কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম মাধবপুর। গ্রামের ওপর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ। আজ বুধবার সকাল ১০টার ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল স্লিপার ও রেললাইনে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। রেললাইনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তিন তরুণের ছিন্নভিন্ন মরদেহ।
আজ বুধবার ভোরের কোনো এক সময়ে মাধবপুর গ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেনে কাটা পড়ে ওই তিনজন মারা যান। সকাল ১০টার পর তাঁদের মরদেহ উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ।
লাশ উদ্ধার করে কুমিল্লা স্টেশন ফাঁড়ির সামনে নেওয়ার পর একজনের বিস্তারিত পেয়েছে রেলওয়ে পুলিশ। সাইফুল ইসলাম (১৮) নামের ওই তরুণ কুমিল্লা রেলস্টেশনে বোতল কুড়ানোর কাজ করতেন। তাঁর বাবা মোখলেছুর রহমান ও মা আছমা আক্তার রেলস্টেশন পরিষ্কার ও বোতল কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁরা রেলস্টেশনেই থাকেন। রেলওয়ে পুলিশ জানিয়েছেন, নিহত অপর দুজনের বয়স ১৭–১৮ বছর। তাঁদের একজনের নাম তুহিন বলে জানা গেলেও আরেকজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
রেলওয়ে পুলিশ সূত্র বলছেন, সুবিধাবঞ্চিত ওই তিন তরুণ–কিশোর একসঙ্গে থাকতেন। রেললাইন–রেলস্টেশন ঘিরেই ছিল তাঁদের জীবন। স্টেশনে–স্টেশনে ঘুরে বেড়ালেও বেশির ভাগ সময় থাকতেন কুমিল্লা রেলস্টেশনে। স্টেশনে মানুষের ফেলে দেওয়া বোতলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র কুড়িয়ে বিক্রি করতেন।
যেই স্থানে ওই তিন তরুণ ট্রেনে কাটা পড়েছেন, সেখানে কোনো রেলক্রসিং নেই। আশপাশে কোনো স্টেশনও নেই। তাহলে কীভাবে ওই তিনজন সেখানে গেলেন বা কীভাবে তাঁরা ট্রেনে কাটা পড়লেন—সেটা কেউ বলতে পারছেন না। এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেনি রেলওয়ে পুলিশও।
এই জায়গায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন তিনজন। আজ সকালে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার মাধবপুর এলাকায়.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নেতৃত্বশূন্য পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কী
পাকিস্তানের সমস্যা শুধু সংখ্যায় বাড়ছে না, বরং দেশের ভেতরে বিভাজন আর অস্থিরতাও তাতে আরও গভীর হচ্ছে। কোথাও বিক্ষোভ, কোথাও বিদ্রোহ, কোথাও আবার চরমপন্থীদের সহিংসতা। সন্ত্রাসবাদ, কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে টানাপোড়েন, পানিবণ্টন নিয়ে বিরোধ এবং সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংঘাত—সব একসঙ্গে ঘটছে।
এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়, দেশের শাসনব্যবস্থা ও নেতৃত্ব কোন পর্যায়ে রয়েছে। সংবাদমাধ্যমে সরকার নিজেই নিজেকে বাহবা দিলেও আসল চিত্র একেবারেই ভিন্ন। মৌলিক সমস্যা এখনো অব্যবস্থাপনার শিকার। শাসনের মানও জনগণের প্রত্যাশার অনেক নিচে। পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন জায়গায় শাসকদের গুণগান করে বড় বড় বিলবোর্ড টাঙানো হচ্ছে।
কিন্তু এসব দিয়ে নেতৃত্ব তৈরি হয় না। টেলিভিশনে যেসব অনুষ্ঠান দেখানো হয়, সেখানে মনে হয় ক্ষমতাবানদের দৈনন্দিন দায়িত্ব পালনও যেন বিশেষ কিছু। এসব মানুষকে উৎসাহিত তো করেই না, বরং মনে হয়, নেতারা নিজেরাই নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অতি উদ্বিগ্ন। প্রকৃত স্বীকৃতি আসে কাজ দিয়ে, পোস্টার আর পত্রিকার ৬০ পাতার বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়।
পাকিস্তানের সেসব জটিল সমস্যা এখন সামনে এসেছে। খাপছাড়া, এলোমেলোভাবে অর্থনীতি, রাজনীতি আর নিরাপত্তা–সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা কাজে আসে না, বরং ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। একের পর এক জনমত জরিপে সেই হতাশারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি ইপসস জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে, দেশ ভুল পথে হাঁটছে।
