ভাই ও বোনেরা, বিশেষত যাঁরা ব্যথায় আর দুঃখে যাপন করছেন, তাঁদের নিঃশব্দ ক্রন্দন ঈশ্বরের কানে পৌঁছে গেছে, তাঁদের প্রতিটি অশ্রুর বিচার নেবেন তিনি। ঈশ্বরের তাদের একটিকেও ভুলে যাবেন না! যিশুর সেই দীর্ঘ পথ, রক্তমাখা, কণ্টকিত সেই মৃত্যু, সেই পথ ধরে ঈশ্বর তাঁর কাঁধে তুলে নিয়েছেন সব মন্দের ভার, আর নিজের দয়ার ভেতর দিয়ে তাকে পরাস্ত করেছেন। হেরে গেছে সেই অহংকার, যা মানুষের হৃদয়কে বিষাক্ত করে তোলে, যা ডানে–বাঁয়ে ছড়িয়ে দেয় বৈরিতা আর পঙ্কিলতা। সেই অহংকার হেরে গেছে, খোদার মেষশাবক (যিশু) জয়ী হয়েছেন! তাই আজ আমরা কণ্ঠ ছেড়ে বলি: ‘আমার আশার খ্রিষ্ট জেগে উঠেছেন!’ (ভিক্তিমে পাসকালি লাউদেস)

যিশুর এই পুনরুত্থান, এটাই আমাদের আশার ভিত্তি। এর আলোকে, আশা আর সামান্য ভেলকি থাকে না। যিশুর রহমে, ক্রুশবিদ্ধ যিশু, পুনরুত্থিত যিশুর রহমে, আশা আর আশাহত করে না! স্পেস নন কনফুন্দিত! (রোম ৫: ৫)। আশা আর পালানোর রাস্তা নয়, আশাই চ্যালেঞ্জ; আশা কোনো ধোঁয়াশা নয়, আশাবাদই আমাদের শক্তি।

যাঁরা ঈশ্বরের ওপর ভরসা রাখেন, তাঁরা তাঁদের নরম হাত নিশ্চিন্তে রেখেছেন এক মহাশক্তিশালী দৃঢ় হাতে। তাঁরা উঠে দাঁড়াবেন, তাঁরা আবার হাঁটবেন। পুনরুত্থিত যিশুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও হয়ে ওঠেন আশার তীর্থযাত্রী, ভালোবাসার আর জীবনের নিরস্ত্র শক্তির বিজয়গাথার সাক্ষী।

খ্রিষ্ট জেগে উঠেছেন! এই শব্দেই লুকানো আমাদের অস্তিত্বের মানে, কারণ আমরা মৃত্যুর জন্য গড়া নই, জীবন আমাদের অভীষ্ট। ইস্টার, এটা তো জীবনের উৎসব! ঈশ্বর আমাদের তৈরি করেছেন জীবনকে লক্ষ্য রেখে, তিনি চান যেন এই কোটি মানুষের পরিবার আবার উঠে দাঁড়ায়! তাঁর চোখে প্রতিটি জীবন মূল্যবান! গর্ভের শিশুটি যেমন, তেমনি মূল্যবান বৃদ্ধেরা বা অসুস্থরাও, যাদের আজ দেশে দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ উচ্ছিষ্ট মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

মৃত্যু আর খুনের কত পিপাসা চারদিকে! প্রতিদিন যুদ্ধ আর লড়াইয়ের নামে পৃথিবীর দিকে দিকে আমরা প্রতিদিন শুধু খুনই প্রত্যক্ষ করি! পরিবারের ভেতরে পর্যন্ত, কত জিঘাংসা, নারী আর শিশু যার স্বীকার। যারা দুর্বল, যাদের চলন বা ভাষা আমাদের মতো নয়, আর যারা অভিবাসী, তাদের দিকে অবিরত ছুড়ে দেওয়া হয় তাচ্ছিল্য আর ঘৃণা।
এই দিনে, আমি চাই আমরা সবাই আবার আশা করতে শিখি, ফিরিয়ে আনি বিশ্বাস, অন্যের ওপর বিশ্বাস, নিজেদের ওপর বিশ্বাস, তাদের ওপর বিশ্বাস যারা আমাদের মতো নয়, বা যারা অন্য দেশ থেকে এসেছে, যারা সঙ্গে নিয়ে এসেছে ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন যাপন, আর ভিন্ন চিন্তা ধারণ ধরা! কারণ, সব ভিন্নতার ঊর্ধ্বে, আমরা সবাই এক স্রষ্টার সন্তান!

