অনুভূতিটা অনন্ত শূন্যতার। সামনে খালি পৃষ্ঠা কিংবা কম্পিউটারের উজ্জ্বল সাদা পর্দা। কিন্তু নিষ্ক্রিয় মগজ। অবসাদগ্রস্ত মন। কলম ধরতে ইচ্ছা করছে না কিংবা কি-বোর্ডের ওপর স্থির হয়ে আছে অলস আঙুল। মনে হচ্ছে, যা লিখতে চাচ্ছি তা আসছে না, যা বলতে চাচ্ছি, যেভাবে প্রকাশ করতে চাচ্ছি, তা পারছি না। শরীর গড়িমসি করছে, মন কথা শুনছে না। কোথা থেকে আদিগন্ত ক্লান্তি এসে গ্রাস করে নিচ্ছে দেহমন। প্রায় প্রত্যেক লেখকের জীবনে তাঁর সৃজনপ্রক্রিয়ার স্বাভাবিক অংশ হিসেবে এমন কিছু নিষ্ফলা সময় এক বা একাধিকবার আসে।
বিষয়টা এমন নয় যে একজন লেখক সারাক্ষণই মুখ গুঁজে লিখতে থাকেন বা প্রতিমুহূর্তেই তাঁর শুধু লিখতে ইচ্ছা করে। সামাজিক মানুষ হিসেবে অন্য সবার মতো তাঁরও হয়তো পরিবার থাকে, থাকে আরও নানা দায়দায়িত্ব, কর্তব্যকর্ম। সেই করণীয় তালিকায় লেখকের কাছে তাঁর লেখা তৈরি করাটাও একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে জোর করে সেটি করা কঠিন। অনেকে হয়তো পরিকল্পনা করে, ছক কেটে লেখার কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন। মনকে ঠেসে ধরে কাজ আদায় করে নেওয়ার কায়দাও হয়তো অনেকের জানা আছে। তবে সবাই তা পারেন না। কারণ, প্রত্যেক লেখকই আলাদা মানুষ, প্রত্যেকের আছে স্বতন্ত্র লিখনপ্রক্রিয়া, নিজস্ব চিন্তাধারা, ভাব প্রকাশের অনন্যতা। তবু লেখকমাত্রই জানেন, কখনো এমন দিনও যায় যে লেখার টেবিলে অবধি বসতে ইচ্ছা করে না। তাগিদ জাগে না একটি শব্দ বা বাক্য লেখারও। দিন যায়, কখনো সপ্তাহও চলে যায়। মাসের পর মাস ফাঁকা পড়ে থাকে লেখার খাতা, ল্যাপটপের ওয়ার্ড ফাইল। দৈনন্দিন সবকিছুই চলে রুটিনমাফিক, কিন্তু শান্ত নদীর নিচে বয়ে যাওয়া চোরাস্রোতের মতো কোথায় যেন কুলকুল করে বইতে থাকে লিখতে না–পারার নীরব ব্যাকুল অস্থিরতা, চোরকাঁটার মতো কোথাও যেন অলক্ষে বিঁধে থাকে এক সূক্ষ্ম বেদনা। লেখকের কাছে এ এক বন্ধ্যা সময়। এক অনুর্বর কাল। না–লিখতে পারার দুঃসহ প্রহরগুলো তাঁকে যন্ত্রণা দেয়, কিন্তু তিনি এই সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে পান না।
১৯৪৭ সালে অস্ট্রিয়ান মনোবিশ্লেষক এডমন্ড বার্গলার প্রথম ক্লিনিক্যালি এ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে এর নাম দেন ‘রাইটার্স ব্লক’। সাধারণভাবে সংবেদনশীল লেখকের মনে সৃষ্ট অহেতুক অযৌক্তিক ভয়, ভালো লিখতে না–পারার উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও অনুপ্রেরণার অভাবকে এর কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়। ইদানীং এ অবস্থাকে বিপিএস বা ‘ব্ল্যাঙ্ক পেজ সিনড্রোম’ও বলছেন অনেকে।
তবে বিশ্বজুড়ে লেখকদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলছেন, এটি লেখকদের জন্য বাস্তব ও গুরুতর সমস্যা। অনেক বিখ্যাত ও সফল লেখক জীবনের বিভিন্ন সময়ে এ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন। আবার অনেক লেখক একে নাকচ করে দিয়ে বলছেন, এটি স্রেফ একটি মিথ। কাল্পনিক গল্প। কেননা, লেখক যখন লেখেন না, তখনো তাঁর মনে, মস্তিষ্কে বা করোটির ভেতরে লেখার ভাবনা, ধারণা ও চিন্তার কাটাছেঁড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। ফলে হাতে-কলমে না লিখলেও মনে-মননে লেখক তাঁর লেখার কাজটি ঠিকই চালিয়ে যান।
