এক পক্ষে প্রায় ৫০০ মানুষ। আরেক পক্ষে অন্তত ৭০০। চলছে পাল্টাপাল্টি গানের লড়াই। তা দেখতে জড়ো হয়েছেন আরও হাজারো নারী-পুরুষ। মধ্যচৈত্রের চামড়াপোড়া গরমে শিল্পী-দর্শনার্থী সবাই দরদর করে ঘামছেন। কিন্তু বিরামহীনভাবে দুই পক্ষই পাল্লা দিয়ে গান গাইছে। কোনো পক্ষই অন্য পক্ষকে ‘বিনা যুদ্ধে’ ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’ ছাড় দিতে নারাজ!
ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এমন গানের লড়াই চলে সুনামগঞ্জের হাওর-অধ্যুষিত শাল্লা উপজেলার ভেড়াডহর গ্রামের নতুন হাটিতে। সেদিন ছিল ১৪৩১ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র। খ্রিষ্টাব্দের হিসাবে ২৮ মার্চ ২০২৫। খুব সকালে সিলেট থেকে রওনা দিই। সঙ্গী ছিলেন বন্ধু প্রদীপ রঞ্জন বৈষ্ণব ও সংবাদকর্মী দীপ্ত বৈষ্ণব। প্রদীপের গ্রামের বাড়ি মুছাপুর। তাদের গ্রামের পাশেই ভেড়াডহর। মূলত প্রদীপের আমন্ত্রণেই সেখানে উরিগান দেখতে যাওয়া।
হিন্দুধর্মীয় উৎসব দোলযাত্রাকে উপলক্ষ করে বসন্তকালে গাওয়া হয় উরিগান। এসব গান ‘হোরিগান’ বা ‘দোলের গান’ নামেও পরিচিত। বিশেষত সুনামগঞ্জের শাল্লা, দিরাই ও জগন্নাথপুর, হবিগঞ্জের বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন আর নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলায় উরিগানের প্রচলন বেশি। এর বাইরেও হাওরাঞ্চলের নানা গ্রামে দোল উৎসবে উরিগান গাওয়া হয়। তবে বৈষ্ণব ও কৈবর্ত সম্প্রদায়ভুক্তদের মধ্যে এ গানের চর্চা তুলনামূলকভাবে বেশি।
কবিগান কিংবা মালজোড়া গানের মতোই উরিগান হলো প্রতিযোগিতামূলক গান। পার্থক্য কেবল এটাই, কবিগান ও মালজোড়াগানের আসর বসে গ্রামীণ মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য, অন্যদিকে উরিগান পরিবেশিত হয় অনেকটা হিন্দুধর্মীয় আচার-রীতির অংশ হিসেবে। অবশ্য আরেকটু পার্থক্য রয়েছে, কবিগান ও মালজোড়া গানে মাত্র দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী পাল্টাপাল্টি গান-কথায় বাহাস জমান, বিপরীতে উরিগানে একেকটি পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কমসে কম কয়েক শ শিল্পী থাকেন! এমন বর্ণিল আর প্রাণবন্ত গানের ধারা সংগীত-সংস্কৃতিতে কমই আছে।
উরিগানকে সংগীতের একটি পরিচ্ছন্ন ধারা বলে মনে করা হয়ে থাকে। এ গানের চারটা পর্ব রয়েছে—ঝুমুরগান, লাসগান, চাইলগান ও চলতিগান। এসব মূলত নারীবর্জিত গানের ধারা। পুরুষেরাই নৃত্যসংবলিত এ গানের শিল্পী। বাড়ির উঠানে কিংবা মাঠে সমবেতভাবে কয়েক শ শিল্পী একই সঙ্গে এ গান পরিবেশন করেন। এক পক্ষের পরিবেশনার পর অপর পক্ষ একই আঙ্গিকের পাল্টা গান পরিবেশন করেন। এভাবেই দিনভর গান শেষে উপস্থিত দর্শনার্থীদের বেশির ভাগের মতামতের ভিত্তিতে একটি পক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। নারীরা উরিগানে অংশ না নিলেও শ্রোতা হিসেবে তাঁদের অংশগ্রহণ ঠিকই থাকে।
২.
