কমিশন প্রস্তাবিত সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ: প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয়তা
Published: 23rd, April 2025 GMT
কোনো রাজনৈতিক দলের বিবেকবান কট্টর সমর্থকও তাঁর দলের বিপক্ষে যাওয়া ঘটনার পক্ষপাতহীন সংবাদ গণমাধ্যমে দেখতে চান। গণমাধ্যমে সব সময় প্রকৃত সত্য উঠে আসবে—এটিই প্রত্যাশিত। তবে গণমাধ্যমে সমাজের পক্ষপাতহীন চিত্র তুলে ধরা মোটেও সহজ কাজ নয়। এর সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। গণমাধ্যমের প্রধান অংশীজন হলো সাংবাদিক। সাংবাদিক নিরপেক্ষ, চাপমুক্ত ও পেশাদার না হলে তাঁর পক্ষে কোনো ঘটনার সত্য বিবরণী প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এখনো সাংবাদিকতা পেশাটি স্বাধীন কিংবা চাপমুক্ত হতে পারেনি।
এখনো পেশাগত কর্মে নিয়োজিত সাংবাদিকেরা প্রায়ই সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিষয়টি বিবেচনা করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন ‘সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারির প্রস্তাব করেছে। কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে এই অধ্যাদেশের খসড়াও কমিশনের প্রতিবেদনে সংযুক্ত করেছে। সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন কেন প্রয়োজন, তার সুনির্দিষ্ট কারণ উঠে এসেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রকাশ এবং বাক্স্বাধীনতার অধিকার চর্চার কারণে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের সাংবাদিকদের হয়রানি ও শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। সাংবাদিকদের পেশাগত কাজে বাধা দিতে হুমকি, ভীতিপ্রদর্শন, আইনগত হয়রানির মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এসব বেআইনি কার্যক্রম স্বাধীন সাংবাদিকতাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
ক্ষমতাসীন দলের সদস্য কিংবা প্রভাবশালীদের হুমকি ও হামলার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায়ই কোনো সুরক্ষা দেয় না। আর যেখানে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য জড়িত থাকেন, সেখানে প্রশাসনও নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করে এবং আদালতেও প্রতিকার কিংবা সুরক্ষা মেলে না। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এসব আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, হত্যার শিকার হওয়া সাংবাদিকদের অধিকাংশের পরিবারই বিচার পায়নি। এক যুগের বেশি সময় সাগর-রুনি দম্পতির বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় জনগণের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে সাংবাদিকেরা মারলে কিছুই হয় না।
গত দেড় দশকে সাংবাদিকেরা তাঁদের অনলাইন ও অফলাইন রিপোর্টিংয়ের জন্য বিভিন্নভাবে যেমন আক্রমণের শিকার হয়েছেন, তেমনি গ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলায় জেলও খেটেছেন। আলোকচিত্র সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, সাংবাদিক-গবেষক মোবাশ্বের হাসান, সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বিভিন্ন মেয়াদে গুমের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া আড়ি পাতার প্রযুক্তি ব্যবহার ও নজরদারির কারণে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রদান একটি বৈশ্বিক বিষয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদের আইনগত সুরক্ষা প্রদানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য। এ আইনে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সঙ্গে পেশাগতভাবে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি, বিশেষ করে গতিবিধি অনুসরণ ও ব্যক্তিগত যোগাযোগে আড়ি পাতার প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার গণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী সরকার নতুন যে গণমাধ্যম নীতি গ্রহণ করছে, তাতে শারীরিক, যৌন, মানসিক, মৌখিক লাঞ্ছনা (গালাগাল) এবং আইনগত হয়রানি থেকে সাংবাদিকদের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। পাকিস্তানেও মিডিয়া ফ্রিডম প্রটেকশন অ্যাক্ট চূড়ান্ত হওয়ার পর পার্লামেন্টে পাস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশেও সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা আইন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত ‘সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর ভিত্তি হলো সংবিধানের ৩২, ৩৯ ও ৪০ অনুচ্ছেদ। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ, ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা, বিবেক, বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং ৪০ অনুচ্ছেদে পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা ও অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
পেশাগত কাজে সাংবাদিকদের সুরক্ষা প্রদান গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অন্যতম পূর্বশর্ত। এ জন্য সাংবাদিকদের সুরক্ষা প্রদানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন থাকা উচিত। গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রত্যাশা, সরকার দ্রুত সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষাসংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করবে এবং জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে এটি আইন হিসেবে পাস হবে।সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া প্রস্তাবনায় মোট ধারা রয়েছে ২০টি। প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করা গেলে এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক হয়ে থাকবে।
