জাতীয় ইস্যু করা যায়নি বলে রানা প্লাজার ঘটনার বিচার হয়নি: শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান
Published: 23rd, April 2025 GMT
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেছেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় বিচার না হওয়ার পেছনে প্রধান ব্যর্থতা হলো এটিকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করা যায়নি। যদি করা যেত, তাহলে ১৬ মাসেই ভুক্তভোগীরা বিচার পেতেন।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘রানা প্লাজা ভবন ধস: বিচারের অপেক্ষার এক যুগ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান এ কথাগুলো বলেন। মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক নিহত হন। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ১ হাজার ১৬৯ জন। এ ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলা করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়েও মামলা করে।
সভায় শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘১২ বছর আগে যে ভুক্তভোগীকে হুইলচেয়ার দেওয়া হয়েছে, সেই হুইলচেয়ার কি এখনো চলে? সেটা কি পরিবর্তন করা হয়েছে? এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি এটিকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করতে চাই।’
রানা প্লাজার ঘটনায় সত্য উদ্ঘাটন, জবাবদিহি, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্ব দেন ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমরা কী কী চেয়েছি? যাঁরা এই ঘটনায় দায়ী, ফৌজদারি আইনে তাঁদের সাজা চেয়েছি। আরেকটি চাওয়া হলো সত্য উদ্ঘাটন করা, রানা প্লাজা ধস কেন ঘটল।’
সারা হোসেন বলেন, ‘শুধু একজন এখানে দায়ী নন, অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। এই ভবনের অনুমতি কারা দিয়েছিল; সরকার বা রাষ্ট্রীয় কোন কর্তৃপক্ষ এতে জড়িত ছিল, সেই বিষয়গুলোর সুরাহা কিন্তু আমরা পাইনি।’
সারা হোসেন মনে করেন, বিচার প্রলম্বিত হওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা বড় কারণ। তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থ বিভাগ, বিচার বিভাগ, অন্যান্য মন্ত্রণালয়—একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছেন না।’
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘বিচারকে প্রলম্বিত করার দুটো পথ আছে। একটি হলো আসামির সংখ্যা বাড়িয়ে দাও, আরেকটি হলো সাক্ষীর সংখ্যা বাড়িয়ে দাও। রানা প্লাজার ঘটনায় আমরা সেটাই দেখেছি। এত বেশি সাক্ষী আর আসামি যে মামলা শেষই করা যাচ্ছে না। কৌশলে বিচারকে প্রলম্বিত করার যে প্রক্রিয়া, তা আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে।’
রানা প্লাজায় আহত ব্যক্তিদের কথা তুলে ধরে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আবুল হোসেন বলেন, ‘যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা তো একরকম বেঁচে গেছেন। ধুঁকে ধুঁকে মরছেন, যাঁরা পঙ্গু হয়ে গেছেন।’ তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার পর দেশি–বিদেশি বহু সাহায্য এসেছে, তার কতটুকু ভুক্তভোগী শ্রমিকেরা পেয়েছেন?’
এ সময় বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন আবুল হোসেন। সুপরাশিগুলো হলো, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রতিবেদন উন্মুক্ত করা, নিহত ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা বের করা, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে এখন পর্যন্ত কত টাকা দেওয়া হয়েছে তা উন্মুক্ত করা, রানা প্লাজার জমিতে আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, সাভারে সরকারিভাবে স্মৃতিফলক স্থাপন, মামলা পরিচালনার জন্য সম্মিলিত মনিটরিং কমিটি গঠন করা।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনার ভুক্তভোগী নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর থেকে যে শারীরিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা কাউকে বলতেও পারি না। আমি ১০ মিনিটও একসঙ্গে দাঁড়াতে পারি না, বসতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের খোঁজ নেয় না। ন্যায়বিচারটাও আমরা পাইনি। আমরা সুবিচার চাই। আমাদের ক্ষতিপূরণ চাই।’
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো.