বুকারজয়ী ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায় যেমন বলেছিলেন, ‘আমি যখন লিখি না, তখনো আমি লিখি। মনে মনে লিখি। আমার কাছে লেখালেখি ব্যাপারটা সংগীতের মতো। আমি এটা শুনি, দেখি না।’
নোবেল বিজয়ী আমেরিকান লেখক টনি মরিসন ‘রাইটার্স ব্লক’ শব্দবন্ধটিকেই অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, লেখক দীর্ঘ সময় একটি শব্দ না লিখেও লেখার বিষয় নিয়ে ভাবতে পারেন। মাথার ভেতরে বা হৃদয়ের গভীরে বহন করতে পারেন লেখার বীজ। এই বীজ থেকেই পরে মহিরুহ জন্ম নেয়। ভাবনার এই লালন–পালনই পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখার কাজটি সহজ করে দেয়।
অনেকে মনে করেন, এই যে থেমে যাওয়া বা লিখতে লিখতে হঠাৎ কোথাও আটকে যাওয়া—এটি লিখনপ্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং সৃজনপ্রক্রিয়ারই একটি অনিবার্য অংশমাত্র। এ রকম দুঃসহ বন্ধ্যত্বের শেষে লেখকের জন্য অপেক্ষা করে নতুন ও উত্তেজনাকর কোনো কিছু নির্মাণের সম্ভাবনা। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাঁর জাহাজ পায় অজানা ভূমির সন্ধান।
কেউ কেউ বলেন, লেখাজোখার বিষয়টি যদি শুধু কলাকৌশলের ওপর নির্ভর করত, তাহলে হয়তো লেখকের জীবনে লিখতে না–পারার মতো এমন দুর্ভোগ কখনো আসত না। যেমন যিনি কাপড় সেলাই করেন, সুই–সুতা আর কাপড় পেলে সহসা তাঁর হাতের কাজ বন্ধ হয় না। কিন্তু লেখার কাজ তো তেমন সরল কিছু নয়। কখনো তা লেখকের কাছে আসে পোষা প্রাণীর মতো অনায়াস, সাবলীল ভঙ্গিতে। কখনো সে দাবি করে নিমগ্ন আমন্ত্রণ, অমানুষিক মনোযোগ। এ যেন কোমল সুতায় বাঁধা ভারী সূক্ষ্ম ও সুকুমার অনুভূতির এক বাদ্যযন্ত্র। ঠিক জায়গাটিতে আঙুল না ছোঁয়ালে বেসুরো হয়ে বাজে। ফলে কখনো প্রকৃত শব্দটি খুঁজতে গিয়ে, সঠিক বাণীটি বাঁধতে গিয়ে, গল্পের শেষটা লিখতে গিয়ে লেখক হয়তো থমকে যান। হাতড়ে বেড়ান মহাশূন্যে, সাঁতরে বেড়ান মহাসমুদ্রে।
‘আরে ধুর! এ সবই আসলে অলসতা! লেখকের অক্ষমতা! কল্পনার অভাব! দুর্বল চিন্তাশক্তির প্রভাব! যাঁরা আদতে লিখতে পারেন না, তাঁরাই এসব অজুহাত বানান!’ এমন কথা বলে না–লিখতে পারার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার লোকেরও তো অভাব নেই।
পশ্চিমা দেশগুলোয় যাঁরা পেশাদার লেখক, শুধু লেখাই যাঁদের জীবিকা অর্জনের উপায় (যাঁরা কপিরাইটার বা কলাম লেখক বা যাঁরা বেস্টসেলার লেখক, প্রকাশকেরা যাঁদের বই লাখ লাখ কপি বিক্রি করতে পারেন), তাঁদের হয়তো অন্য পেশাদারদের মতোই হাত গুটিয়ে লেখা (কাজ বা দায়িত্ব) থামানোর কোনো ফুরসত নেই। লেখা থেমে গেলে চাকরি (জীবিকা) হারানোর খেসারত দিতে হবে। লেখালেখি তাঁদের কাছে একধরনের দক্ষতা। ফলে যন্ত্রের মতো ঘড়ি ধরে তাঁরা লিখে যেতে পারেন।
কিন্তু আমরা যাঁরা অপেশাদার লেখক, যাঁরা লেখাকে জীবিকা করতে পারিনি বা জীবিকা করার সুযোগ যাঁদের নেই, তাঁরাই হয়তো না–লেখার এমন বেদনাবিলাসে ভাসতে পারি!
