ন্যূনতম জাতীয় মজুরি নির্ধারণের সুপারিশ
Published: 22nd, April 2025 GMT
শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন উপযোগী মজুরির অধিকার নিশ্চিতে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নির্ধারণের সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে মজুরি নির্ধারণ পদ্ধতি উন্নয়ন, বোর্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কাঠামোগত সংস্কারে স্থায়ী মজুরি কমিশন গঠন এবং জাতীয় ও খাতভিত্তিক মজুরি তিন বছর পরপর মূল্যায়নের মাধ্যমে বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কোনো পেশায় জাতীয় মজুরি নেই। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের ৫৮টি পেশায় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া এবং সম্মিলিত দরকষাকষির ক্ষেত্রে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা সহজ করার সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কোনো প্রতিষ্ঠানের ২০ শতাংশ শ্রমিক কিংবা কর্মীর স্বাক্ষরের ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য যোগ্য বিবেচনা করা হয়। কমিশন বলছে, এ পদ্ধতির পরিবর্তে ইউনিয়ন করতে ইচ্ছুক শ্রমিকের মোট সংখ্যার ভিত্তিতে ট্রেড নিবন্ধন দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কত শ্রমিকের সই প্রয়োজন হতে পারে, তা নির্ধারণে দ্রুত একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে কমিশন। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সব খাতের শ্রমিকের জন্য সমানভাবে শ্রম আইনের আওতায় ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে।
গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৪৬০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে শ্রম সংস্কার কমিশন। এতে শ্রম খাতের উন্নয়নে মোট ২৫টি সুপারিশ করা হয়। শ্রম খাতের সব অংশীজন, বিশেষ করে বিভিন্ন শ্রমিক-কৃষক, পেশাজীবী সংগঠন, উদ্যোক্তা, মানবাধিকার সংগঠন এবং দেশি, আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ পঞ্চাশের মতো অংশীজনের মতামত গ্রহণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন-নীতি, গবেষণা, অনলাইন মাধ্যম থেকে জনগণের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৭ নভেম্বর শ্রম খাত সংস্কারে করণীয় নির্ধারণের সুপারিশ চেয়ে ১০ সদস্যের এ কমিশন গঠন করে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদ কমিশনের নেতৃত্ব দেন।
জানতে চাইলে সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদ সমকালকে বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম সহজ করার সুপারিশ করা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সরকারি নিবন্ধন পেতে বর্তমান আইনে কোনো কারখানার অন্তত ২০ শতাংশ শ্রমিকের স্বাক্ষর থাকার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তার পরিবর্তে ট্রেড ইউনিয়নে ইচ্ছুক মোট শ্রমিকের সংখ্যাকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনার সুপারিশ করা হয়। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের মডেল অনুসরণ করা যায়।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোকেও (ইপিজেড) অভিন্ন শ্রম আইনের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে। একান্ত যদি একই আইনের আওতায় আনা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত যেন ট্রেড ইউনিয়ন, কারখানা পরিদর্শন ও শ্রম আদালত– এ তিনটি বিষয়কে অভিন্ন শ্রম আইনের অধীনে রাখা হয়।
কমিশনপ্রধান জানান, তাদের এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকার খুব আগ্রহী। প্রধান উপদেষ্টা বাস্তবায়নযোগ্য একটি অগ্রাধিকার তালিকা দেওয়ার জন্য কমিশনকে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে খুব শিগগির নিজেরা বৈঠকে বসবেন।
শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শ্রম আইন সংশোধনের কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১৫ শতাংশ শ্রমিকের সই থাকলেই নিবন্ধনের জন্য যোগ্য বিবেচনা করার কথা প্রস্তাব করা হচ্ছে। বর্তমান আইনে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সই না থাকলে ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধনের আবেদন করা যায় না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকেও ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন সহজ করার জন্য সরকারের ওপর চাপ রয়েছে। এ দুই সংস্থা শ্রমিকের ন্যূনতম অনুপাতের বিলুপ্তি চায়। ইপিজেডেও অভিন্ন আইন চায় সংস্থাগুলো। এ বিষয়ে সরকার আইএলওকে একটি পথনকশা জমা দিয়েছে। এ বছরের মধ্যে আইন সংশোধনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। একইভাবে ইইউর সঙ্গে একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। শ্রমিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই ১৫ শতাংশের সই-স্বাক্ষরের ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন অনুমোদনের দাবি জানিয়ে আসছে।
ট্রেড ইউনিয়নের গুরুত্ব তুলে ধরে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বজনীন সংগঠন ও অন্তর্ভুক্তির অধিকার নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক সব খাতের শ্রমিকদের জন্য সমানভাবে শ্রম আইনের আওতায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, ট্রেড ইউনিয়নে যোগদান, প্রতিনিধিত্ব এবং যৌথ দরকষাকষির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ রকম একটি পরিবেশ উন্নয়নে শ্রম আইনের সংশোধন ও সব বাধা দূর করতে হবে। কর্মসংস্থানের বাস্তবতা ভিন্ন হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত অন্তর্ভুক্তিমূলক ট্রেড ইউনিয়ন কাঠামো গঠন যে জরুরি, সে কথাও বলেছে কমিশন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও কাঠামোগত কোনো সমস্যা নেই। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন কিছুটা জটিল। এ বিষয়ে একটি আইনি কাঠামো গঠনের কথা বলেছে কমিশন। এ আইনি কাঠামোতে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে এমন শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন, মজুরিসহ অন্যান্য অধিকার চর্চার অনুমতি থাকতে হবে। এর মধ্যে বিশেষভাবে গৃহকর্মী, মালী, নিজস্ব গাড়িচালক, দৈনিকভিত্তিক মজুর, পরিবহন শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিকের কথা উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ট্রেড ইউনিয়ন কীভাবে হবে
প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সব খাতের শ্রমিকদের জন্য সমানভাবে শ্রম আইনের আওতায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, ট্রেড ইউনিয়নে যোগদান, প্রতিনিধিত্ব এবং যৌথ দরকষাকষির অধিকার নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয় কমিশনের প্রতিবেদনে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা কেমন হবে– জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য এবং বিলসের নির্বাহী সদস্য শাকিল আখতার বলেন, সব শ্রমিককে পরিচিতি কার্ড দেওয়া হলে তাদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে শনাক্ত করা যাবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতাও বিবেচনা করা সহজ হবে। অন্যান্য ছোট শিল্প কিংবা দোকানপাটের ক্ষেত্রে ৫০ জন শ্রমিকের সই-স্বাক্ষরের ভিত্তিতেই ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন করা যাবে।
ন্যায়বিচার ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা
প্রতিবেদনে শ্রমিকের ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও অযথা হয়রানি বন্ধে সরকারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া আইনের অধিকার লঙ্ঘন প্রতিকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও কাঠামো নিশ্চিত করা, বিরোধ নিষ্পত্তি ও আইনানুগ প্রাপ্য অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত কোনো কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বলপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন সময় শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিযোগে যেসব ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ও শ্রমিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে, তা দ্রুত পর্যালোচনা সাপেক্ষে বাতিল করার সুপারিশ রাখা হয়েছে।
শ্রমিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় একটি ন্যূনতম মজুরি কাঠামো দাবি করে আসছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পোশাক খাতের শ্রমিক নেতা তৌহিদুর রহমান গতকাল বলেন, জাতীয় একটি কাঠামো থাকলে শ্রমিকরা ন্যূনতম মানসম্পন্ন মজুরি পাবেন। কোনো প্রতিষ্ঠান এর চেয়ে বেশি দিতে পারবে; কিন্তু কম দিতে পারবে না। এতে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
কমিশনের অন্যান্য সুপারিশ
কমিশনের অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে সুসমন্বিত শিল্প সম্পর্ক ও সামাজিক সংলাপ চর্চা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। এ ছাড়া শ্রমসংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা, সরকারি শ্রম তথ্যভান্ডার তৈরি, সমঅধিকার নিশ্চিত ও বৈষম্য দূরীকরণে উদ্যোগ, মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা, যৌন হয়রানিমুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাসহ ২৫টি পরামর্শ।
এ নিয়ে গতকাল বিকেলে রাজধানীর বিজয়নগরের শ্রম ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে সংস্কার কমিশন। এতে কমিশনপ্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদ বলেন, শ্রম সংস্কার কমিশন সুপারিশগুলোর মধ্যে সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে উপযুক্ত ২৫টি মূল সুপারিশে গুরুত্ব আরোপ করেছে। কমিশন আশা করছে, সুপারিশগুলো শুধু কাগজে বন্দি না হয়ে শ্রমিক-কৃষকের জীবনযাত্রায় বাস্তবায়িত হবে। এই সুপারিশগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য কামরান তানভিরুর রহমান, এ এন এম সাইফ উদ্দিন, তপন দত্ত, সাকিল আখতার চৌধুরী, আরিফুল ইসলাম আদীব, এ কে এম নাসিম, ফারুক আহাম্মাদ, ফজলে শামীম এহসান, ড.
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সংবাদ সম্মেলন
কমিশনের সুপারিশ জমা দেওয়ার পর গতকাল সাংবাদিকদের অবহিত করেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, শ্রমিকদের নিবন্ধন থেকে শুরু করে পরিচয়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেসব মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করার কথাও বলেছে কমিশন। সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। দেশে আট কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছেন। তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ বা সা কোটি শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নেই।
তিনি বলেন, শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিটি এই শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে বিশেষ সুপারিশ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর র স প র শ কর স প র শ কর ছ ন য নতম ম অন য ন য সরক র র পর ব শ র জন য কর র ক স গঠন গতক ল সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
সিলেটের ‘আত্মগোপনে থাকা’ আওয়ামী লীগ নেতারা কে কোথায়
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই সিলেটের শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা আত্মগোপনে চলে যান। এসব নেতা বর্তমানে ভারত, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। বিদেশে অবস্থানকারী নেতাদের অনেকে নিয়মিত কর্মী–সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
দেশ-বিদেশে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের আটজন নেতা ও ছয়জন কর্মীর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, সিলেটের শীর্ষ নেতাদের অল্প কয়েকজন দেশে আছেন। বাকিরা বিদেশে। তবে মধ্যম ও তৃণমূল পর্যায়ের প্রায় সব নেতা এখনো দেশেই আত্মগোপনে আছেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী লন্ডনে চলে যান। রোববার দিবাগত রাতে তাঁর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কিছুসংখ্যক নেতা-কর্মী দেশের বাইরে আছেন। এ ছাড়া বেশির ভাগ নেতা-কর্মী দেশেই আছেন। দেশে থেকেই তাঁরা নীরবে দলকে সুসংগঠিত করতে কাজ করছেন। তবে দলীয় প্রধানের নির্দেশনা পাওয়ামাত্রই তাঁরা একযোগে দেশে ফিরবেন।
কোন নেতা কোথায়
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সিলেট-১ (নগর ও সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশেই আত্মগোপনে ছিলেন। সম্প্রতি তিনি দেশ ছেড়েছেন। তিনি ঢাকা থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় পৌঁছান।
৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে সিলেট মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁরা কলকাতা, শিলংসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন। কলকাতায় আছেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী (নাদেল) এবং সিলেট জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান।
দলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ভারতে আছেন সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আফসর আজিজ ও সহসভাপতি পিযুষ কান্তি দে, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আফতাব হোসেন খান ও সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস (মিঠু), সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ, মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাঈম আহমদ, সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর রুহেল আহমদ, ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম, সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সজল দাস (অনিক) প্রমুখ।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিলেটের অনেক নেতা যুক্তরাজ্যে চলে যান। তাঁদের মধ্যে সিলেট-২ (ওসমানীনগর ও বিশ্বনাথ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী আছেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। এ ছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এবং সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমানও যুক্তরাজ্যে আছেন। এই তিন নেতা ‘যুক্তরাজ্যের নাগরিক’ বলে একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্যে অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ ও মধ্যনগর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রনজিত চন্দ্র সরকার এবং মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা।
এ ছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছালেহ আহমদ ও আরমান আহমদ, সিলেট মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার, সিলেট জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হেলেন আহমদ, যুবলীগ নেতা রুহুল আমিন এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) শফিউল আলম যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন।
কর্মী–সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, যাঁরা দেশের বাইরে আছেন, তাঁরা দেশে একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড, নাশকতার অভিযোগসহ হামলা, ভাঙচুর ও বিস্ফোরক মামলায় আসামি করা হয়েছে তাঁদের।
তাঁদের দাবি, দেশে থাকা সিলেটের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ ও মহিলা লীগের অন্তত ১০০ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া গ্রেপ্তার এড়াতে সবাই আত্মগোপনে আছেন। এর বাইরে হঠাৎ দেশে থাকা নেতা-কর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল করেন। বিদেশে আশ্রয় নেওয়া নেতাদের বেশির ভাগই ফেসবুকে দলের পক্ষে এবং দেশে সংঘটিত বিভিন্ন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সরব আছেন।
দেশে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, দেশে থাকা ছাত্রলীগের কর্মীরা হঠাৎ বিক্ষোভ মিছিল করছেন। তবে এ কর্মসূচি পালন করে পরে অনেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। ২ এপ্রিল সকালে নগরে ছাত্রলীগ মিছিল বের করায় বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিকেলেই সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরীসহ পাঁচজন নেতার বাসায় হামলা হয়। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা এ হামলা চালিয়েছেন বলে ওই নেতা অভিযোগ করেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলেছে, বিদেশে অবস্থান নিলেও অনেক নেতা দেশে থাকা নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরা দলীয় নির্দেশনাও দিচ্ছেন। বিশেষ করে সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী দেশে-বিদেশে থাকা নেতা-কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছেন। তিনি গত ঈদে কারাবন্দী নেতাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি দেশে থেকে সংকটে পড়া নেতা-কর্মীদেরও নানাভাবে সহায়তা করছেন। এ ছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী, হাবিবুর রহমান ও রনজিত চন্দ্র সরকারও তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় সহায়তা করছেন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।