নেতৃত্বশূন্য পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কী
Published: 22nd, April 2025 GMT
পাকিস্তানের সমস্যা শুধু সংখ্যায় বাড়ছে না, বরং দেশের ভেতরে বিভাজন আর অস্থিরতাও তাতে আরও গভীর হচ্ছে। কোথাও বিক্ষোভ, কোথাও বিদ্রোহ, কোথাও আবার চরমপন্থীদের সহিংসতা। সন্ত্রাসবাদ, কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে টানাপোড়েন, পানিবণ্টন নিয়ে বিরোধ এবং সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংঘাত—সব একসঙ্গে ঘটছে।
এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়, দেশের শাসনব্যবস্থা ও নেতৃত্ব কোন পর্যায়ে রয়েছে। সংবাদমাধ্যমে সরকার নিজেই নিজেকে বাহবা দিলেও আসল চিত্র একেবারেই ভিন্ন। মৌলিক সমস্যা এখনো অব্যবস্থাপনার শিকার। শাসনের মানও জনগণের প্রত্যাশার অনেক নিচে। পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন জায়গায় শাসকদের গুণগান করে বড় বড় বিলবোর্ড টাঙানো হচ্ছে।
কিন্তু এসব দিয়ে নেতৃত্ব তৈরি হয় না। টেলিভিশনে যেসব অনুষ্ঠান দেখানো হয়, সেখানে মনে হয় ক্ষমতাবানদের দৈনন্দিন দায়িত্ব পালনও যেন বিশেষ কিছু। এসব মানুষকে উৎসাহিত তো করেই না, বরং মনে হয়, নেতারা নিজেরাই নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অতি উদ্বিগ্ন। প্রকৃত স্বীকৃতি আসে কাজ দিয়ে, পোস্টার আর পত্রিকার ৬০ পাতার বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়।
পাকিস্তানের সেসব জটিল সমস্যা এখন সামনে এসেছে। খাপছাড়া, এলোমেলোভাবে অর্থনীতি, রাজনীতি আর নিরাপত্তা–সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা কাজে আসে না, বরং ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। একের পর এক জনমত জরিপে সেই হতাশারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি ইপসস জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে, দেশ ভুল পথে হাঁটছে।
পাকিস্তানের ইতিহাসে এর আগেও নেতৃত্বহীন সময় এসেছে। অতীতে অনেকেই দেশের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের না ছিল দক্ষতা, না ছিল দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা মোকাবিলার দৃষ্টিভঙ্গি। ক্ষমতা হাতে পেলেই যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তা নয়। এই কারণেই দেশে শুধু শাসন হয়েছে, শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। রাজনীতি হয়েছে ক্ষমতার খেলা, জনস্বার্থ নয়। কিন্তু এখন সমস্যাগুলো এতটাই জটিল যে নেতৃত্বশূন্যতা আজ ভয়াবহভাবে স্পষ্ট।
তাহলে কেমন নেতৃত্ব চাই পাকিস্তানের? কাকে বলব দক্ষ নেতা? আর কী গুণ থাকা দরকার একজন কার্যকর নেতার মধ্যে? সবার আগে প্রয়োজন এমন এক দৃষ্টিভঙ্গির, যা শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ নিয়েও পথ দেখায় এবং আশার সঞ্চার ঘটায়। সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার পরিকল্পনাও থাকা চাই। একজন নেতা কেবল কথা বলেই থেমে যাবেন না, তিনি জাতির মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলবেন, মানুষের ভরসা অর্জন করবেন আর রূপান্তরের পথে সাহসিকতার সঙ্গে অগ্রসর হবেন।
একজন নেতার উচিত হবে এমন দল গঠন করা, যাঁদের মধ্যে দক্ষতা ও সততা দুই-ই রয়েছে। বুদ্ধিমান নেতা জানেন, কে কোন কাজের উপযুক্ত। ব্যক্তিগত আনুগত্য বা রাজনৈতিক সুবিধা নয়। নেতৃত্ব মানে হচ্ছে মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা, তাদের দুঃখ-কষ্ট বোঝা, তাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা জানা এবং তার সাড়া দেওয়া।
এই মানদণ্ডে বিচার করলে দেখা যায় আজকের শাসকগোষ্ঠী কতটা ব্যর্থ। কোথাও কোনো বড় স্বপ্ন নেই। নেই সুসমন্বিত কোনো পরিকল্পনা। সমস্যা দেখা দিলেই তড়িঘড়ি দমনের চেষ্টা চলছে।
কিন্তু মূল সমস্যাগুলো থেকে যাচ্ছে অমীমাংসিত। যেমন বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি। প্রদেশটি তীব্র অসন্তোষে ফুটছে, অথচ কোনো টেকসই সমাধানের রূপরেখা তৈরি হয়নি। আবার পাঞ্জাব ও সিন্ধুর মধ্যে পানির ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ দিনকে দিন বাড়ছে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার যেন চোখ বুজে আছে।
অর্থনীতি নিয়েও বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অর্থনীতি বারবার সংকটে পড়ে। সেগুলো দূর করার বাস্তব উদ্যোগ দেখা যায়নি। ছোটখাটো সমাধানে ব্যস্ত থেকেছে সরকার। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সাহস দেখায়নি।
অর্থনীতি নিয়েও বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অর্থনীতি বারবার সংকটে পড়ে। সেগুলো দূর করার বাস্তব উদ্যোগ দেখা যায়নি। ছোটখাটো সমাধানে ব্যস্ত থেকেছে সরকার। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সাহস দেখায়নি।
আরও বড় সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা। নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে বিতর্কের কারণেই তাদের প্রতি জনসমর্থন দুর্বল। সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়েছে এলোমেলোভাবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কোনো ছাপ নেই। শাসনের দায়িত্ব পেয়েছে এমন একটি দল, যেখানে কিছু দক্ষ পেশাজীবী থাকলেও বেশির ভাগই নির্বাচিত হয়েছে পারিবারিক সম্পর্ক বা রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে।