আমার এই সামান্য লেখকজীবনে লিখতে না–পারার করুণ নির্মম দিনগুলো বহুবারই ফিরে ফিরে এসেছে। দুর্দান্ত অভূতপূর্ব কিছু একটা লিখে ফেলব, সেই আশায় না–লেখার দিনগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। বিষণ্নতা সামলে অপেক্ষায় থেকেছি কখন আবার লেখার ইচ্ছা ঢাকঢোল বাজিয়ে মহাসমারোহে ফেরত আসে। লেখা বন্ধ রেখেছি ঠিকই, কিন্তু চিন্তা তো বন্ধ হয়নি। মাথার ভেতর হাজারো উপলব্ধির ভাঙাগড়া চলেছে। ভাব–ভাবনার ভারে কখনো আনমনা হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু লিখতে গেলেই সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। হাতের আঙুলগুলো বিদ্রোহ করে যেন বরফের মতো জমে গেছে। মাথার ভেতর গানের সুরের মতো তিরতির করে লেখার ভাবনাটা ডানা ঝাপটাচ্ছে। বুঝতে পারি, অনেকটা রান্নার আগে নুন-মসলা মাখিয়ে মাংস ম্যারিনেট করার মতো ভাবনাগুলো জারিত হচ্ছে, প্রকাশের উপযোগী হচ্ছে। এমন সময় নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি, এটি লেখালেখি থেকে ‘সাময়িক বিরতিমাত্র’। এ ছাড়া আমি যদি না–লিখি, তাহলে পৃথিবীর কীই-বা এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে? কেই-বা আমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে লেখার জন্য? না–লিখলে আমার নিজের ছাড়া আর কারই–বা কিছু যায়-আসে? পরক্ষণেই ভাবি, লিখতে পারলে আমার নিজের মধ্যেই যে অপার আনন্দের অনুভব হয়, তা তো আর অন্য কিছুতে হয় না। হয়তো লেখকমাত্রই জানেন, সৃষ্টির সেই আনন্দ কেমন অবর্ণনীয়, অপরিমেয় ও অনাবিল। ফলে কেউ বলুক আর না বলুক, পড়ুক বা না পড়ুক—নিজের আনন্দের জন্যই লিখতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন তার বক্ষে বেদনা অপার’। ভাবি, এটাই নিয়তি। প্রত্যেক লেখকেরই ‘বেদনায় অন্তর করিয়া বিদারিত’ জন্ম নেয় সৃজনশীল রচনা। তবে ওই যে জোরজবরদস্তি করে, মনের সঙ্গে কুস্তি লড়ে আর যা-ই হোক, সৃজনশীল লেখালেখি হয় না। ফলে লেখার মাঠে যখন অমন শুকনা খরা নামে, তখন আমি অন্যদের লেখা পড়ি। সমসাময়িক, ধ্রুপদি সাহিত্য, কবিতা, থ্রিলার, ভূতের গল্প—হাতের কাছে যা পাই, সবই পড়ি। ইদানীং বেশি বেশি সিনেমা দেখি, বেশি বেশি পছন্দের গান শুনি। ছবি তুলি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোরাঘুরি করি। সুযোগ পেলে কোথাও গিয়ে বেরিয়ে আসি।
ভাবতে থাকি, একসময় এই মন্দার দিন কেটে যাবে। সেই বেদনাক্লিষ্ট সময়টুকুতে অন্য কিছু করে মনকে স্থির হওয়ার সময় দিই। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি বৃষ্টি নামার।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য র র মত আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
না–লেখার সময়গুলো
অনুভূতিটা অনন্ত শূন্যতার। সামনে খালি পৃষ্ঠা কিংবা কম্পিউটারের উজ্জ্বল সাদা পর্দা। কিন্তু নিষ্ক্রিয় মগজ। অবসাদগ্রস্ত মন। কলম ধরতে ইচ্ছা করছে না কিংবা কি-বোর্ডের ওপর স্থির হয়ে আছে অলস আঙুল। মনে হচ্ছে, যা লিখতে চাচ্ছি তা আসছে না, যা বলতে চাচ্ছি, যেভাবে প্রকাশ করতে চাচ্ছি, তা পারছি না। শরীর গড়িমসি করছে, মন কথা শুনছে না। কোথা থেকে আদিগন্ত ক্লান্তি এসে গ্রাস করে নিচ্ছে দেহমন। প্রায় প্রত্যেক লেখকের জীবনে তাঁর সৃজনপ্রক্রিয়ার স্বাভাবিক অংশ হিসেবে এমন কিছু নিষ্ফলা সময় এক বা একাধিকবার আসে।
বিষয়টা এমন নয় যে একজন লেখক সারাক্ষণই মুখ গুঁজে লিখতে থাকেন বা প্রতিমুহূর্তেই তাঁর শুধু লিখতে ইচ্ছা করে। সামাজিক মানুষ হিসেবে অন্য সবার মতো তাঁরও হয়তো পরিবার থাকে, থাকে আরও নানা দায়দায়িত্ব, কর্তব্যকর্ম। সেই করণীয় তালিকায় লেখকের কাছে তাঁর লেখা তৈরি করাটাও একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে জোর করে সেটি করা কঠিন। অনেকে হয়তো পরিকল্পনা করে, ছক কেটে লেখার কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন। মনকে ঠেসে ধরে কাজ আদায় করে নেওয়ার কায়দাও হয়তো অনেকের জানা আছে। তবে সবাই তা পারেন না। কারণ, প্রত্যেক লেখকই আলাদা মানুষ, প্রত্যেকের আছে স্বতন্ত্র লিখনপ্রক্রিয়া, নিজস্ব চিন্তাধারা, ভাব প্রকাশের অনন্যতা। তবু লেখকমাত্রই জানেন, কখনো এমন দিনও যায় যে লেখার টেবিলে অবধি বসতে ইচ্ছা করে না। তাগিদ জাগে না একটি শব্দ বা বাক্য লেখারও। দিন যায়, কখনো সপ্তাহও চলে যায়। মাসের পর মাস ফাঁকা পড়ে থাকে লেখার খাতা, ল্যাপটপের ওয়ার্ড ফাইল। দৈনন্দিন সবকিছুই চলে রুটিনমাফিক, কিন্তু শান্ত নদীর নিচে বয়ে যাওয়া চোরাস্রোতের মতো কোথায় যেন কুলকুল করে বইতে থাকে লিখতে না–পারার নীরব ব্যাকুল অস্থিরতা, চোরকাঁটার মতো কোথাও যেন অলক্ষে বিঁধে থাকে এক সূক্ষ্ম বেদনা। লেখকের কাছে এ এক বন্ধ্যা সময়। এক অনুর্বর কাল। না–লিখতে পারার দুঃসহ প্রহরগুলো তাঁকে যন্ত্রণা দেয়, কিন্তু তিনি এই সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে পান না।
১৯৪৭ সালে অস্ট্রিয়ান মনোবিশ্লেষক এডমন্ড বার্গলার প্রথম ক্লিনিক্যালি এ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে এর নাম দেন ‘রাইটার্স ব্লক’। সাধারণভাবে সংবেদনশীল লেখকের মনে সৃষ্ট অহেতুক অযৌক্তিক ভয়, ভালো লিখতে না–পারার উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও অনুপ্রেরণার অভাবকে এর কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়। ইদানীং এ অবস্থাকে বিপিএস বা ‘ব্ল্যাঙ্ক পেজ সিনড্রোম’ও বলছেন অনেকে।
তবে বিশ্বজুড়ে লেখকদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলছেন, এটি লেখকদের জন্য বাস্তব ও গুরুতর সমস্যা। অনেক বিখ্যাত ও সফল লেখক জীবনের বিভিন্ন সময়ে এ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন। আবার অনেক লেখক একে নাকচ করে দিয়ে বলছেন, এটি স্রেফ একটি মিথ। কাল্পনিক গল্প। কেননা, লেখক যখন লেখেন না, তখনো তাঁর মনে, মস্তিষ্কে বা করোটির ভেতরে লেখার ভাবনা, ধারণা ও চিন্তার কাটাছেঁড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। ফলে হাতে-কলমে না লিখলেও মনে-মননে লেখক তাঁর লেখার কাজটি ঠিকই চালিয়ে যান।