আমি চাই আমরা সবাই বিশ্বাস করি, শান্তি সম্ভব!
পবিত্র সমাধি থেকে, পুনরুত্থানের গির্জা থেকে, যেখানে এবার একই দিনে ক্যাথলিক আর অর্থোডক্সরা একত্রে ইস্টার পালন করছে, যেন আলো ছড়িয়ে পড়ে পুণ্যভূমি হয়ে গোটা পৃথিবীতে। আমি জানাতে চাই, আমিও ভাগীদার ফিলিস্তিন আর ইসরায়েলের খ্রিষ্টানদের কষ্টের এবং শুধু খ্রিষ্টান নয়, ফিলিস্তিন আর ইসরায়েলের সব মানুষেরও। এ সময়ে বাড়তে থাকা ইহুদিবিদ্বেষের হওয়া আমাকে ভাবায়। কিন্তু সেই সঙ্গে আমি ভাবি গাজার মানুষের কথা, বিশেষত সেখানকার খ্রিষ্টানদের কথা, যাঁদের চারদিকে তীব্র সংঘাত শুধু মৃত্যু আর ধ্বংস উৎপাদন করে চলেছে, জিইয়ে রেখেছে এক নাটকীয় আর নারকীয় অমানবিক পরিস্থিতি। আমি হাত জোড় করে বলি যুদ্ধংদেহী পক্ষদের কাছে, আপনারা যুদ্ধ থামান, বন্দীদের ফিরিয়ে দিন, আর এগিয়ে আসুন সেই ক্ষুধার্তদের পাশে, যারা শুধু একফোঁটা শান্তির স্বপ্ন দেখে।

আসুন, আমরা প্রার্থনা করি, লেবানন আর সিরিয়ার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়দের জন্য, এ মুহূর্তে যাঁরা ইতিহাসের এক নাজুক মুহূর্তে বাস করছেন। তাঁরা চান একটু স্থিরতা, তাঁরা চান নিজেদের জাতির আর দেশের ভাগ্যে নিজেদের অংশগ্রহণ। আমি গির্জার প্রতিটি হিস্যাদারকে বলি, আপনার চিন্তা থেকে, আপনার প্রার্থনা থেকে, প্রিয় মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিষ্টানরা কখনো যেন বাদ না পড়ে।

আমার মন পড়ে থাকে ইয়েমেনেও, যুদ্ধ যাদের জীবনকে পরিণত করেছে পৃথিবীর অন্যতম নিদারুণ ও প্রলম্বিত এক মানবেতর দুঃখের গল্পে। আমি আহ্বান জানাই, আসুন, আমরা কথা বলি, আমরা গঠনমূলক সংলাপের ভেতর দিয়ে এর সমাধান খুঁজি।
পুনরুত্থিত যিশু যেন ইউক্রেনকে, যে ইউক্রেন আজও যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সটান দাঁড়িয়ে, তাঁর ইস্টারের শান্তির উপহার দেন। যারা দীর্ঘস্থায়ী আর সুবিচারস্নাত শান্তির লক্ষ্যে কাজ করছে, তাদের প্রতি থাকুক যিশুর পক্ষ থেকে উৎসাহ আর অবিচল সমর্থন।

এই উৎসবের দিনে, আমাদের মনে সজাগ থাকুক দক্ষিণ ককেশাস। আমরা প্রার্থনা করি, আর্মেনিয়া আর আজারবাইজানের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ একটি শান্তিচুক্তি শিগগিরই চিরকালের জন্য বাস্তবায়িত হোক, কাগজে স্বাক্ষরিত হোক, জীবনে জাগরূক হোক, আর দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে পূর্ণতা পাক মেলবন্ধনের বহুপ্রতীক্ষিত স্বপ্ন।

ইস্টারের আলো ছড়িয়ে পড়ুক পশ্চিম বলকানে, যাতে সৌহার্দ্য প্রাধান্য পায়, যাতে রাজনীতিকেরা কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করে যেতে পারেন, ভয় আর সংকটের পথে নয়, বরং স্থিতিশীল সহাবস্থানের পথে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে সঙ্গে নিয়ে।