ভেড়াডহর গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের দুপুর হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য গ্রামটিতে পৌঁছার আগেই প্রদীপের সুবাদে প্রাথমিক অনেক তথ্য জানা হয়ে যায়। যেমন ভেড়াডহর গ্রামবাসীর আমন্ত্রণে পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার কবিরপুর গ্রামের বাসিন্দারা উরিগান গাইতে ভেড়াডহরে এসেছেন। রীতি অনুযায়ী এক গ্রামের মানুষ আরেক গ্রামের মানুষকে উরিগান গাইতে আমন্ত্রণ জানান। সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে নির্দিষ্ট ওই গ্রামের পুরুষদের প্রায় সবাই সাতসকালে গাইতে আসেন।
পরম্পরা অনুযায়ী কবিরপুর গ্রামের মানুষেরাও সেদিন সাতসকালে ঝুমুরগান গাইতে গাইতে নিজেদের গ্রাম থেকে ভেড়াডহর গ্রামে প্রবেশ করেন। ভেড়াডহর গ্রামে ঢুকে ঝুমুরগান গেয়ে তাঁরা মূলত নিজেদের উপস্থিতি জানান দেন। দুপুরে পৌঁছার কারণে সে আনুষ্ঠানিকতা আমাদের দেখা হয়নি, তবে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মানুষের আলাপ থেকে তা ঠিকই জেনে যাই। আমরা যখন গ্রামটিতে পা রাখি, ততক্ষণে লাসগানের পরিবেশনা শুরু হয়েছে।
হিন্দি-বাংলামিশ্রিত লাসগান মগ্ন হয়ে গাইছেন কবিরপুর গ্রামের শিল্পীরা। লাসগান শেষ করেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে কয়েক শ মানুষ সমবেত কণ্ঠে চাইলগান পরিবেশন করেন। চাইলগানে নৃত্যসংবলিত শারীরিক কসরতের পাশাপাশি শিল্পীরা দুই হাত ওপরে তুলে হর্ষধ্বনিসহযোগে লাফানোর মতো করে অনবদ্য এক দৃশ্যের জন্ম দেন। তাঁদের পরিবেশনার পর একই রকমভাবে ভেড়াডহরের গ্রামবাসীও গানে গানে কবিরপুরবাসীকে পাল্টা জবাব দেন।
শিল্পীরা জানান, ভেড়াডহরের লোকেরা উরিগানের আয়োজক হওয়ায় রীতি অনুযায়ী তাঁরা রাইপক্ষ, আর কবিরপুরের মানুষ আমন্ত্রিত দল হওয়ায় তাঁরা শ্যামপক্ষ। সে ধারা মোতাবেকই গান পরিবেশিত হয়।
উরিগান উপলক্ষে এভাবেই সাজানো হয়েছিল দোলবেদিউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ ন পর ব শ আমন ত র
এছাড়াও পড়ুন:
পুরস্কার বিতরণীর মধ্য দিয়ে শেষ হলো জাবির জাতীয় বিতর্ক উৎসব
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে‘চির উন্নত মম শির’ স্লোগানকে সামনে রেখে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশন (জেইউডিও)-এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে জেইউডিও জাতীয় বিতর্ক উৎসব ২০২৫। গত ২৭ নভেম্বর শুরু হওয়া এই উৎসবে সারা দেশের অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিতার্কিকরা অংশ নেন। উৎসবের সমাপনী দিনে শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) চূড়ান্ত পর্ব ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়।
আয়োজকরা জানান, যুক্তিবাদী ও মননশীল মানুষ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবারের উৎসবটি তিনটি পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ২৭ নভেম্বর ১৪তম আন্তঃকলেজ, ২৮ নভেম্বর ২০তম আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় এবং ১১ ডিসেম্বর ১৪তম আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
আরো পড়ুন:
জাবিতে একাডেমিক নিপীড়ন প্রতিরোধে নতুন প্ল্যাটফর্মের যাত্রা শুরু
জাবির ৪৫তম ব্যাচের রাজা আকাশ, রানি ফারিন
প্রতিযোগিতায় আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রানার আপ হয়েছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)।
আন্তঃকলেজ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ এবং রানার আপ হয়েছে সেন্ট জোসেফ কলেজ। পাশাপাশি আন্তঃস্কুল পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জিতেছে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এবং রানার আপ হয়েছে সেন্ট গ্রেগরী স্কুল।
জাতীয় বিতর্ক উৎসব ২০২৫-এর স্কুল পর্যায়ের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন জান্নাতুন্নেছা বিনতে জামান এমিলি, কলেজ পর্যায়ে আল লুবান এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাদমান কৌশিক। উৎসবের মূল আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জেইউডিও’র সভাপতি মির্জা সাকি।
ঢাকা/হাবীব/জান্নাত