মতবিনিময় সভার শুরুতে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ঘটন য় ন বল ন আম দ র ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
পারভেজ হত্যা: রাজনীতির বাইরের দিক
পারভেজের মা আহাজারি করেছেন– ‘পুতের মুহেত্তে একটাবার মা ডাক হুনবার চাই’। কিন্তু খুন হওয়া ছেলে তো আর মা ডাকার জন্য ফিরে আসবে না। গীতিকার মিল্টন খন্দকার লিখেছেন, ‘মা তুমি আমার আগে যেও না গো মরে’।
সেখানে ছেলের আহাজারি– ‘এই পৃথিবীর আলো আমায় যে দেখালো, তাকে মাটি দিবো কী করে’। আর এখানে মায়ের আকুতি একবারের জন্য ছেলের মুখ থেকে মা ডাক শোনার। মৃত্যু এমনই এক নির্মম বাস্তবতা, কোনো মায়ার বাঁধনেই তাকে বাঁধা যায় না। এটি এমনই এমন নিয়তি, কার আগে কে যাবে, তার ঠিক নেই। পারভেজ যেমন মায়ের আগেই চলে গেলেন।
জাহিদুল ইসলাম পারভেজ রাজধানীর প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, হাসাহাসির মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাঁকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পারভেজ ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রদল তাঁর হত্যার মদদদাতা হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে অভিযুক্ত করেছে। অন্যদিকে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
তুচ্ছ বিষয় কীভাবে খুনের কারণ হয়, তা নিয়েই বরং আলোচনা। তরতাজা এক তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করছিলেন– তার কারণ জানতে গিয়ে বাগ্বিতণ্ডা, এর পর ধাওয়া করে ছুরিকাঘাতে মেরে ফেলা! কতটা ভয়ংকর! পারভেজের বন্ধু তরিকুলকেও ছুরিকাঘাত করা হয়। এ ঘটনায় পারভেজের ভাই বনানী থানায় ৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন।
মামলার এজাহার থেকে জানা যাচ্ছে, পারভেজ তাঁর বন্ধু টেক্সটাইল বিভাগের তরিকুল, সুকর্ণ, ইমতিয়াজসহ কয়েকজন বনানীর প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে একটি দোকানে কথাবার্তা ও হাসাহাসি করছিলেন। তাদের পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের দুই ছাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় আসামি মেহেরাজ, পিয়াস ও মাহাথি হাসাহাসির কারণ জানতে চান। এ নিয়ে তর্কাতর্কি হলে তিন শিক্ষক বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। এর পর পারভেজকে পেয়ে আসামিরা ছুরিকাঘাত করেন। একইভাবে তরিকুলও আক্রান্ত হন। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় দু’জনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক পারভেজকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ হত্যাকাণ্ডে নারীসংশ্লিষ্টতার বিষয়ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট, সাধারণ বিষয় থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। আরও বিস্ময়কর, শিক্ষকরা প্রারম্ভিকভাবে শিক্ষার্থীদের মীমাংসার চেষ্টাও করেছিলেন। তার পরও আক্রমণকারীরা ক্ষান্ত হয়নি! তারা এতটা বেপরোয়া হলো কীভাবে? পুলিশ এ হত্যা মামলার প্রধান আসামি মেহেরাজ ইসলামসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিচার নিশ্চয় দেখার অপেক্ষা।
ইতোপূর্বে আমরা কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হওয়ার ঘটনা দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা পড়াশোনা করেন, অন্তত তাদের মধ্যে এক ধরনের ‘ম্যাচিউরিটি’ আসে। এমন সমবয়সী তরুণদের মধ্যে হাস্যরসের স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে এমন খুন অস্বাভাবিক। অবশ্য রাজনৈতিক বিবাদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে ইতোপূর্বে। দুই দলের মধ্যে কিংবা দলীয় কোন্দলে আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা থেকে সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর প্রাণহানি ঘটেছে। এখন সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি নেই বললেই চলে। এখানকার হত্যাকাণ্ডের কারণ হতে পারে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা; নিজেদের বীরত্ব জাহির করা কিংবা অস্বাভাবিক ক্রোধ। পারভেজের ক্ষেত্রে কোনটা হয়েছে, বলা মুশকিল। তবে কোনোটিই প্রত্যাশিত নয়।
একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। দিনদুপুরে এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেই হত্যাকাণ্ড ঘটল! বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তো নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা উচিত। এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতাও যে কমে যাচ্ছে– তা স্পষ্ট। টেকসই সমাজের জন্য সেই সহনশীলতা জরুরি। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে পড়াশোনা করেও যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতা তৈরি না হয়, তবে তা হতাশাজনক।
পারভেজ ছিলেন মা-বাবার একমাত্র ছেলে। সন্তানের শূন্যতা মাতা-পিতার চেয়ে আর কে বেশি অনুভব করেন? পারভেজ ফিরবেন না সত্য, কিন্তু এভাবে আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com