পাকিস্তানের ইতিহাসে এর আগেও নেতৃত্বহীন সময় এসেছে। অতীতে অনেকেই দেশের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের না ছিল দক্ষতা, না ছিল দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা মোকাবিলার দৃষ্টিভঙ্গি। ক্ষমতা হাতে পেলেই যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তা নয়। এই কারণেই দেশে শুধু শাসন হয়েছে, শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। রাজনীতি হয়েছে ক্ষমতার খেলা, জনস্বার্থ নয়। কিন্তু এখন সমস্যাগুলো এতটাই জটিল যে নেতৃত্বশূন্যতা আজ ভয়াবহভাবে স্পষ্ট।
তাহলে কেমন নেতৃত্ব চাই পাকিস্তানের? কাকে বলব দক্ষ নেতা? আর কী গুণ থাকা দরকার একজন কার্যকর নেতার মধ্যে? সবার আগে প্রয়োজন এমন এক দৃষ্টিভঙ্গির, যা শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ নিয়েও পথ দেখায় এবং আশার সঞ্চার ঘটায়। সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার পরিকল্পনাও থাকা চাই। একজন নেতা কেবল কথা বলেই থেমে যাবেন না, তিনি জাতির মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলবেন, মানুষের ভরসা অর্জন করবেন আর রূপান্তরের পথে সাহসিকতার সঙ্গে অগ্রসর হবেন।
একজন নেতার উচিত হবে এমন দল গঠন করা, যাঁদের মধ্যে দক্ষতা ও সততা দুই-ই রয়েছে। বুদ্ধিমান নেতা জানেন, কে কোন কাজের উপযুক্ত। ব্যক্তিগত আনুগত্য বা রাজনৈতিক সুবিধা নয়। নেতৃত্ব মানে হচ্ছে মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা, তাদের দুঃখ-কষ্ট বোঝা, তাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা জানা এবং তার সাড়া দেওয়া।
এই মানদণ্ডে বিচার করলে দেখা যায় আজকের শাসকগোষ্ঠী কতটা ব্যর্থ। কোথাও কোনো বড় স্বপ্ন নেই। নেই সুসমন্বিত কোনো পরিকল্পনা। সমস্যা দেখা দিলেই তড়িঘড়ি দমনের চেষ্টা চলছে।
কিন্তু মূল সমস্যাগুলো থেকে যাচ্ছে অমীমাংসিত। যেমন বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি। প্রদেশটি তীব্র অসন্তোষে ফুটছে, অথচ কোনো টেকসই সমাধানের রূপরেখা তৈরি হয়নি। আবার পাঞ্জাব ও সিন্ধুর মধ্যে পানির ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ দিনকে দিন বাড়ছে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার যেন চোখ বুজে আছে।
অর্থনীতি নিয়েও বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অর্থনীতি বারবার সংকটে পড়ে। সেগুলো দূর করার বাস্তব উদ্যোগ দেখা যায়নি। ছোটখাটো সমাধানে ব্যস্ত থেকেছে সরকার। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সাহস দেখায়নি।
অর্থনীতি নিয়েও বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অর্থনীতি বারবার সংকটে পড়ে। সেগুলো দূর করার বাস্তব উদ্যোগ দেখা যায়নি। ছোটখাটো সমাধানে ব্যস্ত থেকেছে সরকার। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সাহস দেখায়নি।
আরও বড় সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা। নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে বিতর্কের কারণেই তাদের প্রতি জনসমর্থন দুর্বল। সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়েছে এলোমেলোভাবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কোনো ছাপ নেই। শাসনের দায়িত্ব পেয়েছে এমন একটি দল, যেখানে কিছু দক্ষ পেশাজীবী থাকলেও বেশির ভাগই নির্বাচিত হয়েছে পারিবারিক সম্পর্ক বা রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে।
আর একেবারেই অনুপস্থিত একটি গুণ। সেই গুণটি হলো জনগণকে নাগরিকদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা। আজকের নেতারা যেন সাধারণ মানুষের জীবন থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তাঁদের কথা বা কাজ, কোনোটাতেই মানুষের প্রতিচ্ছবি নেই। তাঁরা দেশকে একত্র করার বদলে যেন আরও বিভক্ত করে ফেলছেন। বর্তমান সময়ের যোগাযোগনির্ভর জগতে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার মতো দক্ষতাও তাঁদের মধ্যে অনুপস্থিত।
হেনরি কিসিঞ্জার লিখেছিলেন, ‘সাধারণ নেতারা বর্তমান সামলান; কিন্তু মহান নেতারা সমাজকে নিয়ে যান স্বপ্নের দিকে।’
দরকার এমন নেতৃত্ব, যাঁরা সাহস করে পুরোনো ব্যর্থতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে দেশকে নিয়ে যাবেন একটি আশাবাদী ভবিষ্যতের দিকে।
● মালিহা লোধি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত
ডন থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