Prothomalo:
2025-04-23@18:36:09 GMT

বই দিবস ও একটি বইয়ের গল্প

Published: 23rd, April 2025 GMT

চারদিকে ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব এখন দেখার মতো। খেলার মাঠও প্রায় এগুলোর দখলে চলে গেছে বললে ভুল হবে না। কেউ কেউ তাই চোখে আঙুল দিয়ে প্রশ্ন করতে কার্পণ্য তো করেন-ই না; উপরন্তু একটু রূঢ় কণ্ঠেই আমাদের প্রজন্ম অর্থাৎ জেনারেশন জেড সংক্ষেপে জেন–জির কাছে প্রশ্ন করে বসেন, একাডেমিকের বাইরে তোমরা কোনো বই পড়েছ?

সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, ‘বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না।’ বই কিনে সত্যিই কি কেউ দেউলিয়া হন না? বইপ্রেমীদের মধ্যে এই প্রশ্নটি নিয়েও চলে মধুর তর্ক। যা সহজে শেষ হয় না। তবে তর্কবিতর্ক যা–ই থাকুক না কেন, আজ ২৩ এপ্রিল সব পেছনে ফেলে বই নিয়ে উদ্‌যাপনের দিন। বিস্তৃত করে বললে বই কেনার দিন, পড়ার দিন, বই উপহার দেওয়ার দিন। আজ বিশ্ব বই দিবস। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ১৯৯৫ সালের ইউনেসকোর সাধারণ অধিবেশনে ২৩ এপ্রিলকে বই দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। দিনটি ‘বিশ্ব গ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস’ হিসেবেও অনেকের কাছে পরিচিত। বই পড়া, বই ছাপানো, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোই বই দিবসের মূল উদ্দেশ্য।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, স্পেনের লেখক ভিসেন্ত ক্লাভেল আন্দ্রেসের কাছ থেকে বই দিবসের মূল ধারণাটি আসে। আন্দ্রেস ছিলেন ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘লা মানচার দন কিহোতে’র স্রষ্টা সেরভান্তেসের ভাবশিষ্য। মূলত মিগেল দে সেরভান্তেসের স্মৃতিতেই ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে আন্দ্রেস স্পেনে বই দিবস পালন করা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে দিবসটি ইউনেসকো কর্তৃক স্বীকৃতি পায়। মিগেল দে সেরভান্তেস, উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার ও ইনকা গার্সিলাসো দে ভেগার প্রয়াণ দিবস ২৩ এপ্রিল হওয়ায় দিনটিকে বই দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। উল্লেখ্য, বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান নির্মাতা ও লেখক সত্যজিৎ রায়েরও প্রয়াণ দিবস আজ।

একটি বইয়ের গল্প

বাংলা সাহিত্য দিনে দিনে অনেক মণি–মুক্তায় সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছে। আজ বই দিবসে বাংলা সাহিত্যের তেমনই একটি বই সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক, প্রকাশের ১৪৬ বছর পরেও যে বইটির জৌলুশ ফুরায়নি। শুধু তা-ই নয়, বইটি পড়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। লেখককে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন।

১৮৮০ থেকে ১৮৮২ সালের মধ্যে বইটি রচনা করেন সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ছয় কিস্তিতে এটি প্রকাশিত হয়। প্রমথনাথ বসু ছদ্মনামে সঞ্জীব তখন বইটি প্রকাশ করেছিলেন। পত্রপত্রিকা সূত্রে জানা যায়, সঞ্জীবের গবেষণামূলক গ্রন্থ Bengal Ryots: Their Rights and Liabilities (১৮৬৪) পড়ে তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর খুশি হন। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে তাঁর প্রতিভার প্রশংসা করেন। উপহারস্বরূপ ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে তাঁকে চাকরি দেন। আর এই চাকরির সূত্রেই লেখককে পালামৌ যেতে হয়।

