আট পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে প্রথম প্রতিবেদন
Published: 22nd, April 2025 GMT
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আটজনকে অভিযুক্ত করে প্রসিকিউশনে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। জুলাই-আগস্ট গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার এটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন। ১৯৫ দিন তদন্ত শেষে রোববার ৯০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়।
ড.
এমন পরিস্থিতিতে চানখাঁরপুল হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন– ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা জোনের সাবেক এডিসি শাহ আলম মো. আক্তারুল ইসলাম, সাবেক এসি মো. ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক আরশাদ হোসেন, তিন কনস্টেবল সুজন, ইমাদ হোসেন ও নাসিরুল ইসলাম। এদের মধ্যে চারজন পলাতক।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে দেওয়া হবে। তদন্ত প্রতিবেদনে ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের একটি অডিও কল রয়েছে। তিনি পুলিশ কমান্ড সেন্টার থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে সরাসরি গুলি চালাতে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশের পরই প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে পুলিশ।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, চানখাঁরপুল এলাকায় নিরস্ত্র আন্দোলনকারীর ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। এতে শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, রাকিব হাওলাদার, ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক নিহত হন। তদন্তে উঠে এসেছে, পলাতক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুরের নির্দেশে ঘটনাস্থল থেকে অন্য আসামিরা ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ছয়জনকে হত্যা করেন।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যেহেতু সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির তদন্ত চলছে, তাই তাদের এ মামলায় আসামি করা হয়নি। তবে নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনায় যে তাদের ভূমিকা রয়েছে, সেই বর্ণনা এই প্রতিবেদনে রয়েছে। কারণ, শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে তাঁর অধীনরা মাঠ পর্যায়ে থেকে ওই নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাকর্মী বাস্তবায়ন করেছে।
চিফ প্রসিকিউটর জানান, তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭৯ সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। দালিলিক তথ্য-প্রমাণের পাশাপাশি প্রতিবেদনে সংযুক্ত আছে ১৯টি ভিডিও, ১১টি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন, দুটি অডিও এবং ১১টি বই। এ ছাড়া প্রতিবেদনের সঙ্গে আরও ১১টি দলিল করা হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনও রয়েছে। আছে ছয় শহীদের মৃত্যুসনদ।
তিনি আরও বলেন, এ মামলার পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিচারের সময় পলাতক থাকলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হবে। যদি হাজির না হন, তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে। তখন তাদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবেন।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সাভারের আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর মামলার তদন্ত প্রতিবেদন এক সপ্তাহের মধ্যে পাওয়া যাবে। সেই প্রতিবেদন পেয়ে গেলে চানখাঁরপুল ও আশুলিয়ার ঘটনার বিচার একই সময়ে করা সম্ভব হবে।
এর আগে ১০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয় থেকে জানানো হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ট্রাইব্যুনালের পুনর্গঠন হলে এখন পর্যন্ত অভিযোগ এসেছে ৩৩৯টি। চলমান তদন্ত কার্যক্রম ৩৯টি। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে মামলা (বিবিধ মামলা) হয়েছে ২২টি। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত মোট অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৪১ জন। তাদের মধ্যে ৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক আছেন ৮৭ জন।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম জানিয়েছেন, ১৪১ আসামির মধ্যে ৭০ জন বেসামরিক, ৬২ জন পুলিশ (র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) সদস্য এবং অবসরপ্রাপ্ত বা বরখাস্ত করা সামরিক কর্মকর্তা ৯ জন রয়েছেন।
চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের উপস্থাপন করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত তদন্ত শেষ বা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে–এমন মামলা সংখ্যা চারটি। গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় চাঁনখারপুলের হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বাকি তিনটির মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া মামলা, সাভারের আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর মামলা এবং রাজধানীর রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা ব্যক্তির ওপর গুলির ঘটনায় হওয়া মামলা।
এক হাজার ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত এক হাজার ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিডিও ও ডিজিটাল সাক্ষ্য সংগ্রহ (এক হাজারের বেশি ভিডিও), পর্যালোচনা, যাচাই-বাছাই ও জিও লোকেশন যাচাইয়ের কাজ চলমান।
গুমবিষয়ক তদন্ত কার্যক্রমে ঢাকা শহরের তিনটি এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় গুমের তিনটি কেন্দ্র (আয়নাঘর, হাসপাতাল, এলআইসি ইত্যাদি বিভিন্ন কোড নামে পরিচিত) পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ১৫টি জেলায় তদন্ত পরিচালনার উদ্দেশ্যে একাধিকবার পরিদর্শন করা হয়েছে। তদন্তকাজে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসা পর্যায়ে এ পর্যন্ত চারটি গণশুনানি গ্রহণ করা হয়েছে। তাতে আট শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন।
কী ঘটেছিল চাঁনখারপুলে
গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে শাহবাগের মধ্য দিয়ে গণভবনের দিকে বিক্ষোভকারীদের অগ্রসর হওয়া ঠেকাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ইউনিটগুলোকে চাঁনখারপুল এলাকায় মোতায়েন করা হয়। প্রাথমিকভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করে। তবে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কনস্টেবল মো. সুজন হোসেনসহ কিছু অফিসার বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে তাজা গুলি চালান, যার ফলে বেশ কয়েকজন হতাহত হন।
নিহতদের মধ্যে ছিলেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় অবস্থিত আদর্শ একাডেমির দশম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস। মিছিলে অংশ নেওয়ার আগে, আনাস তার বাবা-মায়ের কাছে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি রেখে যায়, যেখানে সে এই আন্দোলনের প্রতি তার অঙ্গীকার প্রকাশ করে। চাঁনখারপুল এলাকায় পুলিশ তাকে তিনবার গুলি করে হত্যা করে। পরে তার মরদেহ ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা হয় এবং জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুর পর শহীদের সম্মানে গেন্ডারিয়ার ‘দীননাথ সেন রোড’-এর নামকরণ করা হয় ‘শহীদ আনাস রোড’। ঘটনার এক মাসেরও বেশি সময় পরে ১২ সেপ্টেম্বর কনস্টেবল সুজন হোসেনকে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ঘটন য় ল ইসল ম সদস য ড এমপ অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
সহস্রাধিক অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক
চট্টগ্রাম মহানগরীতে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজের নির্দেশনায় নগরজুড়ে পরিচালিত এই বিশেষ অভিযানে দুই দিনে সহস্রাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক করে ডাম্পিং করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম নগরীতে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা’র দাপটে অসহায় হয়ে উঠে নগরবাসী। বাহনটি বেপরোয়া কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে নগরের অলি-গলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রতিদিন। এসব রিকশার কারণে একদিকে নগরীতে যেমন যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, অপরদিকে একের পর এক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারী।
নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এসব রিকশার চালকরা কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করেন না। তাদের নেই কোন প্রশিক্ষণ, দ্রুত গতির ব্যাটারিচালিত রিকশায় নেই কার্যকর ব্রেকিং সিস্টেম। ফলে এসব রিকশা নগরীতে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, “চট্টগ্রাম মহানগরীতে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নগরীর প্রধান সড়কে চলাচলকারী সকল অবৈধ রিকশা আটক করতে পুলিশ দুই দিন ধরে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এরমধ্যে অনেক ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক করা হয়েছে। অভিযান চলমান আছে।”
এদিকে নগরীর ডবলমুরিং থানার মনসুরাদস্থ ট্রাফিক বিভাগের ডাম্পিং স্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে গত ২ দিনে সহস্রাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক করে ডাম্পিং করা হয়েছে। প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাটারি রিকশা আটক করে ডাম্পিং করা হচ্ছে। পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।
ঢাকা/রেজাউল/টিপু