পুনরুত্থিত যিশু, যিনি আমাদের ভরসাস্থল, যেন শান্তি ও সান্ত্বনা নিয়ে আসেন আফ্রিকার মানুষদের জন্য, যারা নির্যাতনের আর সংঘাতের বলি হয়েই চলেছে, বিশেষ করে কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, সুদান ও দক্ষিণ সুদানে। সে সঙ্গে তিনি যেন সাহেল (নাইজার, চাদ, মালি প্রভৃতি—অনুবাদক), হর্ন অব আফ্রিকা (সোমালিয়া, সোমালিল্যান্ড, ইথিওপিয়া প্রভৃতি—অনুবাদক) আর গ্রেট লেক (রুয়ান্ডা, উগান্ডা, কেনিয়া, তানজানিয়া প্রভৃতি—অনুবাদক) অঞ্চলে বেদনাবিধুর মানুষদের যন্ত্রণা লাঘব করেন, আর শান্তি এনে দেন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা সেই খ্রিষ্টানদের, যাঁরা প্রভু যিশুর ওপর তাঁদের বিশ্বাস লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হন।

শান্তি অসম্ভব, যদি না থাকে ধর্মীয় স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, বাক্‌স্বাধীনতা আর ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা।

শান্তি অসম্ভব, যত দিন অস্ত্রের ঝনঝনানি পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে! প্রতিটা মানুষ আর প্রতিটা জনপদ আত্মরক্ষার দায় নিজেই বহন করবে, এই অসম্ভব শর্ত যেন পৃথিবীর প্রতিটা জাতিকে ক্যান্টনমেন্টে পরিণত না করে। ইস্টারের আলো আমাদের ঠেলে দেয়, ভেঙে ফেলো দেয়াল, যেই দেয়াল মানুষকে দল থেকে উপদলে ভাগ করে, রাজনীতি আর অর্থনীতির হিসাবের খাতায় আনে ঋণ আর বিপদ। ইস্টারের আলো আমাদের প্রেরণা দেয়, একে অন্যের দিকে হাত বাড়াও, দূরে ঠেলে দিয়ো না, এক হও, ভালোবাসো। ভ্রাতৃত্ব যেন কাউকে বাদ দিয়ে না হয়, উন্নয়ন যেন আসে প্রতিটি মানুষের জন্য, আমরা যেন কাজ করে যাই এক পূর্ণাঙ্গ উন্নয়নের জন্য।

এ সময়ে আমরা যেন ভুলে না যাই মিয়ানমারের মানুষদের, দীর্ঘ যুদ্ধ যাদের বছরের পর বছর কাবু করে রেখেছে। এর মধ্যেও সাহস আর ধৈর্যে ভর দিয়ে ওরা বেঁচে আছে, সাগাইং অঞ্চলের ভূমিকম্পে তারা ঘর হারিয়েছে, মারা গেছে হাজারো মানুষ, ভুগছে বেঁচে যাওয়া লাখো পরিবার, এতিম শিশুরা, বয়োজ্যেষ্ঠরাও। আমরা প্রার্থনা করি, তাদের জন্যও, তাদের ভালোবাসার মানুষদের জন্যও। আর ধন্যবাদ জানাই তাঁদের, যাঁরা রিলিফকজে সাহায্য করছেন নিঃস্বার্থভাবে। মিয়ানমারের বিভিন্ন পক্ষের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা পুরো দেশটির জন্যই এক আশা জাগানো খবর। যারা অস্ত্র নামিয়ে রাখছে, তারা যেন ইস্টারের পুনরুত্থানের আলো হয়ে ওঠে বাকিদের চোখে।

আমি মুক্তকণ্ঠে অনুরোধ করি, যারা আজ রাজনীতির গুরুদায়িত্বে, ভয়ের যুক্তিতে নিজেদের বন্দী করে রাখবেন না, এতে শুধু দূরত্বই বাড়বে। বরং আপনার সম্পদ ব্যবহার করুন অসহায়কে সাহায্য করতে, ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, উন্নয়ন প্রসারিত হয় এমন সব উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে। এটাই তো আসল ‘অস্ত্র’, শান্তির ‘অস্ত্র’: ভবিষ্যৎ গড়ার অস্ত্র, মৃত্যুর বীজ বপনের মারণাস্ত্র নয়।

