তিস্তা মহাপরিকল্পনায় বহুপক্ষীয় অংশীদারিত্ব যেভাবে সম্ভব
Published: 21st, April 2025 GMT
গত মাসের শেষ সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরকালে তিস্তা নদীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে (টিআরসিএমআরপি) চীনের অংশগ্রহণের জন্য আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানান। এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য পানিপ্রবাহ পুনরুদ্ধার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীর পুনরুজ্জীবন ও কৃষি-জীবিকার উন্নয়ন। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আহ্বানই ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গন ও মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য তিস্তা শুধু নদী প্রকল্প নয়; দুই কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষারও প্রশ্ন। আবার নদী ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, পরিবেশগত সংকট নিরসন, কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব হ্রাস মিলে প্রকল্পটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক গতিশীলতারও ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। এখানে ‘উইন-উইন’ বা সব পক্ষের জন্য সুবিধাজনক সমাধানে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের পাশাপাশি আঞ্চলিক আস্থা ও সহমর্মিতার রাজনীতিও অপরিহার্য। এটি শুধু পানি বণ্টনের প্রশ্ন নয়; বরং আঞ্চলিক আধিপত্য, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব ও পরিবেশগত স্থায়িত্বশীলতা ঘিরে এক রাজনৈতিক লড়াই। প্রকল্পটিতে বহুপক্ষীয় সহযোগিতা, পদ্মা সেতুর অভিজ্ঞতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বনাম তিস্তা মহাপরিকল্পনা
বিশ্বব্যাংক ও এডিবির অর্থায়ন বাতিলের পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে ৩০ হাজার কোটি টাকার দেশীয় অর্থায়ন বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস বাড়ালেও তিস্তার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ভিন্ন। কারণ তিস্তা একটি আন্তঃসীমান্ত নদী, যেখানে উজানের দেশ ভারত থেকে পানিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা ছাড়া কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তির খসড়া প্রস্তুত হলেও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে এটি এখনও অমীমাংসিত। এদিকে গত এক দশকে তিস্তার পানিপ্রবাহ ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে (সিইজিআইএস), যা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে ফেলেছে।
পদ্মা সেতুর মতো তিস্তা নদী প্রকল্পেও বহুপক্ষীয় অর্থায়ন (যেমন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক-এআইআইবি) সম্ভব হলেও এখানে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত-চীনের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের (বিআরআই) মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী, যার অংশ হিসেবে তিস্তা প্রকল্পে চীন প্রযুক্তি ও অর্থ সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ভারতের জন্য এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বিআরআইর আওতাভুক্ত চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) মতো প্রকল্প ইতোমধ্যে ভারত-চীন সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া তিস্তা প্রবাহিত হয়েছে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’ এলাকার কাছ দিয়ে। ভারত চায় না এ অঞ্চলের হাইড্রো-ডেটা চীনের হাতে যাক। এ প্রেক্ষাপটে তিস্তায় বহুপক্ষীয় সহযোগিতা কূটনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে, যেখানে বাংলাদেশকে ভারসাম্য বজায় রেখে জাতীয় স্বার্থে এগোতে হবে।
ভারত-চীন সমন্বয় কেন কঠিন?
২০২৩ সালে ভারত-চীন বাণিজ্যের পরিমাণ ১৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যেখানে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। তবে এই অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও রাজনৈতিক কৌশলগত দ্বন্দ্বের সহাবস্থান রয়েছে। ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গালওয়ান উপত্যকার (২০২০) মতো বিভিন্ন সময়ে দুই দেশ সীমান্তে মুখোমুখি হয়েছে এবং সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। চতুর্দেশীয় (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত) কৌশলগত জোট ‘কোয়াড’ নিয়েও চীন হুমকি মনে করছে। এসব দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকেই বাংলাদেশকে ভারসাম্যমূলক কূটনীতি
চালাতে হচ্ছে। তিস্তার ক্ষেত্রে চীন ও ভারতকে এক টেবিলে আনা তাই বেশ জটিল ও কঠিন বিষয়।
বিশ্বব্যাংক-এডিবি: নীতি বনাম বাস্তবতা
বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পরিবেশগত নীতিমালা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হলেও স্থানীয় প্রেক্ষাপট ও নদীর প্রাকৃতিক গতিধারার প্রতি সংবেদনশীলতার অভাব প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ধরনের ফাঁক রেখেছে। যেমন ফারাক্কা ব্যারাজের মাধ্যমে ১৯৭৫ সাল থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে গঙ্গা-পদ্মার নাব্য ১৯৯৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা নদীভিত্তিক মৎস্য চাষ, নৌপরিবহন ও সেচ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, শুধু নাব্য হারানোর কারণে বাংলাদেশের বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ১.
