ছিনতাই মামলা থেকে কী কারণে বেরিয়ে যেতে পারছেন আসামিরা
Published: 24th, April 2025 GMT
রাজধানীর মিরপুরে মুঠোফোন ছিনতাই করে পালানোর সময় এক ব্যক্তিকে ধরে ফেলে স্থানীয় জনতা। মারধরের পর তাঁকে হস্তান্তর করা হয় মিরপুর মডেল থানার পুলিশের কাছে। পুলিশ তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। পরে এ ছিনতাইয়ের ঘটনায় নিয়মিত মামলা না করে আগের এক মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
নিয়মিত মামলা না করা এবং আহত আসামির চিকিৎসার তথ্য আদালতকে না জানানোয় মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে আসামির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ছিনতাইয়ের ঘটনার বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত করে নিয়মিত মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুনবেড়েছে ছিনতাই–অপহরণ, কমেছে ৩ ধরনের অপরাধ২২ মার্চ ২০২৫১৫ এপ্রিল ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো.
দস্যুতা (ছিনতাই) ও ডাকাতির ঘটনা নিয়ে রাজধানীবাসী আতঙ্কে রয়েছে। পুলিশও তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ছিনতাই-ডাকাতির মামলার আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়ে আবার একই ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছেন—পুলিশের মাঠপর্যায় থেকে এ ধরনের অভিযোগ করা হচ্ছিল। পরিস্থিতি বুঝতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিভিন্ন ইউনিটকে মামলা ও গ্রেপ্তারের পাশাপাশি আসামিদের মধ্যে কতজন জামিন পাচ্ছেন, সে হিসাবও দিতে বলা হয়।
আরও পড়ুনঢাকায় একের পর এক ছিনতাই, চলাচলে ভয়২২ ডিসেম্বর ২০২৪ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত রাজধানীতে ছিনতাইয়ের (দস্যুতা) ৩২০টি মামলায় ৮৫২ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চ পর্যন্ত আড়াই মাসে রাজধানীতে ছিনতাই, ডাকাতি ও দস্যুতার মামলায় গ্রেপ্তার অন্তত ১৫০ জন জামিন পেয়েছেন।
ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ আইনি প্রক্রিয়াগত ঘাটতির কারণে বাড়ছে। এ অবস্থা নাগরিকদের নিরাপত্তা-সংকটের মধ্যে ফেলছে। তিনি অপরাধীদের সাজা নিশ্চিতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের তাগিদ দেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হকসদর দপ্তরের একটি সূত্র বলছে, আসামিরা কোনো পক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে জামিন পাওয়ার পথ তৈরি করছেন কি না, তা খতিয়ে দেখতে মাঠপর্যায়ের পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অপরাধ অনুযায়ী মামলা না নিয়ে দুর্বল ধারায় মামলা হচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে নিয়মিত মামলা দিতে হবে। ভুক্তভোগী না পাওয়া গেলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।
মামলা বেড়েছে ৮২%পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দস্যুতা (ছিনতাই)-ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৫১টি, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮২ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য, প্রচলিত আইনে দস্যুতার ক্ষেত্রে আসামির সংখ্যা এক থেকে চারজন হয়ে থাকে। আর চারজনের বেশি ব্যক্তি দস্যুতার অপরাধে জড়ালে তা ডাকাতি হিসেবে গণ্য হয়।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশে কিছুদিন পুলিশি কার্যক্রম ছিল না। পরে তা ধীরে ধীরে চালু হয়; যদিও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সময় লেগেছে। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটতে থাকে। অবশ্য পুলিশ সক্রিয় হওয়ার পর এ ধরনের অপরাধ কমেছে। কিন্তু তারপরও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক রয়ে গেছে।
আরও পড়ুনঢাকায় ছিনতাইকারী ও ডাকাতেরা বেপরোয়া০২ নভেম্বর ২০২৪ছিনতাইকারীদের হাতে খুনের ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় ‘ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে’ মো. আরমান হোসেন (২২) নামের এক তরুণ নিহত হন। পরিবারের দাবি, ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় তাঁকে হত্যা করা হয়। আদালত সূত্র জানায়, এর আগে গত আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজধানীতে ছিনতাইকারীর হাতে সাতজন খুনের ঘটনা ঘটেছে।
সদর দপ্তরের একটি সূত্র বলছে, আসামিরা কোনো পক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে জামিন পাওয়ার পথ তৈরি করছেন কি না, তা খতিয়ে দেখতে মাঠপর্যায়ের পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অপরাধ অনুযায়ী মামলা না নিয়ে দুর্বল ধারায় মামলা হচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর।ছিনতাইয়ের ঘটনার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) চিত্রও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে আতঙ্ক বাড়ছে। যেমন রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় ইস্ট ওয়েস্ট স্কুলের পাশের গলিতে ১৮ এপ্রিল ভোররাতে চাপাতি ঠেকিয়ে এক তরুণীর কাছ থেকে রুপার চেইন ও ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনার ভিডিওচিত্র ছড়ানোর পর পুলিশ তৎপর হয়ে একজনকে গ্রেপ্তার করে।
মিরপুর থানা-পুলিশ গতকাল বুধবার জানায়, আর কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে চেষ্টা চলছে।
শুরুতে উল্লেখ করা মিরপুরের ছিনতাইয়ের ঘটনাটি ঘটে ১৪ এপ্রিল। সেদিন স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়েন মো. আকিব (২০) নামের ওই ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে থাকা আরেকজন পালিয়ে যান।
এ ঘটনায় কেন নিয়মিত মামলা করা হয়নি, কেন গ্রেপ্তার ব্যক্তির আহত হওয়ার তথ্য পুলিশের নথিতে নেই, তার ব্যাখ্যা দিতে থানার ওসি ও তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদেশে বলা হয়, যে ঘটনায় করা মামলায় আসামিকে (আকিব) গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি জড়িত নন বলে দাবি করেন। আসামি বলেছেন, তাঁকে অন্য ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ছিনতাইয়ের ঘটনার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) চিত্রও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে আতঙ্ক বাড়ছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাজ্জাদ রোমন ২০ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আকিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভুক্তভোগী না পাওয়ায় তাঁকে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ওসি জানান, এ মামলা নিয়ে আদালত যে ব্যাখ্যা চেয়েছেন, সেই ব্যাখ্যা তাঁরা দেবেন।
জামিয়ে বেরিয়ে আবার অপরাধেনাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের পর জামিনে বেরিয়ে তারা একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এমন হতে থাকলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে।
যেমন ২১ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর গুলশানে ওয়েস্টিন হোটেলের বিপরীতের রাস্তায় বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়কারী ব্যবসায়ীকে (মানি এক্সচেঞ্জার) কুপিয়ে কোটি টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যান ১০ থেকে ১২ জন দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী। মামলার প্রধান আসামি ইয়াসিন শিকদারসহ আটজনকে ছিনতাইয়ের এক লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এর ১১ দিনের মাথায় জামিনে বেরিয়ে যান ইয়াসিন। গুলশান থানার পুলিশ সূত্র জানায়, জামিনে বেরিয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়েছেন ইয়াসিন। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আকিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভুক্তভোগী না পাওয়ায় তাঁকে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাজ্জাদ রোমনপুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, মামলার গলদে যাতে কেউ জামিন না পান, তা ঠেকাতে পুলিশ উদ্যোগী হয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, ছিনতাই-ডাকাতিসহ সব ধরনের অপরাধের মামলায় জামিনের বিরোধিতা করা হয়। তবে অনেক দিন ধরে হাজতবাস, বয়স, অসুস্থতা বিবেচনায় কিছু আসামির জামিন দেন আদালত। পাশাপাশি চুরি-ছিনতাইয়ের কিছু মামলায় অনেককে সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ধরনের কিছু আসামির জামিন দেন আদালত।
ডিএমপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের পর জামিনে বেরিয়ে তারা একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এমন হতে থাকলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে।সাজা ‘নিশ্চিতের তাগিদ’কোনো শহরে অপরাধ বাড়তে থাকলে তা যেমন নগরজীবনে আতঙ্ক তৈরি করে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে। মানুষ সন্ধ্যার পর, রাতে এবং ভোরে বের হতে ভয় পান। আবার যাঁরা ছিনতাইয়ের শিকার হন, তাঁদের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ আইনি প্রক্রিয়াগত ঘাটতির কারণে বাড়ছে। এ অবস্থা নাগরিকদের নিরাপত্তা-সংকটের মধ্যে ফেলছে। তিনি অপরাধীদের সাজা নিশ্চিতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের তাগিদ দেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ধরন র অপর ধ গ র প ত র কর প রথম আল ক ত কর মকর ত অন য য় ছ নত ই ড এমপ ঘটন র ঘটন য় আতঙ ক
এছাড়াও পড়ুন:
মিরপুরে রাস্তায় ৮টি অবৈধ গেট উচ্ছেদ
রাজধানীর মিরপুর সেকশন-২ এর রূপনগর আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে নির্মিত আটটি গেট ভেঙে দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে পরিচালিত এই উচ্ছেদ অভিযানে রাস্তায় স্থাপিত গেটগুলো ভেঙে ফেলা হয়। এ ছাড়াও ফুটপাত ও সড়ক দখল করে গড়ে ওঠা শতাধিক দোকান ও হকার উচ্ছেদ করে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা দখলমুক্ত করা হয়েছে।
অভিযানকালে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা পরিচালনার দায়ে একটি ফার্নিচার ও একটি খাবারের দোকান মালিককে ৩ হাজার টাকা করে মোট ৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অভিযানটি পরিচালনা করেন ডিএনসিসির অঞ্চল-২ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াউর রহমান এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহীদুল ইসলাম।
সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘‘জনগণের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করতে নিয়মিতভাবে ফুটপাত ও রাস্তার অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আজকের অভিযানে অবৈধ গেটগুলো অপসারণ করা হয়েছে, যেগুলো কোনো অনুমতি ছাড়াই স্থাপন করা হয়েছিল এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছিল। অন্যান্য স্থানে নির্মিত অবৈধ গেট অপসারণেও অভিযান চলমান থাকবে।’’
ঢাকা/আসাদ/এনএইচ