‘মানবতা’—এই মূলমন্ত্রটি যেন আমাদের প্রতিদিনের আচরণে থাকে সর্বোচ্চ লক্ষ্য হিসেবে। যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা যখন আত্মরক্ষার সামর্থ্যহীন সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে, আর স্কুল, হাসপাতাল আর ত্রাণকর্মীদের আক্রমণ করে, আমরা যেন ভুলে না বসি, আক্রমণের এই লক্ষ্যবস্তুরা কোনো টার্গেট নয়, জলজ্যান্ত রক্তমাংসের মানুষ। আর এই প্রতিটি মানুষের আছে একটা প্রাণ, একটা আত্মা, একটা মানুষের সমান মর্যাদা।

এই জুবিলি বর্ষে (চার্চের ভাষায়, প্রতি ২৫ বছর পরপর জুবিলি বর্ষ পালিত হয়), ইস্টার হয়ে উঠুক যুদ্ধবন্দী আর রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির এক মোক্ষম উপলক্ষ।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
প্রভুর পাসকাল রহস্যে (অর্থাৎ ক্রুশবিদ্ধ হওয়া ও পুনরুত্থানের পুরো ঘটনাপ্রবাহে), মৃত্যু আর জীবন একে অপরের সঙ্গে এক ভয়ংকর পাঞ্জায় লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু যিনি উঠে এসেছেন মৃত্যু ছিঁড়ে, সেই প্রভু এখন চিরঞ্জীব (ভিক্তিমে পাসকালি লাউদেস)। তিনি আমাদের নিশ্চয়তা দেন, আমরাও তার সঙ্গে সঙ্গে ডাক পেয়েছি এমন এক অন্তহীন জীবনের, যেখানে আর কোনো অস্ত্রের দাপট থাকবে না, থাকবে না মৃত্যুর কর্কশ উদ্‌যাপন। তাঁর হাতে আমরা নিজেদের সঁপে দিই, কারণ কেবল তিনিই তো পারেন সবকিছু নতুন করে গড়তে (প্রকাশিত বাক্য ২১:৫)।
সবাইকে ইস্টারের শুভেচ্ছা!

ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষ্য অবলম্বনে অনুবাদ করেছেন মিম আরাফাত মানব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র জন য র জ বন আম দ র র জন ত লক ষ য অন ব দ আপন র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

শান্তি অসম্ভব, যত দিন অস্ত্রের ঝনঝনানি পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে

ভাই ও বোনেরা, বিশেষত যাঁরা ব্যথায় আর দুঃখে যাপন করছেন, তাঁদের নিঃশব্দ ক্রন্দন ঈশ্বরের কানে পৌঁছে গেছে, তাঁদের প্রতিটি অশ্রুর বিচার নেবেন তিনি। ঈশ্বরের তাদের একটিকেও ভুলে যাবেন না! যিশুর সেই দীর্ঘ পথ, রক্তমাখা, কণ্টকিত সেই মৃত্যু, সেই পথ ধরে ঈশ্বর তাঁর কাঁধে তুলে নিয়েছেন সব মন্দের ভার, আর নিজের দয়ার ভেতর দিয়ে তাকে পরাস্ত করেছেন। হেরে গেছে সেই অহংকার, যা মানুষের হৃদয়কে বিষাক্ত করে তোলে, যা ডানে–বাঁয়ে ছড়িয়ে দেয় বৈরিতা আর পঙ্কিলতা। সেই অহংকার হেরে গেছে, খোদার মেষশাবক (যিশু) জয়ী হয়েছেন! তাই আজ আমরা কণ্ঠ ছেড়ে বলি: ‘আমার আশার খ্রিষ্ট জেগে উঠেছেন!’ (ভিক্তিমে পাসকালি লাউদেস)

যিশুর এই পুনরুত্থান, এটাই আমাদের আশার ভিত্তি। এর আলোকে, আশা আর সামান্য ভেলকি থাকে না। যিশুর রহমে, ক্রুশবিদ্ধ যিশু, পুনরুত্থিত যিশুর রহমে, আশা আর আশাহত করে না! স্পেস নন কনফুন্দিত! (রোম ৫: ৫)। আশা আর পালানোর রাস্তা নয়, আশাই চ্যালেঞ্জ; আশা কোনো ধোঁয়াশা নয়, আশাবাদই আমাদের শক্তি।

যাঁরা ঈশ্বরের ওপর ভরসা রাখেন, তাঁরা তাঁদের নরম হাত নিশ্চিন্তে রেখেছেন এক মহাশক্তিশালী দৃঢ় হাতে। তাঁরা উঠে দাঁড়াবেন, তাঁরা আবার হাঁটবেন। পুনরুত্থিত যিশুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও হয়ে ওঠেন আশার তীর্থযাত্রী, ভালোবাসার আর জীবনের নিরস্ত্র শক্তির বিজয়গাথার সাক্ষী।

খ্রিষ্ট জেগে উঠেছেন! এই শব্দেই লুকানো আমাদের অস্তিত্বের মানে, কারণ আমরা মৃত্যুর জন্য গড়া নই, জীবন আমাদের অভীষ্ট। ইস্টার, এটা তো জীবনের উৎসব! ঈশ্বর আমাদের তৈরি করেছেন জীবনকে লক্ষ্য রেখে, তিনি চান যেন এই কোটি মানুষের পরিবার আবার উঠে দাঁড়ায়! তাঁর চোখে প্রতিটি জীবন মূল্যবান! গর্ভের শিশুটি যেমন, তেমনি মূল্যবান বৃদ্ধেরা বা অসুস্থরাও, যাদের আজ দেশে দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ উচ্ছিষ্ট মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

মৃত্যু আর খুনের কত পিপাসা চারদিকে! প্রতিদিন যুদ্ধ আর লড়াইয়ের নামে পৃথিবীর দিকে দিকে আমরা প্রতিদিন শুধু খুনই প্রত্যক্ষ করি! পরিবারের ভেতরে পর্যন্ত, কত জিঘাংসা, নারী আর শিশু যার স্বীকার। যারা দুর্বল, যাদের চলন বা ভাষা আমাদের মতো নয়, আর যারা অভিবাসী, তাদের দিকে অবিরত ছুড়ে দেওয়া হয় তাচ্ছিল্য আর ঘৃণা।
এই দিনে, আমি চাই আমরা সবাই আবার আশা করতে শিখি, ফিরিয়ে আনি বিশ্বাস, অন্যের ওপর বিশ্বাস, নিজেদের ওপর বিশ্বাস, তাদের ওপর বিশ্বাস যারা আমাদের মতো নয়, বা যারা অন্য দেশ থেকে এসেছে, যারা সঙ্গে নিয়ে এসেছে ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন যাপন, আর ভিন্ন চিন্তা ধারণ ধরা! কারণ, সব ভিন্নতার ঊর্ধ্বে, আমরা সবাই এক স্রষ্টার সন্তান!

আমি চাই আমরা সবাই বিশ্বাস করি, শান্তি সম্ভব!
পবিত্র সমাধি থেকে, পুনরুত্থানের গির্জা থেকে, যেখানে এবার একই দিনে ক্যাথলিক আর অর্থোডক্সরা একত্রে ইস্টার পালন করছে, যেন আলো ছড়িয়ে পড়ে পুণ্যভূমি হয়ে গোটা পৃথিবীতে। আমি জানাতে চাই, আমিও ভাগীদার ফিলিস্তিন আর ইসরায়েলের খ্রিষ্টানদের কষ্টের এবং শুধু খ্রিষ্টান নয়, ফিলিস্তিন আর ইসরায়েলের সব মানুষেরও। এ সময়ে বাড়তে থাকা ইহুদিবিদ্বেষের হওয়া আমাকে ভাবায়। কিন্তু সেই সঙ্গে আমি ভাবি গাজার মানুষের কথা, বিশেষত সেখানকার খ্রিষ্টানদের কথা, যাঁদের চারদিকে তীব্র সংঘাত শুধু মৃত্যু আর ধ্বংস উৎপাদন করে চলেছে, জিইয়ে রেখেছে এক নাটকীয় আর নারকীয় অমানবিক পরিস্থিতি। আমি হাত জোড় করে বলি যুদ্ধংদেহী পক্ষদের কাছে, আপনারা যুদ্ধ থামান, বন্দীদের ফিরিয়ে দিন, আর এগিয়ে আসুন সেই ক্ষুধার্তদের পাশে, যারা শুধু একফোঁটা শান্তির স্বপ্ন দেখে।

আসুন, আমরা প্রার্থনা করি, লেবানন আর সিরিয়ার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়দের জন্য, এ মুহূর্তে যাঁরা ইতিহাসের এক নাজুক মুহূর্তে বাস করছেন। তাঁরা চান একটু স্থিরতা, তাঁরা চান নিজেদের জাতির আর দেশের ভাগ্যে নিজেদের অংশগ্রহণ। আমি গির্জার প্রতিটি হিস্যাদারকে বলি, আপনার চিন্তা থেকে, আপনার প্রার্থনা থেকে, প্রিয় মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিষ্টানরা কখনো যেন বাদ না পড়ে।

আমার মন পড়ে থাকে ইয়েমেনেও, যুদ্ধ যাদের জীবনকে পরিণত করেছে পৃথিবীর অন্যতম নিদারুণ ও প্রলম্বিত এক মানবেতর দুঃখের গল্পে। আমি আহ্বান জানাই, আসুন, আমরা কথা বলি, আমরা গঠনমূলক সংলাপের ভেতর দিয়ে এর সমাধান খুঁজি।
পুনরুত্থিত যিশু যেন ইউক্রেনকে, যে ইউক্রেন আজও যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সটান দাঁড়িয়ে, তাঁর ইস্টারের শান্তির উপহার দেন। যারা দীর্ঘস্থায়ী আর সুবিচারস্নাত শান্তির লক্ষ্যে কাজ করছে, তাদের প্রতি থাকুক যিশুর পক্ষ থেকে উৎসাহ আর অবিচল সমর্থন।

এই উৎসবের দিনে, আমাদের মনে সজাগ থাকুক দক্ষিণ ককেশাস। আমরা প্রার্থনা করি, আর্মেনিয়া আর আজারবাইজানের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ একটি শান্তিচুক্তি শিগগিরই চিরকালের জন্য বাস্তবায়িত হোক, কাগজে স্বাক্ষরিত হোক, জীবনে জাগরূক হোক, আর দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে পূর্ণতা পাক মেলবন্ধনের বহুপ্রতীক্ষিত স্বপ্ন।

ইস্টারের আলো ছড়িয়ে পড়ুক পশ্চিম বলকানে, যাতে সৌহার্দ্য প্রাধান্য পায়, যাতে রাজনীতিকেরা কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করে যেতে পারেন, ভয় আর সংকটের পথে নয়, বরং স্থিতিশীল সহাবস্থানের পথে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে সঙ্গে নিয়ে।

পুনরুত্থিত যিশু, যিনি আমাদের ভরসাস্থল, যেন শান্তি ও সান্ত্বনা নিয়ে আসেন আফ্রিকার মানুষদের জন্য, যারা নির্যাতনের আর সংঘাতের বলি হয়েই চলেছে, বিশেষ করে কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, সুদান ও দক্ষিণ সুদানে। সে সঙ্গে তিনি যেন সাহেল (নাইজার, চাদ, মালি প্রভৃতি—অনুবাদক), হর্ন অব আফ্রিকা (সোমালিয়া, সোমালিল্যান্ড, ইথিওপিয়া প্রভৃতি—অনুবাদক) আর গ্রেট লেক (রুয়ান্ডা, উগান্ডা, কেনিয়া, তানজানিয়া প্রভৃতি—অনুবাদক) অঞ্চলে বেদনাবিধুর মানুষদের যন্ত্রণা লাঘব করেন, আর শান্তি এনে দেন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা সেই খ্রিষ্টানদের, যাঁরা প্রভু যিশুর ওপর তাঁদের বিশ্বাস লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হন।

শান্তি অসম্ভব, যদি না থাকে ধর্মীয় স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, বাক্‌স্বাধীনতা আর ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা।

শান্তি অসম্ভব, যত দিন অস্ত্রের ঝনঝনানি পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে! প্রতিটা মানুষ আর প্রতিটা জনপদ আত্মরক্ষার দায় নিজেই বহন করবে, এই অসম্ভব শর্ত যেন পৃথিবীর প্রতিটা জাতিকে ক্যান্টনমেন্টে পরিণত না করে। ইস্টারের আলো আমাদের ঠেলে দেয়, ভেঙে ফেলো দেয়াল, যেই দেয়াল মানুষকে দল থেকে উপদলে ভাগ করে, রাজনীতি আর অর্থনীতির হিসাবের খাতায় আনে ঋণ আর বিপদ। ইস্টারের আলো আমাদের প্রেরণা দেয়, একে অন্যের দিকে হাত বাড়াও, দূরে ঠেলে দিয়ো না, এক হও, ভালোবাসো। ভ্রাতৃত্ব যেন কাউকে বাদ দিয়ে না হয়, উন্নয়ন যেন আসে প্রতিটি মানুষের জন্য, আমরা যেন কাজ করে যাই এক পূর্ণাঙ্গ উন্নয়নের জন্য।

এ সময়ে আমরা যেন ভুলে না যাই মিয়ানমারের মানুষদের, দীর্ঘ যুদ্ধ যাদের বছরের পর বছর কাবু করে রেখেছে। এর মধ্যেও সাহস আর ধৈর্যে ভর দিয়ে ওরা বেঁচে আছে, সাগাইং অঞ্চলের ভূমিকম্পে তারা ঘর হারিয়েছে, মারা গেছে হাজারো মানুষ, ভুগছে বেঁচে যাওয়া লাখো পরিবার, এতিম শিশুরা, বয়োজ্যেষ্ঠরাও। আমরা প্রার্থনা করি, তাদের জন্যও, তাদের ভালোবাসার মানুষদের জন্যও। আর ধন্যবাদ জানাই তাঁদের, যাঁরা রিলিফকজে সাহায্য করছেন নিঃস্বার্থভাবে। মিয়ানমারের বিভিন্ন পক্ষের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা পুরো দেশটির জন্যই এক আশা জাগানো খবর। যারা অস্ত্র নামিয়ে রাখছে, তারা যেন ইস্টারের পুনরুত্থানের আলো হয়ে ওঠে বাকিদের চোখে।

আমি মুক্তকণ্ঠে অনুরোধ করি, যারা আজ রাজনীতির গুরুদায়িত্বে, ভয়ের যুক্তিতে নিজেদের বন্দী করে রাখবেন না, এতে শুধু দূরত্বই বাড়বে। বরং আপনার সম্পদ ব্যবহার করুন অসহায়কে সাহায্য করতে, ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, উন্নয়ন প্রসারিত হয় এমন সব উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে। এটাই তো আসল ‘অস্ত্র’, শান্তির ‘অস্ত্র’: ভবিষ্যৎ গড়ার অস্ত্র, মৃত্যুর বীজ বপনের মারণাস্ত্র নয়।

‘মানবতা’—এই মূলমন্ত্রটি যেন আমাদের প্রতিদিনের আচরণে থাকে সর্বোচ্চ লক্ষ্য হিসেবে। যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা যখন আত্মরক্ষার সামর্থ্যহীন সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে, আর স্কুল, হাসপাতাল আর ত্রাণকর্মীদের আক্রমণ করে, আমরা যেন ভুলে না বসি, আক্রমণের এই লক্ষ্যবস্তুরা কোনো টার্গেট নয়, জলজ্যান্ত রক্তমাংসের মানুষ। আর এই প্রতিটি মানুষের আছে একটা প্রাণ, একটা আত্মা, একটা মানুষের সমান মর্যাদা।

এই জুবিলি বর্ষে (চার্চের ভাষায়, প্রতি ২৫ বছর পরপর জুবিলি বর্ষ পালিত হয়), ইস্টার হয়ে উঠুক যুদ্ধবন্দী আর রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির এক মোক্ষম উপলক্ষ।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
প্রভুর পাসকাল রহস্যে (অর্থাৎ ক্রুশবিদ্ধ হওয়া ও পুনরুত্থানের পুরো ঘটনাপ্রবাহে), মৃত্যু আর জীবন একে অপরের সঙ্গে এক ভয়ংকর পাঞ্জায় লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু যিনি উঠে এসেছেন মৃত্যু ছিঁড়ে, সেই প্রভু এখন চিরঞ্জীব (ভিক্তিমে পাসকালি লাউদেস)। তিনি আমাদের নিশ্চয়তা দেন, আমরাও তার সঙ্গে সঙ্গে ডাক পেয়েছি এমন এক অন্তহীন জীবনের, যেখানে আর কোনো অস্ত্রের দাপট থাকবে না, থাকবে না মৃত্যুর কর্কশ উদ্‌যাপন। তাঁর হাতে আমরা নিজেদের সঁপে দিই, কারণ কেবল তিনিই তো পারেন সবকিছু নতুন করে গড়তে (প্রকাশিত বাক্য ২১:৫)।
সবাইকে ইস্টারের শুভেচ্ছা!

ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষ্য অবলম্বনে অনুবাদ করেছেন মিম আরাফাত মানব

সম্পর্কিত নিবন্ধ