রচনার শুরুতেই সঞ্জীব উল্লেখ করেছেন যে পালামৌ যাওয়ার পর দু-একজন বন্ধু পালামৌ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি লিখতে সম্মত তো হন-ইনি, উপরন্তু উপহাস করেছিলেন। উপহাস করলেন কেন? পালামৌ যাওয়ার আগে তৎকালীন ইংরেজি পত্রিকা ‘হরকারা’য় পালামৌ সম্পর্কে একজন সেনা কর্মকর্তার লেখা পড়ে পালামৌর একটা ছবি সঞ্জীবের মনে চিত্রিত হয়েছিল। যা বাস্তবের পালামৌয়ের সঙ্গে মেলেনি। উপহাস করার পেছনে এটি একটি কারণ হতে পারে। পাশাপাশি প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক যে এতই যখন বিরক্তি ঘটা করে দশ-বারো বছর পরে লিখলেন কেন? সঞ্জীবের অভিব্যক্তি থেকেই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা যাক। পালামৌর বর্ণনা করতে গিয়ে প্রসঙ্গান্তরে তিনি বলেছেন, ‘অদ্য যাহা ভালো লাগিতেছে না, দশ বৎসর পরে তাহার স্মৃতি ভালো লাগিবে। অদ্য যাহা সুখ বলিয়া স্বীকার করিলাম না, কল্য আর তাহা জুটিবে না। যুবার যাহা অগ্রাহ্য, বৃদ্ধের তাহা দুষ্প্রাপ্য। দশ বৎসর পূর্বে যাহা আপনিই আসিয়া জুটিয়াছিল, তখন হয়তো আদর পায় নাই, এখন আর তাহা জুটে না, সেই জন্য তাহার স্মৃতিই সুখদ।’ বোধ করি, পালামৌ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তেমনই এক ‘সুখদ স্মৃতি’। অথবা সঞ্জীব যেমনটা বলেছেন, ‘গল্প করা এ বয়সের রোগ, কেহ শুনুন বা না শুনুন—বৃদ্ধ গল্প করে।’

আরও পড়ুনসবচেয়ে বেশি বই পড়েন মার্কিনরা, বাংলাদেশিদের অবস্থান কততম৫ ঘণ্টা আগে

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অগ্রজ (দাদা)। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভার প্রশংসা করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপও ছিল। ‘সঞ্জীবচন্দ্র (পালামৌ)’ শিরোনামের প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সঞ্জীবচন্দ্রের মধ্যে ‘প্রতিভার ঐশ্বর্য’ থাকলেও ‘গৃহিণীপনার’ অভাব ছিল। ‘গৃহিণীপনার’ আবরণে সঞ্জীবের চেষ্টা ও একাগ্রতার অভাবের যে আশঙ্কার কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সঞ্জীবের জীবনেও তার যথেষ্ট দৃষ্টান্ত আছে। পড়ালেখা, চাকরি—কোনো কিছুতেই সঞ্জীবচন্দ্র বেশি দিন থিতু হতে পারেননি।

কথাসাহিত্যের দর্শনে লেখকের ব্যক্তিসত্তার যেমন প্রতিফলন ঘটে, তেমনি প্রতিভাও বিকশিত হয়। প্রকৃত অর্থেই পালামৌতে সঞ্জীবের প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কী অসাধারণ বর্ণনাশৈলী, ভাষার প্রয়োগ, অলংকার, রূপক ও উপমার ব্যবহার; বইটা পড়ার পর এক অমোঘ ভালো লাগায় মন আবিষ্ট হয়ে থাকে।

পালামৌ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ‘অসম্পূর্ণতার অভিশাপে’র কথা বলেছেন। বারবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করা এর একটি কারণ হতে পারে। যদিও এই প্রসঙ্গান্তরকে ‘সৌষ্ঠবহানি’ বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পালামৌ যত না অসম্পূর্ণ, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাণবন্ত। প্রকৃতিপ্রেমের পাশাপাশি এই রচনায় সঞ্জীবচন্দ্রের স্বদেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধেরও পরিচয় মেলে। যাত্রাপথে কুলিদের মুখে ‘সাহেব’ সম্বোধন শুনে তিনি মর্মাহত হন। চিৎকার করে বলেন, ‘আমি সাহেব নই, আমি বাঙালি।’