বুকারজয়ী ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায় যেমন বলেছিলেন, ‘আমি যখন লিখি না, তখনো আমি লিখি। মনে মনে লিখি। আমার কাছে লেখালেখি ব্যাপারটা সংগীতের মতো। আমি এটা শুনি, দেখি না।’
নোবেল বিজয়ী আমেরিকান লেখক টনি মরিসন ‘রাইটার্স ব্লক’ শব্দবন্ধটিকেই অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, লেখক দীর্ঘ সময় একটি শব্দ না লিখেও লেখার বিষয় নিয়ে ভাবতে পারেন। মাথার ভেতরে বা হৃদয়ের গভীরে বহন করতে পারেন লেখার বীজ। এই বীজ থেকেই পরে মহিরুহ জন্ম নেয়। ভাবনার এই লালন–পালনই পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখার কাজটি সহজ করে দেয়।
অনেকে মনে করেন, এই যে থেমে যাওয়া বা লিখতে লিখতে হঠাৎ কোথাও আটকে যাওয়া—এটি লিখনপ্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং সৃজনপ্রক্রিয়ারই একটি অনিবার্য অংশমাত্র। এ রকম দুঃসহ বন্ধ্যত্বের শেষে লেখকের জন্য অপেক্ষা করে নতুন ও উত্তেজনাকর কোনো কিছু নির্মাণের সম্ভাবনা। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাঁর জাহাজ পায় অজানা ভূমির সন্ধান।
কেউ কেউ বলেন, লেখাজোখার বিষয়টি যদি শুধু কলাকৌশলের ওপর নির্ভর করত, তাহলে হয়তো লেখকের জীবনে লিখতে না–পারার মতো এমন দুর্ভোগ কখনো আসত না। যেমন যিনি কাপড় সেলাই করেন, সুই–সুতা আর কাপড় পেলে সহসা তাঁর হাতের কাজ বন্ধ হয় না। কিন্তু লেখার কাজ তো তেমন সরল কিছু নয়। কখনো তা লেখকের কাছে আসে পোষা প্রাণীর মতো অনায়াস, সাবলীল ভঙ্গিতে। কখনো সে দাবি করে নিমগ্ন আমন্ত্রণ, অমানুষিক মনোযোগ। এ যেন কোমল সুতায় বাঁধা ভারী সূক্ষ্ম ও সুকুমার অনুভূতির এক বাদ্যযন্ত্র। ঠিক জায়গাটিতে আঙুল না ছোঁয়ালে বেসুরো হয়ে বাজে। ফলে কখনো প্রকৃত শব্দটি খুঁজতে গিয়ে, সঠিক বাণীটি বাঁধতে গিয়ে, গল্পের শেষটা লিখতে গিয়ে লেখক হয়তো থমকে যান। হাতড়ে বেড়ান মহাশূন্যে, সাঁতরে বেড়ান মহাসমুদ্রে।
‘আরে ধুর! এ সবই আসলে অলসতা! লেখকের অক্ষমতা! কল্পনার অভাব! দুর্বল চিন্তাশক্তির প্রভাব! যাঁরা আদতে লিখতে পারেন না, তাঁরাই এসব অজুহাত বানান!’ এমন কথা বলে না–লিখতে পারার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার লোকেরও তো অভাব নেই।
পশ্চিমা দেশগুলোয় যাঁরা পেশাদার লেখক, শুধু লেখাই যাঁদের জীবিকা অর্জনের উপায় (যাঁরা কপিরাইটার বা কলাম লেখক বা যাঁরা বেস্টসেলার লেখক, প্রকাশকেরা যাঁদের বই লাখ লাখ কপি বিক্রি করতে পারেন), তাঁদের হয়তো অন্য পেশাদারদের মতোই হাত গুটিয়ে লেখা (কাজ বা দায়িত্ব) থামানোর কোনো ফুরসত নেই। লেখা থেমে গেলে চাকরি (জীবিকা) হারানোর খেসারত দিতে হবে। লেখালেখি তাঁদের কাছে একধরনের দক্ষতা। ফলে যন্ত্রের মতো ঘড়ি ধরে তাঁরা লিখে যেতে পারেন।
কিন্তু আমরা যাঁরা অপেশাদার লেখক, যাঁরা লেখাকে জীবিকা করতে পারিনি বা জীবিকা করার সুযোগ যাঁদের নেই, তাঁরাই হয়তো না–লেখার এমন বেদনাবিলাসে ভাসতে পারি!