প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশে যেসব ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে, তা সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কারা সাংবাদিক হিসেবে বিবেচিত হবেন, সে বিষয়ও প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে ‘সাংবাদিক/সংবাদকর্মী’ বলতে সার্বক্ষণিক সাংবাদিক; গণমাধ্যমের কাজে নিয়োজিত আছেন—এমন কোনো সম্পাদক, সম্পাদকীয় লেখক, নিউজ এডিটর, উপসম্পাদক, সহসম্পাদক, ভিডিও এডিটর, ফিচার লেখক, রিপোর্টার, সংবাদদাতা; খণ্ডকালীন সাংবাদিক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং বিদেশি গণমাধ্যমের প্রদায়ক হিসেবে কর্মরত সাংবাদিক; গণমাধ্যমের কাজে নিয়োজিত আছেন—এমন কোনো কপি টেস্টার, কার্টুনিস্ট, সংবাদ চিত্রগ্রাহক, গ্রাফিক ডিজাইনার এবং নিবন্ধিত গণমাধ্যমের সংবাদকর্মে নিয়োজিত কর্মীকে বোঝানো হয়েছে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সাংবাদিককে সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানি থেকে সুরক্ষা প্রদানের দায়িত্বে থাকবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ও সরকার। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ ও সরকার যথাযথভাবে সাংবাদিকের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। একই ধারায় আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এমন কোনো কর্মকাণ্ড করবেন না বা নিয়োজিত হবেন না, যা দ্বারা সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবন বা সম্পদের কোনোরূপ ক্ষতি হয়।
নিবর্তনমূলক কোনো আইন বা বিধি দ্বারা সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবন বা সম্পদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয় কিংবা সাংবাদিকদের আইনবহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার বা আটক না করা হয়, সে বিষয়েও পদক্ষেপ নেওয়ার কথা এই ধারায় বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৪ ধারায় সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং গৃহ, পরিবার ও যোগাযোগের সব মাধ্যম সুরক্ষিত রাখার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। একই ধারায় আরও বলা হয়েছে, কেউ ভয়ভীতির মাধ্যমে কিংবা জোরপূর্বক শারীরিক বা মানসিক চাপ প্রয়োগ করে সাংবাদিককে তথ্যসূত্র প্রকাশে বাধ্য করতে পারবেন না।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন-সম্পর্কিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৫ ধারায় বলা হয়েছে, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে কোনো সাংবাদিক যেন সহিংসতা, হুমকি, হয়রানি এবং বিশেষত যৌন হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ও সরকার বিশেষ উদ্যোগ নেবে। প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশে সরল বিশ্বাসে কৃতকর্মের জন্য সাংবাদিকদের সুরক্ষার অধিকার দেওয়া হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে সহায়ক হবে।
অধ্যাদেশের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, পেশাগত কর্মে নিয়োজিত কোনো সাংবাদিক যদি সরল বিশ্বাসে কোনো গণমাধ্যমে তথ্য, উপাত্ত, লিখিত বা অডিও–ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেন এবং এর দ্বারা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে ভিন্ন উদ্দেশ্য প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা রুজু করা যাবে না।
৯ ধারায় কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তি অন্যূন এক বছরের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ১০ ধারায় অর্থদণ্ডকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সাংবাদিককে দেওয়ার বিধানও রাখা হয়েছে।
অধ্যাদেশে মিথ্যা অভিযোগকারীকে শাস্তির আওতায় আনার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো সাংবাদিক আইনানুগ কারণ না থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে অভিযোগ করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশে অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি, বিচার ও তদন্তপ্রক্রিয়া সম্পর্কেও বলা হয়েছে। তবে সাংবাদিক পরিচয়ের অপব্যবহার এবং পেশাবহির্ভূত কোনো অপরাধমূলক কাজের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কোনো সুরক্ষার সুযোগ থাকবে না।
পেশাগত কাজে সাংবাদিকদের সুরক্ষা প্রদান গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অন্যতম পূর্বশর্ত। এ জন্য সাংবাদিকদের সুরক্ষা প্রদানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন থাকা উচিত। গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রত্যাশা, সরকার দ্রুত সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষাসংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করবে এবং জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে এটি আইন হিসেবে পাস হবে।
মো.