ভ্রমণ বর্ণনার পাশাপাশি এই রচনায় পলান্ডু (পিঁয়াজ) থেকে শুরু করে রাধাকৃষ্ণের কাহিনি, মৌয়াগাছের নামকরণ (লেখকের দেওয়া নাম), লাতেহার পাহাড় ভ্রমণ, নববধূ প্রসঙ্গসহ বিবিধ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকপাত যেমন করেছেন। তেমনি কখনো ছেলেবেলার স্মৃতি যোগ করেছেন তো কখনো যোগ করেছেন পূর্ব অভিজ্ঞতা। পালামৌ কি ভ্রমণকাহিনি না উপন্যাস, না অন্য কিছু? গঠনশৈলী বিবেচনায় পালামৌ না ভ্রমণকাহিনি, না উপন্যাস—এটি সঞ্জীবের একটি মুক্ত রচনা। ‘পালামৌ’কে মুক্তগদ্য বলা–ই যুক্তিযুক্ত হবে।

‘পালামৌ’তে প্রকৃতির বর্ণনা যেমন আছে, তেমন আছে মানুষ ও ওই অঞ্চলের তৎকালীন সমাজব্যবস্থার কথাও। যা এই রচনার প্রাণশক্তি। কোল অধ্যুষিত পালামৌ অঞ্চলের ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে কোলদের আনন্দ-বেদনা, হাসি–আনন্দ বর্ণনা করতে কার্পণ্য করেননি সঞ্জীবচন্দ্র। কোলদের বিবাহপদ্ধতিও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন। শুধু তা–ই নয়, হিন্দু মহাজন কর্তৃক কোলদের জীবনের দুর্দশার চিত্র; ঋণ নিয়ে, ঋণগ্রহীতা থেকে দাস বনে যাওয়ার দুর্দশা দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন তিনি। তাই তো প্রসঙ্গান্তরে ঋণব্যবস্থা নিয়েও আলোকপাত করেছেন। ১৪৬ বছর আগে বিবাহের আয়োজনে আড়ম্বর করতে গিয়ে ঋণ নিয়ে ঋণী হওয়া এবং ঋণব্যবস্থা নিয়ে যে আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছিলেন আজও তা নদীর মতো প্রবহমান।

‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ কোলদের চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে এই রচনায় বলেছেন সঞ্জীবচন্দ্র। উক্তিটি আজ মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ভাবসম্প্রসারণ থেকে চাকরির নানা পরীক্ষায় ‘উক্তিটি’র বিশ্লেষণ জানতে চাওয়া হয়।

সঞ্জীবচন্দ্র পালামৌ রচনায় প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও জয়গান করেছেন। মানুষ হিসেবে মানুষের অধিকারের কথা তুলে ধরেছেন। যে কারণে যুগ থেকে যুগে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পাঠক ‘পালামৌ’কে আপন করে নিয়েছে। ১৪৬ বছর পরেও ‘পালামৌ’র জৌলুশ কমেনি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর ছ ল ন প রসঙ গ বল ছ ন কর ছ ন রচন য়

এছাড়াও পড়ুন:

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দিনে ‘একটি সূতার জবানবন্দী’

কারও মনে থাকুক বা না থাকুক, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল তারিখটি দেশের ইতিহাসে একটা কালো দিন হিসেবে লেখা থাকবে। সেদিন সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা নামের ভবনটি ধসে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় সেখানে থাকা তৈরি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৭৫ শ্রমিক নিহত হন, আহত হন ২ হাজারের বেশি।
অন্য সবার মতো ঘটনাটি নিয়ে মানসিক পীড়ায় ছিলেন কামার আহমাদ সাইমন। একসময় জীবন অনেক কষ্টকেই পত্রিকার পাতা ওলটানোর মতো ভুলিয়ে দেয়।

তারপরও কিছু ঘটনায় জিজ্ঞাসা থেকে যায়, বহুদিন তাড়া করে। তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনা থেকেই সেই তাড়না অনুভব করছিলেন কামার। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর আর বসে থাকতে পারেননি, ২০১৫ সালে নির্মাণ করেন ‘একটি সূতার জবানবন্দী’ (টেস্টিমনি অব আ থ্রেড)। নির্মাতার ভাষ্যে, ‘একজন নাগরিকের দায় থেকেই ছবিটি বানিয়েছি।’

‘একটি সূতার জবানবন্দী’–এর পোস্টার। চরকির সৌজন্যে

সম্পর্কিত নিবন্ধ