আমার এই সামান্য লেখকজীবনে লিখতে না–পারার করুণ নির্মম দিনগুলো বহুবারই ফিরে ফিরে এসেছে। দুর্দান্ত অভূতপূর্ব কিছু একটা লিখে ফেলব, সেই আশায় না–লেখার দিনগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। বিষণ্নতা সামলে অপেক্ষায় থেকেছি কখন আবার লেখার ইচ্ছা ঢাকঢোল বাজিয়ে মহাসমারোহে ফেরত আসে। লেখা বন্ধ রেখেছি ঠিকই, কিন্তু চিন্তা তো বন্ধ হয়নি। মাথার ভেতর হাজারো উপলব্ধির ভাঙাগড়া চলেছে। ভাব–ভাবনার ভারে কখনো আনমনা হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু লিখতে গেলেই সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। হাতের আঙুলগুলো বিদ্রোহ করে যেন বরফের মতো জমে গেছে। মাথার ভেতর গানের সুরের মতো তিরতির করে লেখার ভাবনাটা ডানা ঝাপটাচ্ছে। বুঝতে পারি, অনেকটা রান্নার আগে নুন-মসলা মাখিয়ে মাংস ম্যারিনেট করার মতো ভাবনাগুলো জারিত হচ্ছে, প্রকাশের উপযোগী হচ্ছে। এমন সময় নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি, এটি লেখালেখি থেকে ‘সাময়িক বিরতিমাত্র’। এ ছাড়া আমি যদি না–লিখি, তাহলে পৃথিবীর কীই-বা এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে? কেই-বা আমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে লেখার জন্য? না–লিখলে আমার নিজের ছাড়া আর কারই–বা কিছু যায়-আসে? পরক্ষণেই ভাবি, লিখতে পারলে আমার নিজের মধ্যেই যে অপার আনন্দের অনুভব হয়, তা তো আর অন্য কিছুতে হয় না। হয়তো লেখকমাত্রই জানেন, সৃষ্টির সেই আনন্দ কেমন অবর্ণনীয়, অপরিমেয় ও অনাবিল। ফলে কেউ বলুক আর না বলুক, পড়ুক বা না পড়ুক—নিজের আনন্দের জন্যই লিখতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন তার বক্ষে বেদনা অপার’। ভাবি, এটাই নিয়তি। প্রত্যেক লেখকেরই ‘বেদনায় অন্তর করিয়া বিদারিত’ জন্ম নেয় সৃজনশীল রচনা। তবে ওই যে জোরজবরদস্তি করে, মনের সঙ্গে কুস্তি লড়ে আর যা-ই হোক, সৃজনশীল লেখালেখি হয় না। ফলে লেখার মাঠে যখন অমন শুকনা খরা নামে, তখন আমি অন্যদের লেখা পড়ি। সমসাময়িক, ধ্রুপদি সাহিত্য, কবিতা, থ্রিলার, ভূতের গল্প—হাতের কাছে যা পাই, সবই পড়ি। ইদানীং বেশি বেশি সিনেমা দেখি, বেশি বেশি পছন্দের গান শুনি। ছবি তুলি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোরাঘুরি করি। সুযোগ পেলে কোথাও গিয়ে বেরিয়ে আসি।
ভাবতে থাকি, একসময় এই মন্দার দিন কেটে যাবে। সেই বেদনাক্লিষ্ট সময়টুকুতে অন্য কিছু করে মনকে স্থির হওয়ার সময় দিই। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি বৃষ্টি নামার।