ন্যায়পাল বা লোকপাল বা ‘ওম্বুডসপারসন’ বিভিন্ন দেশে সাংবিধানিক বা বিশেষ আইনে নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাধীন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা। সংবিধানে বা বিশেষ আইনে ন্যায়পালকে তাঁর কাজ বা দায়িত্ব পালনে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ও ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে। অধিকাংশ দেশে ন্যায়পাল আইনসভার অধীন প্রতিষ্ঠান। তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য সংসদের কাছে দায়ী থাকেন এবং সেখানে বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিল করেন। ন্যায়পালের নিয়োগও সংসদের ওপরে বর্তায়।

২.

 
ন্যায়পাল মূলত সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জনসাধারণের উত্থাপিত অনিয়ম, হয়রানি, দীর্ঘসূত্রতা, ভোগান্তি ও দুর্ভোগ সম্পর্কিত যে কোনো অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশের মাধ্যমে সরকারি সেবার মানোন্নয়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করেন। কোনো নাগরিক যদি সরকারি দপ্তরে সেবা পেতে হয়রানি বা অনিয়মের সম্মুখীন হন, সেগুলো তদন্ত করে প্রতিকারের ব্যবস্থাই ন্যায়পালের দায়িত্ব। 
সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সরকারি কর্মিবাহিনীর কাজের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রতিষ্ঠান ন্যায়পাল। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আমলাতান্ত্রিক আচরণ, অনিয়ম, হয়রানি, অবিচার, বাড়াবাড়ি, কর্ম সম্পাদনে অহেতুক বিলম্ব এবং নানাবিধ দুর্ভোগ প্রশমন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই ন্যায়পালের মূল দায়িত্ব। বিশেষ করে গরিব, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সহজেই ন্যায়পালের কাছে অভিযোগ পেশ করার সুযোগ রয়েছে। সরকারি খাতের বেশি জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা এবং মৌলিক সেবাগুলো দক্ষতার সঙ্গে প্রতিপালনে ন্যায়পাল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। 

৩.
ন্যায়পালের প্রতিষ্ঠানটি তিন ধরনের কাজের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত: ক. প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যক্তি সাধারণের অভিযোগের সুরাহা; খ. জনপ্রশাসনের মানোন্নয়নে কাঠামোগত সমস্যা সমাধানের প্রয়াস; গ. সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা।
ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানটি অভিযোগের তদন্ত করে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে। ফলে এতে স্বার্থের সংঘাত থাকে না। ন্যায়পাল তাঁর দায়িত্ব পালনে যে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অন্য যে কোনো ব্যক্তিকে শুনানির জন্য সমন জারি বা যে কোনো তথ্য-উপাত্ত বা দলিল প্রদানে বাধ্য করতে পারেন। তবে নাগরিকদের অভিযোগ ও দুর্ভোগ নিয়ে ন্যায়পালের ক্ষমতা তদন্ত, শুনানি, মধ্যস্থতা, সুপারিশের মধ‍্যে সীমাবদ্ধ। এর সুপারিশ প্রতিপালন সরকারের জন্য বাধ্যতামূলকও নয়। অধিকাংশ দেশেই ন্যায়পাল অভিযোগের ভিত্তিতে আইনগত বা বিচারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না।

৪.
বিশ্বে প্রথম ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুইডেনে ১৮০৯ সালে; এশিয়ায় প্রথম চীন ও ভিয়েতনামে চল্লিশের দশকে। ষাটের দশক থেকে কমনওয়েলথ ও অন্যান্য দেশে প্রতিষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ‍্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ১৯৬২, ১৯৬৭, ১৯৬৮ ও ১৯৭৭ সালে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন ১৯৬৬ সালে কেন্দ্রে লোকপাল এবং প্রদেশে লোকায়ুক্ত নিয়োগের সুপারিশ করে। ইতোমধ্যে ভারতের ১৬টি প্রদেশে লোকায়ুক্ত নিযুক্ত হলেও কেন্দ্রে এখনও লোকপাল নিয়োগ হয়নি। ২০১৩ সালে লোকপাল নিয়োগের আইন ভারতের সংসদে অনুমোদিত হয়েছিল। তবে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা (চিফ পার্লামেন্টারি কমিশনার), থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, হংকংসহ এশিয়ার প্রায় সব দেশে ন্যায়পালের দপ্তর রয়েছে।

