Risingbd:
2025-04-23@17:11:37 GMT

বই দিবসের প্রয়োজনীয়তা

Published: 23rd, April 2025 GMT

বই দিবসের প্রয়োজনীয়তা

“Reading is essential for those who seek to rise above the ordinary.” – Jim Rohn

পাঠ এক মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রধানতম উপায়। কিন্তু প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিক সমাজে পাঠাভ্যাসের অবক্ষয় লক্ষ্যণীয়। এই প্রেক্ষাপটে বই দিবস (World Book and Copyright Day) পাঠ ও বই সংস্কৃতিকে নতুনভাবে মূল্যায়নের সুযোগ করে দেয়। ইউনেসকো ১৯৯৫ সালে ২৩ এপ্রিলকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা শেক্সপিয়ার ও সারভান্তেসের মৃত্যুদিবস হিসেবেও পরিচিত (UNESCO, 1995)। প্রবন্ধে আলোচিত হবে এই দিবসের প্রাসঙ্গিকতা, বর্তমান পাঠ সংস্কৃতির চিত্র এবং বইকে কেন্দ্র করে গঠিত জ্ঞানসমাজের ভবিষ্যৎ।

১.

পাঠাভ্যাসের ক্রমাবনতি: একটি বৈশ্বিক চিত্র

বর্তমানে দ্রুতগামী ডিজিটাল কনটেন্টের ভিড়ে বইয়ের প্রতি আগ্রহ দিনদিন কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী গবেষণা অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কিশোরদের মধ্যে মাত্র ৩২% নিয়মিত বই পড়ে, যেখানে ২০০০ সালে এ হার ছিল ৫০% (Pew Research Center, 2022)। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি জরিপে দেখা যায়, ১৮–২৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে মাত্র ১১% নিয়মিত বই পড়ে (BRAC Institute of Educational Development, 2019)।

এই প্রবণতা শুধুই বিনোদনমূলক পাঠ নয়, একাডেমিক পাঠের উপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

২. বই, ভাষা ও সংস্কৃতি: আত্মপরিচয়ের উপাদান

বই কেবল তথ্যের বাহক নয়, এটি ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বিশেষত স্থানীয় ভাষায় রচিত সাহিত্য, ইতিহাস ও প্রবন্ধসমূহ একটি জাতির আত্মপরিচয় নির্মাণে মৌলিক ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের ফেব্রুয়ারি বইমেলা প্রতি বছর ৮০–১০০ কোটি টাকার বই বিক্রির মধ্য দিয়ে পাঠকসংস্কৃতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে (Bangla Academy, 2023)। ইউনেস্কো বই দিবসকে ভাষার বৈচিত্র্য ও প্রকাশনার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য একটি কৌশলগত দিন হিসেবে বিবেচনা করে (UNESCO, 2023)।

৩. লেখক-প্রকাশক-পাঠক: একটি জ্ঞান-অর্থনীতির ত্রিভুজ

একটি বই কেবল একটি লেখকের সৃষ্টি নয়—এর সঙ্গে যুক্ত থাকে সম্পাদক, প্রকাশক, ডিস্ট্রিবিউটর, বিক্রেতা ও পাঠকের সমন্বিত চর্চা। বই দিবস এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে দৃশ্যমান করে এবং প্রকাশনা শিল্পকে উৎসাহিত করে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী বই শিল্পের বাজার ছিল প্রায় ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (Statista, 2022), যা বইকে কেবল জ্ঞানের নয়, অর্থনৈতিকভাবে টেকসই একটি পণ্য হিসেবেও চিহ্নিত করে।

৪. বই ও মননের বিকাশ: মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

মনোবিজ্ঞানীরা বহু গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, পাঠ্যবই বা কল্পকাহিনিভিত্তিক সাহিত্য পাঠ মানুষের কগনিটিভ ক্ষমতা, আবেগীয় প্রতিক্রিয়া এবং সহানুভূতি বৃদ্ধি করে (Mar et al., 2006)। বিশেষ করে মুদ্রিত বই পাঠের সময় মস্তিষ্কে গভীর মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি সক্রিয় হয়, যা স্ক্রিনভিত্তিক পড়ার তুলনায় বেশি কার্যকর (Mangen et al., 2013)।

বই দিবস তাই কেবল পাঠে উৎসাহ প্রদান নয়—এটি মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক সমৃদ্ধির দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

৫. শিশুকালেই পাঠ: ভবিষ্যৎ নির্মাণের ভিত্তি

Early childhood literacy is directly related to long-term academic achievement and cognitive development. ইউনিসেফের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের হাতে বই তুলে না দিলে তাদের ভাষা ও চিন্তা বিকাশ ব্যাহত হয় (UNICEF, 2020)।

বিশ্বে অনেক দেশ ইতোমধ্যেই ‘Reading Start’ বা ‘Bookstart’ প্রোগ্রাম চালু করেছে যা জন্মের পর থেকেই শিশুদের জন্য বই উপহার প্রদানের কার্যক্রম। বই দিবস এমন উদ্যোগের সামাজিক ও নীতিগত গুরুত্বকে তুলে ধরে।

বই দিবস কেবল একটি দিন নয়- এটি একটি প্রতিজ্ঞা, একটি আন্দোলন। পাঠাভ্যাস পুনর্গঠনের জন্য, ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার জন্য, মননের উন্নয়নের জন্য, এবং শিশুদের সৃজনশীল ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য বই দিবস অপরিহার্য। আমাদের উচিত এই দিনটিকে কেন্দ্র করে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পাঠসংস্কৃতি ফেরাতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বই একা পড়া যায়, কিন্তু তার আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক

ঢাকা/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

বই দিবসের প্রয়োজনীয়তা

“Reading is essential for those who seek to rise above the ordinary.” – Jim Rohn

পাঠ এক মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রধানতম উপায়। কিন্তু প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিক সমাজে পাঠাভ্যাসের অবক্ষয় লক্ষ্যণীয়। এই প্রেক্ষাপটে বই দিবস (World Book and Copyright Day) পাঠ ও বই সংস্কৃতিকে নতুনভাবে মূল্যায়নের সুযোগ করে দেয়। ইউনেসকো ১৯৯৫ সালে ২৩ এপ্রিলকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা শেক্সপিয়ার ও সারভান্তেসের মৃত্যুদিবস হিসেবেও পরিচিত (UNESCO, 1995)। প্রবন্ধে আলোচিত হবে এই দিবসের প্রাসঙ্গিকতা, বর্তমান পাঠ সংস্কৃতির চিত্র এবং বইকে কেন্দ্র করে গঠিত জ্ঞানসমাজের ভবিষ্যৎ।

১. পাঠাভ্যাসের ক্রমাবনতি: একটি বৈশ্বিক চিত্র

বর্তমানে দ্রুতগামী ডিজিটাল কনটেন্টের ভিড়ে বইয়ের প্রতি আগ্রহ দিনদিন কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী গবেষণা অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কিশোরদের মধ্যে মাত্র ৩২% নিয়মিত বই পড়ে, যেখানে ২০০০ সালে এ হার ছিল ৫০% (Pew Research Center, 2022)। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি জরিপে দেখা যায়, ১৮–২৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে মাত্র ১১% নিয়মিত বই পড়ে (BRAC Institute of Educational Development, 2019)।

এই প্রবণতা শুধুই বিনোদনমূলক পাঠ নয়, একাডেমিক পাঠের উপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

২. বই, ভাষা ও সংস্কৃতি: আত্মপরিচয়ের উপাদান

বই কেবল তথ্যের বাহক নয়, এটি ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বিশেষত স্থানীয় ভাষায় রচিত সাহিত্য, ইতিহাস ও প্রবন্ধসমূহ একটি জাতির আত্মপরিচয় নির্মাণে মৌলিক ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের ফেব্রুয়ারি বইমেলা প্রতি বছর ৮০–১০০ কোটি টাকার বই বিক্রির মধ্য দিয়ে পাঠকসংস্কৃতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে (Bangla Academy, 2023)। ইউনেস্কো বই দিবসকে ভাষার বৈচিত্র্য ও প্রকাশনার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য একটি কৌশলগত দিন হিসেবে বিবেচনা করে (UNESCO, 2023)।

৩. লেখক-প্রকাশক-পাঠক: একটি জ্ঞান-অর্থনীতির ত্রিভুজ

একটি বই কেবল একটি লেখকের সৃষ্টি নয়—এর সঙ্গে যুক্ত থাকে সম্পাদক, প্রকাশক, ডিস্ট্রিবিউটর, বিক্রেতা ও পাঠকের সমন্বিত চর্চা। বই দিবস এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে দৃশ্যমান করে এবং প্রকাশনা শিল্পকে উৎসাহিত করে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী বই শিল্পের বাজার ছিল প্রায় ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (Statista, 2022), যা বইকে কেবল জ্ঞানের নয়, অর্থনৈতিকভাবে টেকসই একটি পণ্য হিসেবেও চিহ্নিত করে।

৪. বই ও মননের বিকাশ: মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

মনোবিজ্ঞানীরা বহু গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, পাঠ্যবই বা কল্পকাহিনিভিত্তিক সাহিত্য পাঠ মানুষের কগনিটিভ ক্ষমতা, আবেগীয় প্রতিক্রিয়া এবং সহানুভূতি বৃদ্ধি করে (Mar et al., 2006)। বিশেষ করে মুদ্রিত বই পাঠের সময় মস্তিষ্কে গভীর মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি সক্রিয় হয়, যা স্ক্রিনভিত্তিক পড়ার তুলনায় বেশি কার্যকর (Mangen et al., 2013)।

বই দিবস তাই কেবল পাঠে উৎসাহ প্রদান নয়—এটি মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক সমৃদ্ধির দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

৫. শিশুকালেই পাঠ: ভবিষ্যৎ নির্মাণের ভিত্তি

Early childhood literacy is directly related to long-term academic achievement and cognitive development. ইউনিসেফের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের হাতে বই তুলে না দিলে তাদের ভাষা ও চিন্তা বিকাশ ব্যাহত হয় (UNICEF, 2020)।

বিশ্বে অনেক দেশ ইতোমধ্যেই ‘Reading Start’ বা ‘Bookstart’ প্রোগ্রাম চালু করেছে যা জন্মের পর থেকেই শিশুদের জন্য বই উপহার প্রদানের কার্যক্রম। বই দিবস এমন উদ্যোগের সামাজিক ও নীতিগত গুরুত্বকে তুলে ধরে।

বই দিবস কেবল একটি দিন নয়- এটি একটি প্রতিজ্ঞা, একটি আন্দোলন। পাঠাভ্যাস পুনর্গঠনের জন্য, ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার জন্য, মননের উন্নয়নের জন্য, এবং শিশুদের সৃজনশীল ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য বই দিবস অপরিহার্য। আমাদের উচিত এই দিনটিকে কেন্দ্র করে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পাঠসংস্কৃতি ফেরাতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বই একা পড়া যায়, কিন্তু তার আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