মামুন অর রশিদ বিসিএস তথ্য ক্যাডারের সদস্য এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব ধ নত র ধ র য় বল অন চ ছ দ য ক ত কর প শ গত ক ত হব ন হয়র ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ : আইনগত বিশ্লেষণ ও বাস্তবতা
‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ করার অভিযোগে মামলায় সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। এই ধারার অপরাধ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু আলাদা একটা সেকশনে বিচার হবে। এটা আলাদা অপরাধ না, একই অপরাধ। একই আইনের আওতায় পৃথকভাবে এটা হলো। অর্থাৎ এ অপরাধের অভিযোগে আলাদা করে মামলা হবে, যেটির সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর। বিষয়টির আইনগত সংজ্ঞা এবং বাস্তবিক প্রয়োগ নিয়ে আমাদের যথেষ্ট চিন্তাভাবনার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ বাক্যের ফলে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ লঘু হয়ে যেতে পারে।
‘প্রলোভন দেখানো’– এটাকেও ধর্ষণের সংজ্ঞায় ঢুকিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ এফআইআরে যখন লেখা হয় বিয়ের-প্রেমের নামে প্রতারণা বা শারীরিক সম্পর্ক করা হয়েছে, এর ফলে যে ক্ষতিটা হয়েছে, সেটা হলো ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধকেও খর্ব করা হবে। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের মামলা বাংলাদেশে নতুন না। প্রায়ই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই সংক্রান্ত খবর উঠে আসে। কিন্তু বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের বিষয়ে আইনে কী আছে?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারও বিরুদ্ধে যদি ধর্ষণ মামলা করা হয়, তবে তার বিচার হয় ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি অনুযায়ী। দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারাতেই ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একজন পুরুষ যদি আইনে বর্ণিত পাঁচ অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক করা। এর পরই রয়েছে নারীর সম্মতির বিরুদ্ধে কিংবা মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্মতি আদায় করা। তবে কোনো নারীর বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে হয়, তবে তার সম্মতি নেওয়া হোক বা না নেওয়া হোক, তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। কোনো নারী যদি ভুল করে একজন পুরুষকে নিজের আইনসংগত স্বামী ভেবে তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সম্মতি দেন এবং পুরুষটি জানেন যে তিনি তাঁর স্বামী নন, আইনের দৃষ্টিতে এমন শারীরিক সম্পর্কও ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে। পরবর্তী সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের লক্ষ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ বা ২০০০ সালের ৮ নম্বর আইন নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৯-এর (১) নম্বর ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান করা হয়। একই সঙ্গে এর ব্যাখ্যায় নতুন একটি শব্দ সংযোজন করা হয়। তা হলো, ‘প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায়’। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত (ষোলো বৎসরের) অধিক বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’ অসম্মতিতে ধর্ষণ করা সম্ভব না। যদি সম্মতি আদায় করে ধর্ষণ করা হয় তখন আবার প্রশ্ন চলে আসে– এই সম্মতিটা কীভাবে আদায় করা হয়েছে? যেহেতু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এর ব্যাখ্যা দেওয়া নেই, তখন আবার আমাদের দণ্ডবিধিকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হচ্ছে। অর্থাৎ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩৭৫ ধারায় উল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে যেখানে ধর্ষণের সংজ্ঞা সীমাবদ্ধ ছিল, তা এখন আরও বিস্তৃত রূপ নেয় এবং কোনো নারীর সঙ্গে প্রতারণা করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টিও এতে সংযুক্ত হয়। ভবিষ্যতের কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন এবং পরে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার বিষয়টিকেই বর্তমানে ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ মামলায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
নারী যে সম্মতি দিলেন, সেটা কি স্বেচ্ছায়, নাকি কোনো না কোনো প্রলোভন দেখিয়ে বা প্রতারণা করে সম্মতিটা আদায় করা হচ্ছে? সম্মতিটা প্রতারণামূলকভাবে হয়েছে কিনা, সে বিষয়টাই আইনে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো পুরুষ যদি ভবিষ্যতের আশ্বাস দিয়ে কোনো নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং পরে সেই প্রতিশ্রুতি না রাখেন, তবে সেটাই প্রতারণা হবে। যদিও নারীদের সুরক্ষার জন্য আইনটির প্রণয়ন হবে কিন্তু ভবিষ্যতে অনেক ক্ষেত্রে এটি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। অন্যদিকে এই আইন লৈঙ্গিক বৈষম্যমূলক আইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যেহেতু প্রতারণার বিষয়টি আসছে সেহেতু এটাকে আরও ব্যাখ্যা করার সুযোগ রাখতে হবে। কারণ একই কাজ একটা মেয়ে করলে ছেলেটা কি ধর্ষণ মামলা করতে পারবে? পারবে না কিন্তু।
এই সংক্রান্ত একটা মামলা দায়ের হয় পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায়। সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্ত পুরুষটিকে শাস্তি দিয়েছিলেন নিম্ন আদালত। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের সেই রায় খারিজ করে দিয়েছেন। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী যদি কারও সঙ্গে, সম্পূর্ণ পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত থাকেন, তাহলে পরে যথাযথ প্রমাণ ছাড়া সেই নারী তাঁর পুরুষ সঙ্গীর দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন, একথা বলা যায় না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী, যিনি স্বেচ্ছায় এবং কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই তাঁর পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন, পরে তিনি এভাবে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনতে পারেন না, যদি না তাঁর কাছে এই বিষয়ে পোক্ত কোনো প্রমাণ থাকে। আদালতের আরও বক্তব্য, বিয়ের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা একটা ‘কনসেপ্ট’। যেটা এভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ব্যবহার করতে পারেন না। যদি উভয়ই সম্মতিতে নিজেরা মিলিত হন তাহলে তা কোনোভাবেই ধর্ষণের সংজ্ঞাকে প্রতিফলিত করে না। বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় এই ধরনের আইনগত শব্দ প্রয়োগে মামলার সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়বে। সরকারের উচিত এই টার্মকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে আরও চিন্তাভাবনা করা। প্রয়োজন হলে আধুনিক প্রেক্ষাপট চিন্তাভাবনা করে ধর্ষণের নতুন সংজ্ঞা দাঁড় করাতে হবে। কারণ এই টার্মের অপব্যবহারে এর সামাজিক ও লৈঙ্গিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মিথ্যা ধর্ষণ মামলার আড়ালে যেমন প্রকৃত ধর্ষণ মামলা হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি মিথ্যা এসব মামলায় সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।
মো. আসাদুজ্জামান: সহকারী অধ্যাপক, আইন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা