শুরু করেছিলেন ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়। তারপর সুপ্রিম কোর্টের কড়া সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বিজেপির দুই সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবে ও দীনেশ শর্মা। বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা শুধু বলেছেন, দল ওই মন্তব্য সমর্থন করে না। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকার কোনো নির্দেশ দলীয় নেতাদের দেওয়া হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাক। তাঁকে নিশানা করে বিরোধীরা তাই সরাসরি জানতে চেয়েছেন, এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী।

তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল আর এন রবি ১০টি বিলে সই না করে বছর চারেক কাটিয়ে দেওয়ায় রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। বিচারপতি জেবি পর্দিওয়ালা ও বিচারপতি আর মহাদেবনের বেঞ্চ সেই মামলার রায়ে বলেছেন, প্রথমবার প্রত্যাখ্যাত বিল রাজ্য বিধানসভা দ্বিতীয়বার পাঠালে রাজ্যপাল সম্মতি দিতে বাধ্য থাকবেন। তিন মাসের মধ্যে সেই বিল সম্পর্কে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্বিতীয়বার পাঠানো বিল রাজ্যপাল বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারবেন না।

ওই রায়েই সুপ্রিম কোর্ট জানান, রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও তিন মাসের সময়সীমা প্রযোজ্য। রাষ্ট্রপতিও অনির্দিষ্টকাল সিদ্ধান্ত না নিয়ে থাকতে পারবেন না। কোনো ক্ষেত্রে বিলম্ব হলে সেই কারণ তাঁকে জানাতে হবে।

ভারতের সংবিধানে বিলে সই করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের জন্য সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় সেই দিক থেকে যুগান্তকারী। সেই রায়ের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দিলেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারই ‘সুপ্রিম’।

সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় পর্যালোচনার জন্য রিভিউ পিটিশন দাখিল করা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু একেবারে সরাসরি সমালোচনায় নামেন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টকে ‘সুপার পার্লামেন্ট’ তকমা দিয়ে তিনি বলেন, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টকে যে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে তা ‘পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র’ হয়ে উঠেছে।

সুপ্রিম কোর্টের প্রতি কটাক্ষ করে উপরাষ্ট্রপতি বলেন, বিচারপতিরা আইনসভার কাজ করবেন। আইন পাস করবেন। সরকারের কাজও করবেন। তাঁরাই সুপার পার্লামেন্ট। অথচ তাঁদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কারণ, কোনো আইনই তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

উপরাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, দেশের রাষ্ট্রপতির জন্য সুপ্রিম কোর্ট সময়সীমা বেঁধে দেবেন, এমন হতে পারে না। এসব মেনে নেওয়া যায় না। রাষ্ট্রপতিকে নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আদৌ আছে কি না, সেই প্রশ্নও তিনি তুলে দিয়েছেন।

উপরাষ্ট্রপতির মন্তব্যের সুরেই সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করেছেন বিজেপির দুই সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবে ও দীনেশ শর্মা। নিশিকান্ত ঝাড়গ্রামের গোড্ডা কেন্দ্র থেকে লোকসভায় নির্বাচিত। দীনেশ শর্মা উত্তর প্রদেশ থেকে রাজ্যসভার সদস্য। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি উত্তর প্রদেশের উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করে দীনেশ বলেন, মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রপতিই সুপ্রিম। তাঁকে চ্যালেঞ্জ করা বা নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার কারও নেই। লোকসভা ও রাজ্যসভাকে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা ভারতের সংবিধান কাউকে দেয়নি।

তবে নিশিকান্ত দুবের মতো এত কড়া ভাষায় সুপ্রিম কোর্ট ও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা কেউ করেননি। সুপ্রিম কোর্টের উদ্দেশে গোড্ডার সংসদ সদস্য বলেন, ‘আপনাদের যাঁরা নিয়োগ করেছেন, তাঁদের আপনারা কী করে নির্দেশ দেন? কটাক্ষ করে তিনি বলেন, বিচার বিভাগ যখন আইন প্রণয়ন করছে, তখন সংসদ ও বিধানসভা তুলে দেওয়া হোক।’

