনে আরও শ দুয়েক পরিবার তাদের বসতবাড়ি হারাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঝড়ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের, বিশেষ করে উপকূলের মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়। এর সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে শিখেছেন এসব অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃতি যেন বেশি বৈরী। জালিয়াপাড়া গ্রামের মানুষ শুধু নয়, এমন অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের দীর্ঘ উপকূলে থাকা অনেক মানুষের।
গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আগে যে ধরনের বড় ঝড় ১০০ বছরে একবার হতো, এখন তা ১০ বছরেই হতে পারে। এই ঝুঁকি অঞ্চলভেদে ও মৌসুমভেদেও ভিন্ন হতে পারে।বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের কথা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে নতুন শঙ্কার জানান দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আর্থ, অ্যাটমোস্ফিয়ারিক এবং প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের একদল গবেষক।
গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আগে যে ধরনের বড় ঝড় ১০০ বছরে একবার হতো, এখন তা ১০ বছরেই হতে পারে। এই ঝুঁকি অঞ্চলভেদে ও মৌসুমভেদেও ভিন্ন হতে পারে।
দেশে বাড়ছে এসব ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কাও। বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি ১০ গুণ বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু নিয়ে আরও শঙ্কা আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতে প্রাক্-মৌসুমি বা মৌসুমি বায়ু পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের প্রবণতা বাড়তে পারে। এতে অসময়ে প্লাবিত হবে নতুন নতুন এলাকা ও কৃষিজমি। দেশের উপকূলীয় এলাকায় কৃষি এবং সার্বিকভাবে জনজীবনে এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ুঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশের এই ভয়ানক ভবিষ্যতের চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ান আর্থ নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে। ১১ এপ্রিল এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) সদস্য ও বুয়েটের পানিসম্পদ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন এ গবেষণায় যেদিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা আমাদের নতুন দিকের সন্ধান দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আমরা যেসব পরিকল্পনা করছি, তাতে এ গবেষণার ফলাফল ব্যাপক সহায়তা করবে। আমাদের অভিযোজন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে—এ গবেষণা সেই দিকেরই নির্দেশ দিচ্ছে।’
বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ুঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশের এই ভয়ানক ভবিষ্যতের চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ান আর্থ নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে। ১১ এপ্রিল এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।কেন এই গবেষণা
এ কথা এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশের অবস্থান এমন একটি ভৌগোলিক স্থানে যেখানে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। এটি নিচু বদ্বীপ অঞ্চল। এখানে আছে ফানেল আকৃতির উপকূল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, তীব্র ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাত—বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিক প্রকট করছে।
নতুন এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম তথ্য-সংকটাপন্ন কিন্তু দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। বৈজ্ঞানিকভাবে, বাংলাদেশ হলো জটিল ও ক্রমিক দুর্যোগ বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
এমআইটির এই গবেষকদের একজন এবং প্রতিষ্ঠানটির আর্থ, অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাই জ্যান্ডার সাভেলা প্রথম আলোকে ই-মেইলে বলেন, ‘বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঝুঁকির মুখোমুখি, তা সর্বোচ্চ মানের মডেলিং, সর্বোত্তম বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং জরুরি সহযোগিতা দাবি করে। আমরা এখানে যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছি, তা কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন, ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য সমমানের বদ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর জন্যও প্রাসঙ্গিক হবে।’
নতুন এ গবেষণায় যেদিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা আমাদের নতুন দিকের সন্ধান দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আমরা যেসব পরিকল্পনা করছি, তাতে এ গবেষণার ফলাফল ব্যাপক সহায়তা করবে। আমাদের অভিযোজন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে—এ গবেষণা সেই দিকেরই নির্দেশ দিচ্ছেআইপিসিসি সদস্য ও বুয়েটের পানিসম্পদ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলামএ উপমহাদেশের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগের কথা উল্লেখ করে সাভেলা বলেন, ‘যদিও আমি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং সেখানে কাজ করি, তবে আমি ভারতের সন্তান এবং বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের সঙ্গে আমার গভীর শিকড় রয়েছে। এ অঞ্চল আমার জন্য বৈজ্ঞানিক এবং ব্যক্তিগত—উভয় দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে পেরে আমি অপার আনন্দ ও শক্তি অনুভব করি।’
গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হলো: ভবিষ্যতের ঝুঁকি বোঝার জন্য শুধু অতীতের পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করা যাবে না। জলবায়ু ইতিমধ্যেই পরিবর্তিত হচ্ছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুনরাবৃত্তির হার বাড়ছে। আমাদের গবেষণার ফলাফল দেখায়, যেসব ঝড়-জোয়ারকে আগে ১০০ বছরে একবারের ঘটনা বলে ধরা হতো, সেগুলো এই শতাব্দীর শেষের দিকে প্রতি ১০ বছর বা তারও কম সময়ে একবার করে ঘটতে পারে।’
কীভাবে হলো গবেষণা
এ গবেষণায় একটি সমন্বিত বিশ্লেষণ ও জলগতিশীলতা মডেল (হাইড্রোডাইনামিক) ব্যবহৃত হয়েছে। তিনটি প্রধান বিষয়কে কেন্দ্র করে এই বিশ্লেষণগুলো করা হয়েছে। সেগুলো হলো কৃত্রিম ঘূর্ণিঝড় বিশ্লেষণ, জলোচ্ছ্বাসের জলগতিশীলতা সিমুলেশন এবং পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণ।
গবেষণায় প্রথমে একটি কৃত্রিমভাবে তৈরি ঘূর্ণিঝড় ট্র্যাক সেট ব্যবহার করা হয়েছে। যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন ঘূর্ণিঝড়ের স্বাভাবিক প্রবণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাংলাদেশের জলোচ্ছ্বাসে কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সৈকতের বালিয়াড়ি ভেঙে আবাসিক এলাকার ঘরবাড়িতে ঢুকছে পানি। ২০২৩ সালের মে মাসে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ঘ র ণ ঝড় র র জন য আম দ র নত ন এ পর ব র সবচ য় জলব য় উপক ল সদস য একব র ধরন র বলছ ন র ঘরব
এছাড়াও পড়ুন:
মাইক্রোবাসে বিস্ফোরণ, অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন ৫ ছাত্রনেতা
রাজশাহীতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে একটি মাইক্রোবাস পুড়ে গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাঁচ ছাত্রনেতা মাইক্রোবাসে ছিলেন। অল্পের জন্য তারা প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজশাহী নগরের কাজীহাটা এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মাইক্রোবাসটি জেলার গোদাগাড়ী থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করেছিল। পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী জেলার সদস্য সচিব মো. রহমতুল্লাহ জানান, যে পাঁচজন গাড়িটিতে ছিলেন, তারা জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। সবার বাড়ি গোদাগাড়ী। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সহায়তা পেতে তারা ফরম নিয়ে গোদাগাড়ী থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন।
আরো পড়ুন:
বিএনপি নেতার বাড়ির সামনে ককটেল বিস্ফোরণ
কৃষি জমিতে ‘বোমা বিস্ফোণ’, কৃষক আহত
নগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল ইসলাম জানান, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলেই সবাই গাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় মুহূর্তের মধ্যেই গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নেভান। এর আগেই গাড়িটি পুড়ে যায়।
ঢাকা/কেয়া/বকুল