আর একেবারেই অনুপস্থিত একটি গুণ। সেই গুণটি হলো জনগণকে নাগরিকদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা। আজকের নেতারা যেন সাধারণ মানুষের জীবন থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তাঁদের কথা বা কাজ, কোনোটাতেই মানুষের প্রতিচ্ছবি নেই। তাঁরা দেশকে একত্র করার বদলে যেন আরও বিভক্ত করে ফেলছেন। বর্তমান সময়ের যোগাযোগনির্ভর জগতে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার মতো দক্ষতাও তাঁদের মধ্যে অনুপস্থিত।
হেনরি কিসিঞ্জার লিখেছিলেন, ‘সাধারণ নেতারা বর্তমান সামলান; কিন্তু মহান নেতারা সমাজকে নিয়ে যান স্বপ্নের দিকে।’
দরকার এমন নেতৃত্ব, যাঁরা সাহস করে পুরোনো ব্যর্থতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে দেশকে নিয়ে যাবেন একটি আশাবাদী ভবিষ্যতের দিকে।
● মালিহা লোধি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত
ডন থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ষমত সমস য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আবারও উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা, ক্ষমা চাইতে আলটিমেটাম
উপাচার্যের একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্তে বারবার অশান্ত হয়ে উঠছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি)। গত ২৩ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক ড. শুচিতা শারমিন উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ার পর গত ৭ মাসে একাধিকবার তাঁর পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিনকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর আখ্যা দিয়ে সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রতিবাদে তারা আবারও আন্দোলনে নেমেছেন। ড. মুহসিনকে পুনর্বহাল ও উপাচার্যকে ক্ষমা চাওয়ার দাবিতে শিক্ষার্থীরা সোমবার ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন।
ড. মুহসিন জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে এবং উপাচার্যের আস্থাভাজন শিক্ষকরা আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন– তাঁর একটি ভার্চুয়াল সভার অডিও গত শনিবার ভাইরাল হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের নিয়ে ওই সভাটি করেছিলেন। অডিও ভাইরাল হওয়ার পর ড. মুহসিনকে পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।
সোমবার দুপুরে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও পরে উপাচার্যের দপ্তরে গিয়ে শিক্ষার্থীরা ৪ দফা দাবিসংবলিত স্মারকলিপি দেন। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি না মানলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। দাবিগুলো হলো– অধ্যাপক মুহসিন উদ্দিনের বিরুদ্ধে মিথ্যা-অপমানজনক অপবাদ প্রত্যাহার, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য পদে পুনর্বহাল; অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে অপসারণ; ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের দোসর শিক্ষকদের লাভজনক কমিটি থেকে অপসারণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যমান উন্নয়ন না করে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন করায় উপাচার্যকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া।
আন্দোলনকারীদের অন্যতম ইংরেজি চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিন খান জানান, একজন নিরপরাধ শিক্ষককে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ায় সাধারণ শিক্ষর্থীরা ক্ষুব্ধ। সোমবার তারা উপাচার্যের দপ্তরে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন। তারা জেনেছেন, গতকাল তিনি ক্যাম্পাসে ছিলেন না। চার দফা দাবি না মানলে বড় আন্দোলন গড়ে তুলবেন।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
ড. শুচিতা যোগদানের পরই শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তোলেন, তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর অনুসারী। জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের ৩৫০ বিশিষ্টজন গত বছর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছিলেন। উপাচার্যও সেই বিবৃতিদাতাদের একজন। এ ছাড়া কলিমুল্লাহকে ববির একাডেমিক কাউন্সিলর, পরীক্ষা কমিটি ও পূর্বের চাকরি গণনা কমিটির সদস্য করা হলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রত্যাহার করেন তিনি।
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানীর অভিযোগ, তিনি সব একাডেমিক কাজের প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান করবেন। কিন্তু উপাচার্য তাঁকে বাদ দিয়েই নথিভিত্তিক ও সভাভিত্তিক একাডেমিক সিদ্ধান্ত নেন। কোষাধ্যক্ষ ড. মামুন অর রশিদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিতে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত চেক কোষাধ্যক্ষ এবং তদূর্ধ্ব চেক উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ যৌথ স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু উপাচার্য সব চেকে একাই স্বাক্ষর করেন। এসব অভিযোগ এর আগে শিক্ষার্থীরা দুইবার উপচার্যের পদত্যাগে এক দফার আন্দোলনে নেমেছিলেন। গত ২৮ নভেম্বর তাঁর কক্ষে তালাও লাগিয়েছিলেন তারা।
শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে বক্তব্য জানতে উপাচার্য ড. শুচিতা শারমিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে সোমবার রাতে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সাকিব হোসেন জানান, উপাচার্য সারাদিন একাধিক বৈঠক করেছেন। এখন তিনি বিশ্রামে রয়েছেন।