শহুরে ও গ্রামীণ জীবনের ফারাক ৩০০ কিমি কাঁচা সড়ক
Published: 21st, April 2025 GMT
ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ সড়ক থেকে মাইজবাগ পাছপাড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে গেছে ৩ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক। নান্দাইলের মোয়াজ্জেমপুরের পাকা সড়কে গিয়ে মিলেছে। সড়কটি দিয়ে প্রতিনিয়ত ঈশ্বরগঞ্জ ছাড়াও পাশের নান্দাইল উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষসহ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা নিয়মিত চলাচল করেন।
গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি স্বাধীনতার আগে থেকেই বেহাল বলে অভিযোগ মাইজবাগ ইউনিয়নের মো.
ঈশ্বরগঞ্জে এলজিইডির আওতাধীন উপজেলা, ইউনিয়ন এবং গ্রামীণ ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটেগরির ৫৫০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ কিলোমিটার কাঁচা। স্থানীয়রা বলছেন, গ্রামীণ সড়কে উন্নয়নের ছোঁয়া না লাগায় ঘুচছে না গ্রাম ও শহরের ব্যবধান। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ জনপদে উন্নয়ন না হওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে অর্থনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার।
উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষের বসবাস। গ্রামের বাসিন্দাদের ভাষ্য, শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু গ্রামের মানুষ অনেক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নতুন পেশায় যেতে পারেন না। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছেন। সড়ক ভালো না হওয়ায় অনেক গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগও পাচ্ছেন না।
উপজেলার মগটুলা ইউনিয়নের বল্লভপুর, ধুবলী, নারায়ণপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে তিন কিলোমিটার কাঁচা সড়ক বড়হিত ইউনিয়নের কাঁঠাল বাজারে চলে গেছে। এ সড়ক দিয়ে নিয়মিত চলাচল করা ধুবলী গ্রামের বাসিন্দা ও ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলছিলেন, ‘বর্ষাকালে এ পথ দিয়ে কলেজে আসা-যাওয়া করতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। সড়কটি পাকা হয়ে গেলে আমরা নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারতাম।’
এলজিইডি থেকে জানা গেছে, উপজেলায় ৫৪৫ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার সড়ক এলজিইডির অধীন। এর মধ্যে ২৪৩ দশমিক শূন্য ৫ কিলোমিটার পাকা। বাকি ৩০২ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার কাঁচা। উপজেলার নামীয় ৬৫ দশমিক ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৫৪ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার পাকা আর ১০ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার কাঁচা। ইউনিয়নের নামীয় ১৩০ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১১০ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার পাকা। বাকি ১৯ দশমিক ৩০ কিলোমিটার কাঁচা।
গ্রামীণ ‘এ’ ক্যাটেগরির ২২৮ দশমিক ৫৬ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭৭ দশমিক শূন্য ৭ কিলোমিটার সড়কই কাঁচা, বাকি ৪৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার পাকা। ‘বি’ ক্যাটেগরির ১২১ দশমিক ৯৩ কিলোমিটারের মধ্যে ৯৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার কাঁচা, বাকি ২৮ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার পাকা।
বিভিন্ন ইউনিয়নে পাকা সড়কের অধিকাংশই বেহাল অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় উঠে গেছে কার্পেটিং। ইটের খোয়া উঠে জরাজীর্ণ হয়ে আছে। বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত। এতে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে।
ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় বেশি প্রভাব পড়ছে কৃষি ও মৎস্য খাতে। কৃষিনির্ভর এলাকার উৎপাদিত পণ্য বাজারে সরবরাহের ক্ষেত্রে পরিবহন ভাড়া গুণতে হয় তিনগুণ পর্যন্ত। একই প্রভাব পড়ে মৎস্য খাতেও। বর্ষাকালে দুর্ভোগ বেড়ে যায়। সামান্য বৃষ্টিতে কাঁচা সড়ক পিচ্ছিল ও ছোট-বড় গর্তে পানি জমে থাকে। ফলে যানবাহন দূরের কথা, হেঁটে চলাচলেও বেগ পেতে হয়। বিশেষ করে রোগী ও শিক্ষার্থীরা পড়েন বেকায়দায়।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে গ্রামীণ অর্থনীতি গতিশীল হবে বলে মনে করেন উপজেলা সুজন সভাপতি ও প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম তালুকদার। তিনি বলেন, এতে শিক্ষারও মানোন্নয়ন হবে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে আহ্বান থাকবে, গ্রামীণ রাস্তাঘাট, কালভার্টসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে তারা যেন আরও অগ্রসর হন।
উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, অনেক কাঁচা সড়ক পাকা করার জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলে কাজ শুরু হবে। যেসব পাকা সড়ক সংস্কারের অভাবে বেহাল , সেগুলোও মেরামতের জন্যও প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু হবে।
ইউএনও মো. এরশাদুল আহমেদ বলেন, গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার মান বাড়লে গ্রাম-শহরের ব্যবধান ঘুচে যাবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইউনিয়নে রাস্তাঘাট ও কালভার্ট নির্মাণে বরাদ্দ এসেছে। এডিপির বরাদ্দ পেলে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোর কাজও বাস্তবায়ন করা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সড়ক উপজ ল র ব যবস থ বর দ দ হওয় য় ন নয়ন দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
২৮ বছর ধরে পত্রিকা নিয়ে ছুটছেন, স্বল্প আয়ে আর সংসার চলছে না বৃদ্ধ সেলিম উদ্দিনের
ষাটোর্ধ্ব মো. সেলিম উদ্দিন। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় যার জীবন যুদ্ধ। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, গরম কিংবা শীত উপেক্ষা করে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, অফিসে-আদালতসহ গ্রাহকদের কাছে পত্রিকা নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন এই বয়োজ্যেষ্ঠ। এ পেশা দিয়ে আগে কোনোমতে সংসার চললেও জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। একদিকে বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অন্যদিকে নানান অসুখ-বিসুখে শরীর সায় না দিলেও জীবন যুদ্ধে থেমে নেই সেলিম দেশ-বিদেশের খবরাখবর সবার ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিলেও এই মানুষটা যেন রয়ে যান খবরের অন্তরালেই।
সেলিমের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার চরনিখলা গ্রামে। সংসারে স্ত্রী ছাড়াও আছেন দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে দু'জন বিয়ে করে যে যার মতো আলাদা হয়ে গেছে অনেক আগেই। মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন। সম্পদ বলতে বাড়ির ভিটে টুকুই আছে তার। নিজে কষ্টে দিনাতিপাত করলেও 'হকারি' পেশায় ভিড়তে দেননি দুই ছেলেকে। বড় ছেলেটা অটোরিকশাচালক, আর ছোট ছেলেটা হাফেজি শেষ করে টঙ্গী একটা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন।
শুক্রবার পৌরসভার দত্তপাড়া এলাকায় পুরোনো বাইসাইকেল থামিয়ে একটি বাসায় পত্রিকা দিতে যাবেন এমন সময় কথা হয় তার সঙ্গে। আলাপকালে সেলিম উদ্দিন সমকালকে জানান, ‘বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আয়-ব্যয়ের পাল্লার হিসেব মেলে না। অসুস্থ শরীর নিয়েও কাকডাকা ভোরে উঠে গ্রাহকদের পত্রিকা পৌঁছাতে হয়। আগে কোনোমতে জীবন চললেও মাস শেষে এখন যে টাকা কমিশন পায় তা দিয়ে চলতে খুবই কষ্ট হয়। আমাদের কথা কেউ ভাবে না। আমরাও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আমাদেরও সংসার আছে। অসুখবিসুখ আছে। দুদিন বিছানায় পড়ে থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে।’
তিনি জানান, তার কোনো নির্দিষ্ট দোকান কিংবা ঘর নেই। প্রতিদিন সকালে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পত্রিকাগুলো আসে। পরে সেখান থেকে নিয়ে তিনি বাইসাইকেল দিয়ে সবার কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেন।
এদিকে পত্রিকা বিক্রিতে না পোষানোর কারণে সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যায় দীর্ঘ ৫৫ বছর পত্রিকা বিক্রির দোকানটি। দোকানের মালিক পীযুষ কান্তি শীল বাপ্পি বলেন, ছাপা পত্রিকার চাহিদা একেবারেই কমে গেছে। একজন লোক রেখে মাসশেষে তার বেতনই দিতে পারি না। দিন দিন লসের পাল্লা ভারি হচ্ছিল। যে কারণে বাধ্য হয়েই ব্যবসা বন্ধ করতে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আবুল মুনসুর বলেন, এখনতো ইন্টারনেটের যুগ। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গণমাধ্যম, সংবাদপত্র অনেক আধুনিক হয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ মানুষ মোবাইল অথবা টেলিভিশনেই দেশ-বিদেশের খবরাখবর জেনে যায়। যে কারণে ছাপা পত্রিকার প্রতি মানুষের দিনদিনই আগ্রহ কমে যাচ্ছে। একটা সময় পর এর প্রচলন আরও কমে যাবে। সেক্ষেত্রে ব্যাপক একটি প্রভাব পড়বে হকারদের ওপর। যেই দুর্ভোগটা ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, অনেক হকার আছেন তিনবেলা ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে এই পেশায় এসেছিলেন। শেষ বয়সে এসে অন্যকিছু করে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করবে সেটারও তো উপায় নেই। স্থানীয় প্রশাসন অথবা সাংবাদিক সংগঠনগুলোর উচিৎ তাদের পাশে দাঁড়ানো।
ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. আতাউর রহমান বলেন, সমাজের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অসংগতিগুলো আমরা পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরি। আর সেগুলো পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেয় হকার। আমাদের কাছে এই মানুষগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে পূর্বেও তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও করা হবে। পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. এরশাদুল আহমেদ বলেন, সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন পত্রিকার হকার। তাদের বিপদ-আপদে আমাদের অবশ্যই পাশে থাকা উচিৎ। আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।