‘বিল তো ঠিকই দিই, পানি পাই না এক ঘণ্টাও’
Published: 21st, April 2025 GMT
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সুমন মিয়া। স্থানীয় একটি দোকানের এই কর্মীর সংসার স্ত্রী ও তিন মাসের সন্তান নিয়ে। প্রতি দিন সকালে পানির জন্য ঘর থেকে বের হতে হয় তাঁর স্ত্রী শিউলি বেগমকে। প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি নিয়ে বাসায় ফিরতে হয়। বেশ কিছুদিন ধরে এই দম্পতির মতো পানি সংকটে ভুগছেন পৌর এলাকার বাসিন্দারা।
গতকাল সোমবার রায়পুর পৌর এলাকা ঘুরে এলাকাবাসীর দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে। তারা জানান, কলে পানি নেই, কিন্তু বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে। কয়েক দিন ধরে গোসলও করতে পারছেন না অনেকে। এসব নিয়ে সংসারেও দেখা দিয়েছে অশান্তি। সরকারি চাকুরে ইউছুফ মিয়াকে পৌর এলাকার বাসা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের কর্মস্থলে যাতায়াত করতে হয় নিয়মিত। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই ফিরে গোসলের পানি পান না। তাঁর স্ত্রী-সন্তানরাও নিয়মিত গোসল করতে পারছে না।
একই দুর্দশার মধ্যে পড়েছে শত শত পরিবার। ওয়াপদা কলোনির বাসিন্দা দিলীপ কুমার পাল রায়পুর সরকারি কলেজের প্রাক্তন প্রভাষক। তিনি বলেন, পুকুর শুকিয়ে গেছে। পাশের ডাকাতিয়া নদীর পানিতে কচুরিপানা পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কয়েক দিন ধরে পরিবারের তিন সদস্য গোসল করতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে ৯ দশমিক শূন্য ৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রায়পুর পৌরসভার যাত্রা শুরু। প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের দৈনিক পানির চাহিদা ৩০ লাখ লিটার। অথচ সরবরাহ হচ্ছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। ২০০১ সালে ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (ড্যানিডা) একটি প্রকল্পের আওতায় শোধনাগার নির্মাণ শুরু হয়। এর ধারণক্ষমতা ৭ লাখ লিটার। ২০২৪ সালে মাত্র ২০০ গ্রাহকের মধ্যে সরবরাহ দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২১ সালে নতুনবাজারে একটি ৫ লাখ লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন শোধনাগার নির্মিত হয়। দুটিতে প্রায় ২ হাজার ৬০০ গ্রাহক। সব মিলিয়ে দিনে ১২ লাখ লিটার পানি সরবরাহ করা যায়।
গ্রাহকদের অভিযোগ, কোথাও দিনে মাত্র এক ঘণ্টা, কোথাও আবার একদিন পরপর পানি মিলছে। যা মিলছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। রান্নাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ করতে না পারায় বেকায়দায় পড়েছেন তারা। তাদের ভাষ্য, মাস শেষে ঠিকই ৩৫০ টাকা বিল দেন, কিন্তু পানি পান না ঠিকমতো। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না।
ব্যবসায়ী আহসানুল্লাহ বলেন, ‘প্রতি মাসে আগে ৩০০ টাকা দিয়েছি। এখন বাড়তি ৫০ টাকা নিচ্ছে পৌর কর্তৃপক্ষ। পানির বিল দিচ্ছি, অথচ পানি পাচ্ছি না। ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে কাজেরও ক্ষতি হচ্ছে।’
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাজিম উদ্দিনের প্রতিদিনের দুশ্চিন্তা, বাসায় পানি আছে তো! তাঁর মেয়েরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে পানির জন্য লাইনে দাঁড়াচ্ছে। এটা ভাবতেও কষ্ট হয়। বছরখানেক আগে দুবাই থেকে ফেরা ইয়াকুব আলীও ভাবেননি দেশে ফিরে এমন অসহায় পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘পানি ছাড়া জীবন চলে?’
মধ্যবাজার এলাকার কাঁচামাল ব্যবসায়ী সুমনের স্ত্রী শিউলি বেগমকে ছোট্ট সন্তান রেখে ভোরে পানির জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, কখনও পানি পান, কখনও পান না। এ কারণে রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়াসহ সবকিছুতেই ভোগান্তি হচ্ছে। দুই সন্তানের মা তানিয়া বেগম থাকেন রায়পুর পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। সোমবার আধা কিলোমিটার দূরে গিয়েও পানি পাননি। খালি হাতে ফেরার সময় অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।
দিনের পর দিন এমন দুর্ভোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ব্যবসায়ী রহিম সরদার। তিনি বলেন, ‘মাস শেষে ঠিকই ৩৫০ টাকা বিল দেই। কিন্তু এক ঘণ্টাও পানি পাই না। রান্না, গোসল– কোনো
কিছুই করতে পারি না। পাইপলাইনের সংযোগ নিয়েছি, কিন্তু ওয়াসার কল শুকনো পড়ে থাকে। এক ফোঁটা পানিও আসে না। এই কষ্ট আর সহ্য হয় না।’
রায়পুরের ইউএনও মো.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রসভ র সরবর হ র এল ক ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
৪০ শতাংশ কাজ করে অর্ধেক বিল তুলে ঠিকাদার লাপাত্তা
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া ও আদমদীঘি উপজেলার গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। সে লক্ষ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে কমিউনিটিভিত্তিক পানি সরবরাহ নামে পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু কাজ মাঝপথে ফেলে রেখে লাপাত্তা হয়ে গেছেন ঠিকাদার। এতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রায় ৫ হাজার পরিবার বিশুদ্ধ পানির সুবিধা পাবে কিনা, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।
এখন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় লোকজন চেয়ারম্যানদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। এতে বিপদে পড়েছেন জনপ্রতিনিধিরাও। এলাকার পানিতে প্রচুর আয়রন আছে জানিয়ে দুপচাঁচিয়ার আলতাফনগর এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, এ পানি পান করে অনেকে নানান রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। সরকারের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আয়রনমুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানির সুবিধা পাবেন বলে আশা ছিল তাদের। কিন্তু ঠিকাদার কাজ বন্ধ রেখেছেন। এতে তারা হতাশ। কাজটি হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন।
প্রকল্পটির আওতায় দুপচাঁচিয়ার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে দুপচাঁচিয়া সদর, গুনাহার ও গোবিন্দপুরকে বেছে নেওয়া হয়। এ তিন ইউনিয়নে পরীক্ষামূলকভাবে ১৮টি ট্যাঙ্ক স্থাপন করে দুই হাজার পরিবারকে পানি সরবরাহ করা হবে। সে জন্য ৬২ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়। আদমদীঘির ছয়টি ইউনিয়নের তিন হাজার পরিবার এ সুবিধা পাবেন। সে জন্য ব্যয় ধরা হয় ৭৭ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পানি সরবরাহ ইউনিট স্থাপন কাজের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দুই উপজেলার জন্য ঢাকার পুরানা পল্টন এলাকার মেসার্স আমান অ্যান্ড কেয়া ট্রেডার্স নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ কাজ পায়। ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরে ১৮ মাসের মধ্যে কাজটি শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর শুরুর সময় ঠিক হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করে।
জানা গেছে, দুপচাঁচিয়ার ১৬টি ইউনিটের মধ্যে দেবড়াশন, আলতাফনগর, চৌমুহনী বাজার, আমষট্ট, শেরপুর, কেউৎ ও বাজারদীঘির আটটি ইউনিটে বোরিংসহ কয়েকটির অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। আর কাজ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ৪০ শতাংশ কাজ করে বরাদ্দের অর্ধেক টাকা (বিল) তুলে নিয়েছে তারা। এর পর দেড় বছর ধরে লাপাত্তা ঠিকাদার।
প্রকল্পের কাজ শুরু হলে এলাকার মানুষ খুশি হয়েছিলেন বলে জানান দুপচাঁচিয়ার গুনাহার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ আবু তাহের। তাঁর ভাষ্য, মাঝপথে কাজ বন্ধ করায় এলাকার মানুষ বলছে, প্রকল্পের টাকা চেয়ারম্যানরা মেরে খেয়েছে। এ কারণে কাজ হচ্ছে না। তিনি বলেন, দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে। অন্যথায় কর্তৃপক্ষকে এলাকায় গিয়ে মানুষকে ব্যাখ্যা দিতে হবে, কেন কাজ হচ্ছে না।
দুপচাঁচিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ঠিকাদারকে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার জন্য কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাড়া
দিচ্ছেন না। উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভায় চেয়ারম্যানরা কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সভার সিদ্ধান্তে ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। এ সিদ্ধান্তও ঠিকাদারকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
একই অবস্থা আদমদীঘিতেও। এ উপজেলায় একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৪০ শতাংশ কাজ করে অর্ধেক টাকা তুলে নিয়েছে। এখানে ২৬টি ইউনিটের মাধ্যমে তিন হাজার মানুষকে সুবিধা দেওয়ার কথা। কিন্তু ছয়টি ইউনিয়নে ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে ১২টি। আদমদীঘি সদর, নসরৎপুর, চাপাপুর, দুর্গাপুর, কুন্দ্রগ্রাম ও ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়নে এসব স্থাপন করা হয়েছে।
প্রকল্পের কাজ মাঝপথে আটকে থাকায় এলাকার মানুষ চেয়ারম্যানদের চোর অপবাদ দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন নসরৎপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা। তিনি বলেন, ‘আমরা এলাকায় যেতে পারছি না। দোষ করছে একজন, নাম হচ্ছে আরেকজনের।’
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী সুলতান মাহামুদ বলেন, ‘চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা আমাদের কটু কথা শোনান এ প্রকল্প নিয়ে। আমরা ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি।’ অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আমান অ্যান্ড কেয়া ট্রেডার্সের কর্ণধার আমান উদ্দিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তিনি ফোন বন্ধ রেখেছেন।
বগুড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া বলেন, ঠিকাদারকে বারবার প্রকল্পটির কাজ বাস্তবায়নের জন্য চিঠি দিয়ে অবগত করা হয়েছে। কিন্তু তিনি যোগাযোগ করছেন না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। দ্রুত কাজ শেষ না করলে কার্যাদেশ বাতিল করে বিকল্প উপায়ে প্রকল্পটি সম্পন্ন করা হবে।