শিবির নেতা নোমানী হত্যা মামলার আসামিকে গুলি করে ও কুপিয়ে জখম
Published: 23rd, April 2025 GMT
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি শরিফুজ্জামান নোমানী হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম রবিকে গুলি করার পর কুপিয়ে রেখে গেছে অস্ত্রধারীরা।
নগরের বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাক আহম্মেদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুধবার (২৩ এপ্রিল) রাত ৯টার দিকে রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া থানার পঞ্চবটি এলাকায় বরির ওপর হামলা হয়।
শিবির নেতা নোমানী হত্যা মামলার আসামি রবি আওয়ামী লীগের কর্মী। তার বাবার নাম আজিজুল ইসলাম। তাদের বাড়ি নগরের বিনোদপুর-মীর্জাপুর এলাকায়। রবির ভাই শহিদুল ইসলাম শহিদ রাজশাহী মহানগরের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সভাপতি।
আরো পড়ুন:
ফেনীতে বিএনপি কর্মীকে হত্যায় গ্রেপ্তার ৫
আড়াইহাজারে গৃহবধূকে গলা কেটে হত্যা, স্বামী আটক
ওসি মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, রাতে পঞ্চবটি এলাকায় রবিউলকে কুপিয়ে আহত করা হয়। তাকে গুলিও করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে পাঁচ রাউন্ড গুলির খোসা পাওয়া গেছে। কয়েকজন হামলাকারী মোটরসাইকেলে এসে আবার মোটরসাইকেলেই চলে গেছে।
ঘটনার পর আহত অবস্থায় স্থানীয়রা রবিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে নেওয়া হয়।
এই খবর লেখা পর্যন্ত রবির অস্ত্রোপচার চলছিল। তার বাঁ পায়ের রগ কাটা দেখা গেছে।
রামেক হাসপাতালের মুখপাত্র ডা.
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, রবিউল ইসলামের নামে পাঁচটি মামলা আছে; যার মধ্যে রাবি শিবিরের সাবেক সেক্রেটারি শরিফুজ্জামান নোমানী হত্যা মামলাও রয়েছে।
২০০৯ সালের ১৩ মার্চ রাবি ক্যাম্পাস ও পার্শ্ববর্তী বিনোদপুর বাজারে ছাত্রশিবির, ছাত্রলীগ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সেক্রেটারি নোমানী নিহত হন।
এই মামলায় গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রবি। এর আগে ২ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জে জনতার হাতে আটক হয়েছিলেন আত্মগোপনে থাকা রবির ভাই শহিদুল ইসলাম। তাকে পুলিশের সোপর্দ করা হয়েছিল।
২০১৩ সালের ১৬ মার্চ নিজ বাড়িতেই হামলার শিকার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুল ইসলাম। সেদিন কয়েকজন যুবক বাড়িতে ঢুকে তাকে কুপিয়ে জখম করেন এবং দুই পায়ের রগ কেটে দেন।
হামলার সময় শহিদুলের বাড়িতে ছিলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য ও মির্জাপুর নাজমুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইনুল হোসেন, যিনি ওই হামলায় আহত হন। তাদের বাঁচাতে গিয়ে আহত হন ৩০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন। সেদিন মাইনুলকেও কোপানোর পাশাপাশি তার বাঁ হাতের রগ কেটে দেওয়া হয়।
ঢাকা/কেয়া/রাসেল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর হত য আহত ল ইসল ম হয় ছ ল আওয় ম নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
কৃষক কেন ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দেন?
আমরা তখন মেহেরপুরে; মুজিবনগরের ভবেরপাড়া গ্রামে। কচু, কলা আর হাইব্রিড ভুট্টায় চারদিক সয়লাব। মাঠের পর মাঠ পেঁয়াজ তোলা হয়ে গেছে। বাতাসে পেঁয়াজের বাসি ঝাঁজ। খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের (খানি) সমন্বয়ে আমরা গিয়েছিলাম মেহেরপুর।
২৫ মার্চ এখানে বিষ পান করেছিলেন এক কৃষক। স্বাধীনতা দিবসে এই হাসপাতাল সেই হাসপাতাল করে তাঁকে বাঁচাতে লড়েছে তাঁর পরিবার। কিন্তু পরদিন তিনি মারা যান। ঈদের লম্বা ছুটি থাকায় নিদারুণ এই আত্মহত্যা মিডিয়ায় হারিয়ে যায়। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় দ্রুত একটি প্রতিবেদন তৈরি করে।
সরকারি সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভবেরপাড়া গ্রামের কৃষক সাইফুল শেখ ঋণ নিয়ে দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। ঋণগ্রস্ত হয়ে লোকসান ও হতাশার কারণে আত্মহত্যা করেছেন। সাইফুল শেখের বাড়িতে তাঁর মেয়ে রজিফা, রজিফার মা ও দাদি যখন বিভীষিকাময় সেই ২৫ মার্চ রাতের বর্ণনা করছিলেন; মনে হচ্ছিল, কৃষকের কালরাত কাটবে কবে? কেন স্বাধীন দেশে একজন কৃষককে হতাশ হতে হয়? কেন তাঁর লোকসান হয়; তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করা হয়? কেন কৃষক আত্মহত্যা করেন?
সাইফুল শেখের মা মুঠভর্তি কতগুলো সুখসাগর পেঁয়াজ নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ালেন। ছেলের উৎপাদনের শেষ স্মৃতি আমাদের হাতে তুলে দিতে চাইলেন। সে পেঁয়াজ ধরার সাহস আমাদের হয়নি। বুক কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু আমরা তো হরদম এসব ধরছি। খাচ্ছি-দাচ্ছি, আরাম করছি। আবার সব ভুলে যাচ্ছি।
শুধু পেঁয়াজ নয়; সব শস্য-ফসলের শরীরেই আছে কৃষকের রক্ত আর বঞ্চনার দাগ। ভবেরপাড়া থেকে বের হতে না হতে বাঘার আরেক কৃষকের আত্মহত্যার খবর আসে। রাজশাহীর বাঘায় আরেক পেঁয়াজ চাষি ট্রেনের তলায় শরীর পেতে দিয়েছেন। পেঁয়াজ চাষ করে ক্ষতি ও লোকসান হওয়ায় ঋণগ্রস্ত হতাশ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু একটি ভিডিও মিথ্যাচার ‘ভাইরাল’ করে– কৃষক ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ ছিলেন। তাঁর পরিবারে অশান্তি ছিল; স্ত্রী মারা গেছেন; সন্তানেরা দুর্ব্যবহার করে– এসব মিথ্যাচার।
যা হোক, একের পর এক কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন কেন? প্রশ্নহীন এ আত্মাহুতি কীসের বার্তা দেয়? রাষ্ট্র কেন তা পাঠ করছে না? কৃষকের আত্মহত্যা নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো পরিসংখ্যান ও দলিল নেই কেন? আত্মহত্যা থামাতে রাষ্ট্র কেন সর্বস্তরে ব্যবস্থা নিচ্ছে না? মেহেরপুর থেকে ফেরার পথে বারবার কানে বাজে রজিফার ক্ষুব্ধ বক্তব্য, ‘কৃষকই যদি মরে যায় তবে মানুষের মুখে খাবার তুলে দেবে কে?’ জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই রজিফার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
সরকার রজিফাদের বাড়ি গিয়েছে। উপজেলা কৃষি ও সমাজসেবা কর্মকর্তাদের নিয়ে মেহেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল শেখের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সাহস করেছেন। আর্থিক সহায়তা, শিক্ষাবৃত্তি, ঋণ মওকুফ, প্রাণিসম্পদ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা তখন রজিফাদের বাড়িতে ছিলাম। উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা যখন ১০ হাজার টাকার একটা খাম গুঁজে দিলেন সাইফুল শেখের মায়ের হাতে। সেখানে এক দায়িত্বশীল মানবিক স্পর্শের ছাপ ছিল। সঙ্গে সঙ্গে মনে আসে কৃষক, আদিবাসী, বনজীবীদের সঙ্গে বহু সরকারি কর্মকর্তার নিদারুণ সব দুর্ব্যবহারের কথা।
আমরা আশা করব, সরকার বাঘা যাবে। নিহত কৃষক মীর রুহুল আমিনের পরিবারের পাশে দাঁড়াবে। কৃষক, নাগরিক সমাজ এবং সংবাদমাধ্যম প্রতিনিধিদের নিয়ে বাউসা যাওয়া জরুরি। কৃষক কেন ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দেবেন– তা খুঁজে বের করতেই হবে। নিতান্ত কম দামে পেঁয়াজ বেচে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক একের পর এক আত্মাহুতি দেওয়ার পর কোন ক্ষমতার সিন্ডিকেট পেঁয়াজের দাম বাড়াল– রাষ্ট্রকে তা খুঁজে বের করে আইন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
কৃষক আত্মহত্যা করলে হয়তোবা ক্ষমতা কাঠামো কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়। নিজেদের দুর্নীতি, লুটপাট, মুনাফা, অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ধামাচাপা দিতে সব দোষ কৃষকের ঘাড়েই চাপাতে চায়। সেচের পানি না পেয়ে রাজশাহীতে অভিনাথ ও রবি মার্ডি নামে দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার পর তাদের ‘মাতাল’ বানানোর বহু চেষ্টা চলেছিল। শেরপুরের নালিতাবাড়ীর মানিকচাঁদ পাড়া গ্রামের কৃষক সফি উদ্দিন সেচের পানিবঞ্চিত হয়ে জমিতে উন্মুক্ত ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে আত্মহত্যা করেন ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। তাঁকেও ‘ভারসাম্যহীন’ বলা হয়েছিল। সাইফুল শেখের স্ত্রীকেও ‘অসুস্থ, পাগল’ বানানো হয়েছে। মীর রুহুল আমিনকে ‘পাগল’ বানানো হয়েছে।
রুহুল আমিনও সাইফুল শেখের মতো স্থানীয় এনজিও এবং মহাজন থেকে প্রায় তিন লাখ টাকা ঋণ করেছিলেন, যেখানে আরও ৯৯ হাজার টাকা পরিশোধের বাকি ছিল। সপ্তাহে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে হতো। কৃষককে কেন এভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে কৃষিকাজ করতে হয়– এর উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে। এর মর্মযন্ত্রণা আমাদের বুঝতে হবে। সাইফুল শেখের মতো রুহুল আমিনেরও ময়নাতদন্ত হয়নি। ‘পাগল গরিব কৃষকদের’ হয়তো ময়নাতদন্তের দরকার হয় না। উভয়ের ক্ষেত্রেই ‘অপমৃত্যু’ মামলা হয়েছে।
সাইফুল শেখ কিংবা রুহুল আমিনরা কেন পেঁয়াজ আবাদ করেছিলেন? এর প্রথম উত্তর– আমাদের বাঁচিয়ে রাখবার জন্য। ভিখারি থেকে রাষ্ট্রপ্রধান– আমাদের খাবার জোগান কৃষক। কিন্তু কৃষিকাজ আর কৃষকের হাতে নেই। বাজার ও কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করে কৃষি। গত বছর বাজারে পেঁয়াজের দাম চড়া ছিল। দুর্বৃত্ত সিন্ডিকেট পেঁয়াজ উধাও করে দিয়েছিল। নিজেদের ক্ষমতার মর্জিমতো পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছিল। রাষ্ট্র ও সরকার কিচ্ছু করতে পারেনি। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর আর সবকিছু পাল্টাতে শুরু করলেও সিন্ডিকেটবাজি থামেনি। কৃষিতে বাজার সিন্ডিকেট ও করপোরেট কোম্পানির একতরফা খবরদারি থামেনি। তাই এবার আলু-পেঁয়াজ চাষ করে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত, হতাশ ও দিশেহারা। তাই আত্মহত্যাই আজ কৃষকের প্রতিবাদ কিংবা নিয়তি।
কেবল ধান নয়; পেঁয়াজসহ সব শস্য-ফসলের দাম ধার্য করতে হবে রাষ্ট্রকে। কৃষকের চাষাবাদ, স্বাস্থ্য, কৃষিজমি, ফসল, ন্যায্যমূল্য, বিপণন সব কিছুর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। কার্যকর, দায়িত্বশীল কৃষি সংস্কার কমিশন গঠনের ভেতর দিয়ে অর্ন্তবর্তী সরকার সে কাজ শুরু করতে পারে।
পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক