গাড়িতে চড়েন, বিদেশে যান, কিন্তু শ্রমিকের বেতন দিতে বললে নানা সমস্যা তুলে ধরেন
Published: 23rd, April 2025 GMT
দেশ স্বাধীনের পর থেকে শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউই শ্রমিকদের পক্ষে শিল্পমালিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি বলে মন্তব্য করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেছেন, এত দিন যাঁরা শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, সবার সঙ্গে শিল্পমালিকদের স্বার্থের সম্পর্ক ছিল। এ কারণে এ মন্ত্রণালয়ে কেউ কখনো মালিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি।
আজ বুধবার সচিবালয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন শ্রম উপদেষ্টা। শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে শ্রম উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদনটি তুলে দেন কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানসহ শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ২১ এপ্রিল শ্রম সংস্কার প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়।
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর শ্রমিকের পক্ষে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে মালিকদের বিরুদ্ধে যেতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তাঁরা আমার ওপর অনেক ক্ষ্যাপা। অনেক সংবাদ পাই। আমি তাঁদের বলেছি, আপনি মালিক সবকিছু করতে পারেন। গাড়িতে চড়েন। বিদেশে যান। আপনার কোনো অসুস্থতা হলে চিকিৎসকের কাছে যান। অথচ যখন আপনাকে শ্রমিকের বেতন দিতে বলা হয়, তখন আপনি নানাবিধ সমস্যা তুলে ধরেন। বলেন যে আমার টাকা নেই। আমাকে ব্যাংক ধরেছে। আপনাকে ব্যাংক ধরবে না কেন? আপনি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। আপনাকে তো ব্যাংক ধরবেই।’
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করতে এ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি সংস্কার প্রতিবেদনের ওপর একটি সমীক্ষা করে দেখবে। ইতিমধ্যে কী কী বিষয় নিয়ে কাজ হয়ে গেছে। কতখানি সামঞ্জস্য আছে। কতটা পার্থক্য আছে।
এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, কমিশন তাদের সুপারিশ করেছে। বাস্তবতার মুখোমুখি আমি হচ্ছি। আমাকে আর্থসামাজিক বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। সবাইকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, যেসব বিষয় বাস্তবায়নের সুযোগ রয়েছে, তা করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার অপেক্ষায় থাকব না। নিজের কাজ নিজেই করব। এটি আমার কাজ।’
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আগামী ডিসেম্বরের আগে কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না। জবাবে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ‘আমার পক্ষে ডিসেম্বর লাগবে না। পারলে কালকেই বাস্তবায়ন করব। সময়সীমা দিতে পারব না। ডিসেম্বর বললে আমি নভেম্বর থেকে শুরু করব। তাই সময়সীমা বেঁধে দিতে চাই না। আমি আমার মতো অগ্রাধিকার ঠিক করে কাজ করব।’
এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচন কবে হবে আমি জানি না। ডিসেম্বর নাকি জুনে, তা বলতে পারব না। কমিশনের সুপারিশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।’
সংবাদ সম্মেলনে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শ্রম সংস্কারসংক্রান্ত প্রতিবেদনটি যাতে ফাইলবন্দী হয়ে না থাকে। টানা পাঁচ মাস খেটে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। এখানে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সেসবের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।’
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে, চব্বিশের গণ-আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে প্রথমে বৈষম্য দূর করতে হবে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বৈষম্য হচ্ছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মধ্যে বৈষম্য। ৮৫ শতাংশ শ্রমিক আইনি সুরক্ষা পান না। এর চেয়ে বড় বৈষম্য আর হতে পারে না। এই ৮৫ শতাংশ শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেই। তাঁরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁদের সমস্যার কথা বলতে পারেন না। এতে রাষ্ট্রও তাঁদের সমস্যার কথা জানতে পারে না। এতে শুধু শ্রমিকই ক্ষতিগ্রস্ত হন না, রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থার অবসান করতে হবে। ৮৫ শতাংশ শ্রমজীবীকে বাদ দিয়ে একটি জাতি চলতে পারে না। একটা দেশ এগোতে পারে না। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
সব শ্রমিককে আইনি সুরক্ষার আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাঁর মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। বিপদে পড়লে প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ন্যূনতম মজুরির মানদণ্ড নির্দিষ্ট করতে হবে। সেই মানদণ্ড যাতে প্রত্যেক পেশাজীবী ব্যক্তি দাবি করতে পারেন। সেই মানদণ্ড প্রতি তিন বছর পরপর মূল্যায়ন করা ও পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ৯০ ভাগ নারী মাতৃত্বকালীন সময়ে মাসিক বেতন পান না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও অস্থায়ী নারীরা মাতৃত্বকালীন সময়ে মাসিক বেতন পান না। তাঁদের সামাজিক স্কিমে যুক্ত করতে হবে।
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘এখন থেকে মজুরি নিয়ে দর-কষাকষি দেখতে চাই না। একটি সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। আমরা সেটির বাস্তবায়ন দেখতে চাই। যেখানে প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনো সহযোগিতা পাবেন।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কাশ্মীরে হামলা নিয়ে মন্তব্য করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণের শিকার সিপিআইএমের মহম্মদ সেলিম
কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারতজুড়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা আরও জাতীয়তাবাদী ও শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যবস্থার দাবি তুলেছেন। এর মধ্যে খানিকটা স্রোতের বিপরীতে হাঁটলেন পশ্চিমবঙ্গ সিপিআইএমের (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্ক্সবাদী) সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি সাধারণ মানুষকে সাবধান করেছেন, যাতে এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে কোনো পক্ষ সাম্প্রদায়িক উসকানি ও বিভাজন বাড়াতে না পারে। কাশ্মীরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে অনেকটা জাতীয়তাবাদের সুনামি তৈরির মধ্যে তাঁর এই মন্তব্যকে ভালোভাবে দেখেননি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। মহম্মদ সেলিমের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষত ফেসবুকে।
বুধবার দুপুরে সিপিআইএমের প্রচার বিভাগ ফেসবুকে রাজ্য সম্পাদকের একটি ছবি দিয়ে তাঁর একটি মন্তব্য প্রকাশ করে। সেখানে মহম্মদ সেলিম বলছেন, ‘কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করে বিজেপি সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তাতে সন্ত্রাসবাদকে আরও উসকে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যটকদের ওপর এই হামলা ঘিরে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়ানো ও বিভাজনের চেষ্টা হবে। অমরনাথ যাত্রার প্রাক্কালে হামলা বলে দেখিয়ে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ওপরে হামলা বলে প্রচার করা হবে। আমরা কাশ্মীরের ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি এবং কোনোরকম সাম্প্রদায়িক উসকানিতে সাড়া না দেওয়ার আবেদন করছি।’
সিপিআইএমের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ পলিটব্যুরোও একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে, কিন্তু এখানেও তারা এই ধরনের ‘সাহসী’ মন্তব্য করেনি বলে মনে করছেন সিপিআইএম দলের সদস্যদের একাংশ। বিবৃতিতে ভুক্তভোগীদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে পলিটব্যুরো বলেছে, ‘এই জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। এই নৃশংস হামলার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে কেন্দ্রীয় সরকারকে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। অপরাধকারীরা জাতির ও কাশ্মীরের জনগণের শত্রু। জনাকীর্ণ পর্যটন স্থানগুলোতে নিরাপত্তার অভাবসহ হামলার সমস্ত বিষয় নিয়ে তদন্ত চালানো কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব। চরমপন্থী মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এই ট্র্যাজেডির মুহূর্তে সিপিআই-মার্ক্সবাদী ভারতের জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ।’
অর্থাৎ যে কথা মহম্মদ সেলিম বলেছেন, এই ঘটনার জেরে ভারতে আগামী দিনে সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের রাজনীতি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেই ধরনের কোনো মন্তব্য করেনি দলের শীর্ষ পর্ষদ।
মহম্মদ সেলিমের মন্তব্যের জন্য তাঁকে প্রবল আক্রমণ করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। একজন লিখেছেন, ‘সিপিআইএমের আজ এই অবস্থা আপনাদের এই মতামতের জন্যই।’ সিপিআইএমের প্রচার বিভাগের ওই ফেসবকু পোস্টে রাত পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মন্তব্য করা হয়েছে এবং এর প্রায় প্রতিটিই মহম্মদ সেলিমকে আক্রমণ করে। আরেক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘সেলিম বিষয়টিকে নিয়ে রাজনীতি করছেন, যা কাম্য নয়।’ ফেসবুকে সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদককে ব্যক্তিগত আক্রমণও করেছেন অনেকে।
তবে সিপিআইএম দলের সদস্যদের একাংশ মনে করছেন, এই মন্তব্যের প্রয়োজন ছিল। দক্ষিণ কলকাতার কসবায় সিপিআইএমের স্থানীয় কমিটির সাবেক সদস্য ও বর্তমানে পার্টির সাধারণ সদস্য কৌশিক রায় এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে আমি যেটা মনে করি সেটা হলো “পপুলিস্ট” চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে গিয়ে পাল্টা ন্যারেটিভ (আখ্যান) আমরা দিতে পারছি না। মানুষ বাম রাজনীতি থেকে সব সময় অন্য কিছু শুনতে চান। অন্য একটা ন্যারেটিভ চান। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা মূলস্রোতের ন্যারেটিভই অনুমোদন করি এবং সেটাই বলি। এই যে রাজ্য সম্পাদক কথাটা বললেন যে, এই ঘটনাকে ব্যবহার করে কিছু সংগঠন সম্প্রদায়িক রাজনীতি করার চেষ্টা করবে, এটা একটা বিকল্প ন্যারেটিভ। কাশ্মীরের ঘটনার ফলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং মেরুকরণের রাজনীতি বাড়তে পারে, এটা একটা বাস্তব সত্য এবং বিকল্প ন্যারেটিভও, যেটা এই মুহূর্তে অন্য রাজনৈতিক দল বলছে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অনেক মানুষই সেটা মনে করেন। মূলস্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের কথা বলাটা এই সময় খুব জরুরি।’
রাজ্য সম্পাদকের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে আগামী শুক্রবার (এপ্রিল ২৫) কাশ্মীরের সহিংসতা এবং সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতায় পথে নামবে পশ্চিমবঙ্গ সিপিআইএম।