৫.
বিভিন্ন দেশে ন্যায়পালের দুটি মডেল রয়েছে। কমনওয়েলথভুক্ত অধিকাংশ দেশে ন্যায়পাল মূলত সেবাপ্রার্থীদের প্রতি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর আচরণ যেমন– পক্ষপাতিত্ব, অহেতুক বিলম্ব, হয়রানি, আমলাতান্ত্রিক বাড়াবাড়ি ও দুর্ভোগ সৃষ্টির অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিকারের সুপারিশ করেন। অথবা শুনানি বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে জনগণের দুর্ভোগ লাঘব ও সেবার মানোন্নয়নে চেষ্টা করেন। বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে ন্যায়পাল নিয়োগে প্রণীত আইনটিও এ মডেলের অন্তর্ভুক্ত। তবে কিছু দেশে ভিন্ন মডেল রয়েছে, যেমন কোরিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। সেখানে ন্যায়পাল প্রধানত দুর্নীতি দমন সংস্থা হিসেবে কাজ করেন। প্রথম গ্রুপের দেশগুলোতে দুর্নীতি দমন কমিশন ও ন্যায়পাল ব্যবস্থা দুই-ই রয়েছে।

৬. 
কোনো কোনো দেশে, যেমন কানাডা ও যুক্তরাজ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তথা পৌরসভাগুলোতেও ন্যায়পালের দপ্তর রয়েছে। আবার কোনো কোনো দেশে বিশেষায়িত ন্যায়পালের দপ্তর রয়েছে। যেমন অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে রয়েছেন ‘চিলড্রেন কমিশনার’ এবং সুইডেনে রয়েছেন ‘চিলড্রেন ন্যায়পাল’। বাংলাদেশেও ২০০৫ সালে এমন বিশেষায়িত ন্যায়পালের দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আয়কর বিভাগে, যা ২০১০ সালে বিলুপ্ত হয়। আবার আজারবাইজান, কিরগিজস্তান এবং উজবেকিস্তানের মতো দেশে ন্যায়পালের দপ্তর জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা হিসেবে কাজ করে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নেও ন্যায়পালের দপ্তর রয়েছে। তারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ তদন্ত করে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। ব্র্যাকের মতো অনেক বৃহৎ এনজিওতে ন্যায়পালের দপ্তর রয়েছে।

৭. 
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে দেশে ন‍্যায়পাল নিয়োগের বিধান রয়েছে। এ জন্য ১৯৮০ সালে বিশেষ আইনও প্রণীত হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারের উচ্চমহল থেকে ন্যায়পালের দপ্তর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এলেও তা কখনও কার্যকর হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও অধ্যাদেশ জারির মাধ‍্যমে জাতীয় ন‍্যায়পাল নিয়োগের সুপারিশ করেছে। বিভিন্ন সরকার ও রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারণী দলিলেও ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এসেছে অনেকবার। কিন্তু রাষ্ট্রের বয়স ৫৪ হলেও ন্যায়পাল নিয়োগের কাজটি অসম্পন্ন থাকা দুর্ভাগ্যজনক।
কেউ কেউ ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে ন‍্যায়পালের দপ্তর প্রতিষ্ঠার আবশ্যিকতা নেই মনে করেন। কিন্তু এ দুটি প্রতিষ্ঠান কি পরস্পরের বিকল্প? তাদের দায়িত্ব কতটা সম্পূরক বা পরিপূরক? দুদকের ২০০৪ সাল এবং ন্যায়পালের ১৯৮০ সালের আইন পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, দুটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ও পৃথক কর্মপরিধি রয়েছে। সংক্ষেপে দুর্নীতি দমন কমিশন মূলত আর্থিক দুর্নীতির বিচার ও প্রতিরোধের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। অপরদিকে ন্যায়পাল সরকারি দপ্তরে সেবাপ্রত্যাশীর ভোগান্তি বা হয়রানির প্রতিকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত। সুতরাং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এ দুই প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পূরক বা পরিপূরক হলেও কাজের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ পৃথক।

৮.
দেশে ন্যায়পালের দপ্তর এতদিনেও প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে সরকারি সেবাপ্রার্থীর হয়রানির যেমন উপশম হচ্ছে না, তেমনি সেবা প্রদানকারী সরকারি দপ্তরের জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাও বিলম্বিত হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, দেশের নাগরিকরা দুর্নীতি দমন কমিশনে যে সংখ্যায় অভিযোগ জানান, তার ৯০ শতাংশ অভিযোগ ‘দুদক’-এর তপশিলভুক্ত দুর্নীতি সম্পর্কিত নয়। সে কারণে ‘দুদক’ এসব অভিযোগ আমলে নিতে পারে না। পেনশন পরিশোধে হয়রানি, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, সামাজিক নিরাপত্তার অধীন বিভিন্ন ভাতা প্রদানে অনিয়ম, রিলিফের চাল চুরি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগে অহেতুক বিলম্ব বা ঘুষ চাওয়া, স্কুলে অতিরিক্ত ফি আদায়, সরকারি চাকরি নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব– নাগরিকদের এ জাতীয় হাজারো অভিযোগ দুদকের এখতিয়ারভুক্ত নয়।
উল্লেখ করা যেতে পারে, দুদক ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৫০০টি, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৪১৫টি, ২০১৬ সালে ১২ হাজার ৯৯০টি এবং ২০১৭ সালে ১৭ হাজার ৯৯৩টি লিখিত অভিযোগ পেয়েছিল; কিন্তু যথাক্রমে মাত্র ১৫, ১৩, ১২ ও ৭ শতাংশ অভিযোগ আমলে নিতে পেরেছিল। কারণ প্রাপ্ত অভিযোগের সিংহভাগই দুদকের তপশিলভুক্ত দুর্নীতি সম্পর্কিত ছিল না। অভিযোগের অধিকাংশই ছিল নাগরিক সেবাপ্রাপ্তিতে হযরানি সম্পর্কিত, যা মূলত ন্যায়পালের এখতিয়ারভুক্ত। সুতরাং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকারের আলোকে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ প্রত্যাশা করে, অচিরেই দেশে জাতীয় ন‍্যায়পাল নিয়োগ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে।

ফিরোজ আহমেদ: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কর্মকর্তা; সদস‍্য, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন
[email protected]

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র স প র শ কর তদন ত কর কর মকর ত ত হয় ছ ল সরক র র ব যবস থ র জন য জনপ র ন নয়ন হয়র ন

এছাড়াও পড়ুন:

বিজয় যখন কড়া নাড়ছে

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাড়া জাগায়। দেশবাসীসহ বিশ্ব জানতে পারে, জাতিগত গণহত্যার মধ্যেই চলেছিল পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এখানে সে সময়ের একটি আলোচিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।

আত্মসমর্পণের আগে

ঢাকায় বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহরের বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁদের মধ্যে পঞ্চাশের বেশি লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। আকস্মিক সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে নিবিড় পরিকল্পনার আওতায় বাঙালি এলিট নিধনের অংশ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এটা অবশ্যই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজিসহ পাকিস্তান হাই কমান্ডের পূর্ণ জ্ঞাতসারে ঘটেছে।

এসব মৃতদেহের আবিষ্কার ঢাকা শহরে উত্তেজনা বাড়াতে পারে, পাল্টা হত্যাকাণ্ড ও দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে, এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে।

ঢাকার মূল শহরের পাশের রায়েরবাজারে কতগুলো বিচ্ছিন্ন গর্তে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। আমি নিজে ৩৫টি গলিত দেহ দেখেছি। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, তাঁরা চার-পাঁচ দিন আগে নিহত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি হবে। ঢাকায় অপহরণ করা এ ধরনের লোকের সংখ্যা অন্তত ১৫০ হতে পারে।

ইউপিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান হৃদ্​রোগ চিকিৎসক ফজলে রাব্বী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান মুনীর চৌধুরী রয়েছেন। ঢাকার মধ্যবিত্ত এলাকা ধানমন্ডির বাইরে একটি ইটখোলাকে বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও কচুরিপানার নীল-সাদা ফুল কর্দমাক্ত জলাশয়ে শোভা পাচ্ছে। স্থানটি লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ ঢাকার শত শত মানুষ মাটির বাঁধ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এখানে এসেছে, তাদের অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দিষ্ট স্বজনদের।

বিশিষ্টজনদের অপহরণ করে তুলে নেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার সকালেই। পাঞ্জাবি সেনাদের কয়েকটি স্কোয়াড নির্দিষ্ট ঠিকানায় হাজির হয়ে নির্ধারিত পুরুষ ও নারীকে সশস্ত্র পাহারায় উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। তাঁদের সম্ভবত রায়েরবাজার ইটখোলায় এনে মাটির বাঁধের পাশে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে, যাতে তাঁরা হুমড়ি খেয়ে নিচের জলাশয়ে পড়ে যান।

ড. আমিনুদ্দিন বেঙ্গল রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান, অক্সফোর্ডের পিএইচডি। পাকিস্তানি সেনারা যখন তাঁকে তুলে নেয়, সেই মঙ্গলবার সকাল সাতটায় তাঁকে শেষবারের মতো দেখা যায়। নাজিউর রহমান বললেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাকেও যেতে হচ্ছে, খুঁজে দেখি।’ ততক্ষণে তিনিও উলের মাফলার দিয়ে নাক-মুখ পেঁচিয়ে নিয়েছেন।

গতকাল আমি কেবল তিন ঘণ্টা ঢাকায় ছিলাম, ততক্ষণে ইটভাটার এই খবর তেমন ছড়ায়নি। জনতা উত্তেজিত, তবে আচরণে অদ্ভুত কোমলতা। ভারতীয় সেনাদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, গাড়িতে এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে।

সেদিনও অনেক গোলাগুলি হয়েছে, বিশেষ করে রাতের বেলায়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি তখনো বিস্ফোরণোন্মুখ। বাঙালিরা অভিযোগ করছে, বিহারি এই বিদেশিরা বহু বছর আগে মুসলমান হিসেবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, তারা বাঙালি হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের সাহায্য করেছে। আট মাস আগে আমি যখন যশোরে ছিলাম, এ কারণেই সেখানে বেসামরিক বিহারিদের হত্যা করা হয়। ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড যশোরের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে শতগুণ বেশি ভয়াবহ একটি ব্যাপার। কাজেই একধরনের প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।

ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাহারায় সেনানিবাসে বন্দী পাকিস্তানি সেনারা এখনো সশস্ত্র, যদি প্রয়োজন পড়ে! ঢাকা যখন জেনে যাবে পাকিস্তানি সেনারা কত পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তখন দেখা দেবে সত্যিকারের সংকট। যা-ই ঘটুক, পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সহানুভূতিপ্রবণ হওয়া বাঙালিদের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। এ রকম একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী এভাবে খেলাচ্ছলে অপ্রয়োজনে, উন্মত্তের মতো খুন করতে পারে, তা অবিশ্বাস্য।

যদি পাইকারি হত্যাকাণ্ডকে সংবাদপত্র গণহত্যা আখ্যায়িত করে, তা অবশ্যই ভয়ংকর; কিন্তু পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে জাতির সবচেয়ে যোগ্য, বুদ্ধিমান ও গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ ও নারী হত্যার মাধ্যমে যদি জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, সেই ‘এলিটোসাইড’ এলিট হত্যা যে আরও বেশি ভয়ংকর।

গত মঙ্গলবারের অনেক আগেই পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। যেসব কর্মকর্তা এই পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরাও তা অবশ্যই জানেন। কাজেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ধসিয়ে দেওয়া। বহুদিন ধরেই অনুমান করা হচ্ছিল, পাঞ্জাব মরুভূমির রুক্ষ সেনারা বাঙালিদের প্রতি হিংস্র বর্ণবাদী ঘৃণা লালন করে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষাও লালন করছে, যার প্রকাশ ঘটেছে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে।

ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ: এম এ মোমেন

দ্য সানডে টাইমস, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১১, পুনর্মুদ্রিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