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নীতিমালায় নদীর পারিস্থিতিক ভারসাম্য রক্ষায় স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ প্রায়ই উপেক্ষিত। যদিও গবেষণা প্রমাণ করে, স্থানীয় কৃষক, পরিবেশকর্মীর অভিজ্ঞতাভিত্তিক সমাধান নদী ব্যবস্থাপনার সাফল্যের হার ৪০ শতাংশ বাড়াতে পারে (ইউএনডিপি রিপোর্ট, ২০২১)। তাই তিস্তা প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক-এডিবির অর্থায়ন শর্ত পূরণের পাশাপাশি স্থানীয়দের ‘নদীকেন্দ্রিক জ্ঞান’ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলে তা হবে টেকসই সমাধানের চাবিকাঠি।
অন্তর্বর্তী সরকারের সম্ভাবনা
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গত আট মাসে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ বাড়ানোর সম্ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সফল হয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূস চাইলে তিস্তার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করতে পারেন। প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাংকের দ্বাদশ প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম তাঁর মেয়াদে দক্ষিণ এশিয়ায় পানি ও জলবায়ু প্রকল্পে বিনিয়োগে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংক ‘বাংলাদেশ ওয়াটার সেক্টর ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সম্পর্ক ও যোগাযোগের মাধ্যমে যদি তাঁকে তিস্তা আলোচনায় যুক্ত করা যায়, তাহলে হয়তো বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানকে তিস্তা প্রকল্পে পুনরায় আগ্রহী করে তোলা যাবে। কিম বা মাসাতসুগু আসাকাওয়ার মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব তিস্তা মহাপরিকল্পনায় সম্পৃক্ত হলে এটি ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হতে পারে এবং চীনের অংশগ্রহণকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। এমন আরও সম্ভাবনার ধারণা যদি সরকার সার্বিক দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে পারে তবে তা সম্পর্কের টানাপোড়েন কমাতে সহায়ক হতে পারে। সর্বোপরি এ জন্য ভারতের সম্মতি ও চীনের স্বার্থের সঙ্গে সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা এখনও একটি চ্যালেঞ্জ।
তিন স্তরের কূটনৈতিক সমাধান
ক. ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবিলা: চীনের বিআরআই উদ্যোগের আওতায় তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে চীনের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা চাওয়ার পর বাংলাদেশ একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়ন এবং আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগের মতো প্রকল্পে সমন্বয় জোরদার করতে পারে। ২০২৩ সালে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার হওয়া সত্ত্বেও ভারত চায় না চীন দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করুক। দুই দেশের সঙ্গেই যুগপৎ সম্পৃক্ততা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ হ্রাসে ভূমিকা রাখতে পারে।
পাশাপাশি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির (১৯৯৬) সাফল্য অনুসরণ করে তিস্তার পানি বণ্টনে ডেটা শেয়ারিং চালু করা যেতে পারে। গঙ্গা চুক্তির ফলে বাংলাদেশ প্রতি শুষ্ক মৌসুমে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পেয়েছে, যা কৃষি ও নদীর নাব্য রক্ষায় সহায়ক। তিস্তার পানিপ্রবাহ গত এক দশকে ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ২১ হাজার হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত। যৌথ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করে ভারতের গজলডোবা বাঁধের অন্যায্য পানির অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব।
খ. ত্রিপক্ষীয় মধ্যস্থতা: ২০১৫ সালে কার্যকর স্থলসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় করে ৫২ হাজার মানুষের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করেছিল। এটা আঞ্চলিক আস্থা তৈরির উৎসাহজনক উদাহরণ। একই মডেলে তিস্তা ইস্যুতে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা যেতে পারে।
আমরা দেখি, মেকং-গঙ্গা কো-অপারেশনের মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৬টি দেশ নদী ব্যবস্থাপনা, পর্যটন ও ডিজিটাল সংযোগে সহযোগিতা করছে। বাংলাদেশ এ মডেলে বিমসটেককে কাজে লাগিয়ে ভারত-চীন-নেপাল-ভুটানের সঙ্গে যৌথ নদী কমিশন গঠন করতে পারে।
এ ছাড়া ভুটান ২০২২ সালে ভারতকে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করে ৮৩ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা তাদের জিডিপির ২০ শতাংশ। তিস্তায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এই মডেল অনুসৃত হতে পারে।
গ. বহুস্তরীয় আলোচনা : তিস্তা আলোচনায় বিশ্বব্যাংক, এডিবির পাশাপাশি জাতিসংঘ তথা ইউএন-ওয়াটার ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে গঙ্গা-পদ্মা নদীর ৭৫ শতাংশ নাব্য হ্রাসের বিষয়টি বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে সমাধানযোগ্য। ইউএন-ওয়াটারের মাধ্যমে নদী ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড প্রয়োগ করা যেতে পারে, যেমনটি মেকং নদী কমিশনে করা হয়েছে। পাশাপাশি ইন্দো-ভুটান চুক্তি শিক্ষা দেয়, কীভাবে ছোট ও বড় দেশের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ ও পারস্পরিক সুবিধার সম্পর্ক জলবিদ্যুৎ সহযোগিতাকে সফল করতে পারে। ভুটান বর্তমানে ২.৩ গিগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দিয়ে প্রধানত ভারতের চাহিদা মেটাচ্ছে, যা বছরে প্রায় ৮ হাজার মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বাংলাদেশের জন্য ভুটানের বিদ্যুৎ সরবরাহের সম্ভাবনা রয়েছে, যেমন সাঙ্কুসি প্রকল্পে আলোচনা চলছে। তবে এটি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। তিস্তা প্রকল্পে এই মডেল থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে পারে, যদি ভারত ট্রান্সমিশন ও পানি বণ্টনে নমনীয়তা দেখায়।
বিশ্বজুড়ে তো বটেই, ছোট দেশের কূটনৈতিক নমনীয়তা ও আঞ্চলিক চাহিদার প্রতি সংবেদনশীলতা দক্ষিণ এশিয়াতেও উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। যেমন নেপাল স্থলবেষ্টিত হওয়া সত্ত্বেও ভারত ও চীনের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করেছে। সিঙ্গাপুরের নিরপেক্ষ বহুপক্ষীয়তা– সিঙ্গাপুর আকারে ছোট হলেও নিরপেক্ষ বহুপক্ষীয় নীতির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করে। মালাক্কা প্রণালির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে। নেদারল্যান্ডস সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও ‘জল কূটনীতি’র মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা (রাইন নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় জার্মানি, ফ্রান্সের সঙ্গে যৌথ কমিশন) করে। মালদ্বীপ অতীতে চীনের কাছ থেকে বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়েও বর্তমানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করছে। এমন আরও উদাহরণ বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। দেশের স্বার্থ রক্ষা করে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির (২০১৫) সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে রেল-সড়ক সংযোগের প্রস্তাব দিতে পারে, যা আঞ্চলিক বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করবে। ব্রহ্মপুত্র বা মেঘনা নদীর ব্যবস্থাপনায় ইন্দো-বাংলাদেশ-চীন ত্রিপক্ষীয় কমিশন গঠন করা যেতে পারে। দেশের স্বার্থে উচিত হবে চীন-ভারতের মধ্যে ‘নিরপেক্ষ বহুপক্ষীয়তা’ বজায় রাখা; যে কোনো এক পক্ষের ওপর অতিনির্ভরশীলতা এড়ানো। বাংলাদেশের সাফল্য নির্ভর করবে কূটনীতির নমনীয়তা, প্রতিবেশীর উদ্বেগের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বহুপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ অর্জনের সামর্থ্যের ওপর।
‘উইন-উইন’ সমাধান
তিস্তা নদীর সংকট সমাধান শুধু বাংলাদেশ-ভারত-চীন ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়। এটি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। এই জটিল সমীকরণ থেকে বের হওয়ার জন্য প্রয়োজন ত্রিপক্ষীয় আস্থা নির্মাণ: বাংলাদেশের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা, ভারত-চীনের মধ্যে চলমান সীমান্ত দ্বন্দ্ব ও বাণিজ্য অসমতা নিরসনে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে।
বস্তুত, সঠিকভাবে সঠিক পথে এগোতে পারলে তিস্তা মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার মডেল হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ। মেকং নদী কমিশনের মডেলে তিস্তা রিভার বেসিন অথরিটি গঠন করা গেলে, যেখানে ভারত-বাংলাদেশ-চীন যৌথভাবে নদীর প্রতিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করবে– তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা এ অঞ্চলের অন্যান্য নদীর জন্য টেকসই মডেল হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের চৌকস নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা (বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ইউএন-ওয়াটার), ত্রিপক্ষীয় আস্থা (ভারত-চীন-বাংলাদেশ) এবং স্থানীয় সমাধানের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।
এখানে ‘উইন-উইন’ সমাধানের অর্থ ভারত পাবে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা; চীন পাবে বিআরআইর উদ্যোগের মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ; বাংলাদেশ পাবে নদীর ন্যায্য হিস্যা, কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষমতা এবং বৈশ্বিক কূটনীতিতে নতুন উচ্চতা। তিস্তা সংকটের সমাধান শুধু পানি বণ্টনের লড়াই নয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যতের দর্পণ হতে পারে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রজ্ঞাই এই দর্পণে ‘উইন-উইন’ প্রতিবিম্ব ফুটিয়ে তুলতে পারে।
এফ. এম. আনোয়ার হোসেন: উন্নয়নকর্মী
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: নদ প ন প রব হ ভ র জন ত ক র ক টন ত ক উইন উইন ভ রস ম য দ বন দ ব প রকল প সহয গ ত গঠন কর নদ র প প রস ত র জন য ন উইন ব শগত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
গ্রিসের পর্যটন দ্বীপ সান্তোরিনির নিচে ঘুমিয়ে আছে ভয়ংকর আগ্নেয়গিরি
গ্রিসের জনপ্রিয় পর্যটন দ্বীপ সান্তোরিনি। যেখানে সাদা-নীল বাড়ি, সূর্যাস্ত আর নীল সমুদ্রের অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের টানে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করেন। কিন্তু অনেকের স্বপ্নের এই দ্বীপের নিচেই লুকিয়ে আছে এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি, যা আবারও ভয়াবহ বিস্ফোরণে ফেটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রায় ৩ হাজার ৬০০ বছর আগে আগ্নেয়গিরির বিশাল এক বিস্ফোরণে সান্তোরিনি দ্বীপের বর্তমান আকৃতি তৈরি হয়। সেই বিস্ফোরণে দ্বীপের মাঝখান দেবে গিয়ে একটি বিশাল গর্ত বা কালডেরা সৃষ্টি হয়। এর পর এই অঞ্চলটিতে বড় আকারের ভূমিকম্প আর দেখা যায়নি।
গত বছরের শুরুর দিক থেকে কয়েকবার ভূমিকম্পে দ্বীপটি কেঁপে ওঠায় নতুন করে সামনে এসেছে দ্বীপটির নিচে ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা ও তার ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এ ধরনের ভূমিকম্প ভূগর্ভের ম্যাগমা চেম্বারে চাপ বাড়ার লক্ষণ হতে পারে।
ব্রিটেনের গবেষণা জাহাজ ‘আরআরএস ডিসকভারি’ থেকে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের একটি দল সান্তোরিনির সমুদ্রতলের আগ্নেয়গিরি ও হাইড্রো-থার্মাল ভেন্ট নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন এখন। চলমান এ গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্রিটেনের ন্যাশনাল ওসিওগ্রাফি সেন্টারের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইসাবেল ইয়ো। তিনি জানান, এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হলো আগ্নেয়গিরির আচরণ বিশ্লেষণ করে কখন বড় বিস্ফোরণের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে তা বুঝতে পারা। সান্তোরিনি দ্বীপের ৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সাগরের নিচে থাকা আরেকটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি কলোম্বো নিয়েও পর্যবেক্ষণ করছেন তারা।
চলমান এই গবেষণায় রোবটের মাধ্যমে সাগরের ৩০০ মিটার নিচ থেকে গরম পানি, গ্যাস ও আগ্নেয় পাথরের নমুনা সংগ্রহ করছেন তারা। এ ছাড়া ভূকম্পন এবং ভেতরে থাকা জ্বলন্ত লাভার গতিবিধি বোঝার জন্য ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রও তৈরি করছেন গবেষকরা। এই গবেষণা শেষে পাওয়া তথ্য গ্রিস সরকারকে সরবরাহ করা হবে। গ্রিসের সিভিল প্রটেকশন এজেন্সি এই গবেষণার ফল বিশ্লেষণ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করছে। অধ্যাপক পারাস্কেভি নোমিকো– যিনি নিজে সান্তোরিনির বাসিন্দা এবং সরকারিভাবে জরুরি পরিকল্পনায় যুক্ত– বিবিসিকে বলেন, ‘এই গবেষণা আমাদের জানাবে, কোথায় কতটা ঝুঁকি এবং কোন এলাকায় আগ্নেয়গিরি জেগে উঠলে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।’
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ফলে সান্তোরিনির ১১ হাজার বাসিন্দার প্রায় অর্ধেকই দ্বীপ ছেড়ে চলে গেছেন। পর্যটন খাতেও এর প্রভাব পড়েছে। অনেকেই তাদের পূর্বনির্ধারিত ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। স্থানীয় ফটোগ্রাফার ইভা রেন্ডল বলেন, ‘আমার অনেক ক্লায়েন্ট তাদের শুটিং বাতিল করেছেন। আগে এপ্রিল থেকেই কাজ শুরু হতো; এবার মে পর্যন্ত কেউ আসেনি।’
তবে দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়া অনেকেই জায়গাটির অতুলনীয় সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে আবার ফিরেও আসছেন। সান্তোরিনিতে বিয়ের ছবি তুলতে আসা এক নবদম্পতি বলেন, ‘আমরা ইচ্ছা করেই আগ্নেয়গিরির পাশে বিয়ে করতে চেয়েছি!’ এখন পর্যন্ত তাৎক্ষণিক বিস্ফোরণের আশঙ্কা না থাকলেও বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এটি ‘শুধু সময়ের ব্যাপার।’ বিবিসি।