দুবে সরাসরি আক্রমণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নাকেও। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুনানি হয়েছে ওয়াক্ফ মামলার। তাঁর পর্যবেক্ষণের দরুণ কেন্দ্রীয় সরকার পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত নতুন ওয়াক্ফ আইনের বিতর্কিত বিষয় কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত নেয়। সুপ্রিম কোর্টের ওই মনোভাবের সমালোচনা করে দুবে বলেন, প্রধান বিচারপতি দেশে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছেন।

বিচার বিভাগের প্রতি এই ধারাবাহিক আক্রমণের মুখে সরকারের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে বিরোধী দলের নেতারা। কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা মনে করছেন, উপরাষ্ট্রপতির পাশাপাশি বিজেপির সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম কোর্ট ও বিচারপতিদের সমালোচনা করা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নীরব।

বিরোধীদের অভিযোগ, ধারাবাহিকভাবে সংবিধানের ওপর আঘাত হানা হচ্ছে। অথচ সরকার চুপ। দলীয় সংসদ সদস্যদের মন্তব্য তাঁদের ব্যক্তিগত অভিমত বলে শাসক দলও দায় এড়াচ্ছে। এটা একধরনের কপটতা। সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে দল ও সরকার তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের আড়াল করা হচ্ছে।

বিজেপি নেতাদের মন্তব্যে আইনজীবীদের একাংশও ক্ষুব্ধ। ওয়াক্ফ মামলার অন্যতম মামলাকারী আইনজীবী আনাস তানভির বিজেপি দলীয় সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করতে উদ্যোগী হয়েছেন। সে জন্য তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলকে চিঠি লিখেছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ষ ট রপত র র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সময়সীমা বাড়ানো ও শর্ত শিথিল বাস্তবসম্মত

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি বহুপক্ষীয় মত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এর অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনপ্রক্রিয়া। বর্তমানে প্রচলিত নির্বাচনসংক্রান্ত আইন ও ২০০৮ সালের নিবন্ধন বিধিমালার অন্তর্নিহিত কঠোরতা সদ্য গঠিত কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নিবন্ধনের সব শর্ত পূরণ করাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। রক্তস্নাত গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ নীতির হাত ধরে যখন নতুন নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত হচ্ছে, সে মুহূর্তে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে যে সময়সীমা নির্ধারণ করতে দেখা গেছে, তা বাস্তবতার নিরিখে অসংগত, অপর্যাপ্ত এবং নবীন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্য কার্যত একপ্রকার নিষেধাজ্ঞারই নামান্তর।

এমন প্রেক্ষাপটে সদ্যোজাত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি) এবং নতুনধারা বাংলাদেশ (এনডিবি) নিবন্ধনের সময়সীমা বৃদ্ধিসংক্রান্ত যে দাবি তুলেছে, তা বিবেচনা করতে হবে রাজনৈতিক ন্যায়বোধ ও গণতান্ত্রিক ভারসাম্যের নিরিখে।

নির্বাচন কমিশন গত ১০ মার্চ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহ্বান করে, যার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরবর্তী ৪০ দিনকে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের মতো একটি জটিল ও বিস্তৃত প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ প্রায় এক দশক ধরে এ নিবন্ধনপদ্ধতি অকার্যকর ছিল। উপরন্তু এ সময়ের মধ্যেই দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর ও টানা সরকারি ছুটি পড়ে যাওয়ায় প্রশাসনিক গতিশীলতা ও কার্যসম্পাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে।

এ বাস্তবতা বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলো যে নিবন্ধনের সময়সীমা ন্যূনপক্ষে তিন মাস বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে, সেটি নিছক একটি সুবিধার আরজি নয়; বরং তা বর্তমান বাস্তবতার গভীর উপলব্ধি থেকে উৎসারিত এক গণতান্ত্রিক দাবিমাত্র। নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে এ আবেদনকে আন্তরিকতা ও যুক্তিনিষ্ঠতার সঙ্গে গ্রহণ করা এবং দ্রুত সময়সীমা বৃদ্ধির ঘোষণা প্রদান করা।

উল্লেখ্য, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যে নিবন্ধনের কড়াকড়ি শর্তাবলি শিথিল করার পরামর্শ দিয়েছে। কমিশনের মতে, নিবন্ধনের পূর্বশর্ত হিসেবে দেশের ১০০টি থানা বা ৪০টি জেলার স্বীকৃত কার্যালয়, নির্ধারিত হারে নারী প্রতিনিধিত্ব, পাঁচ বছরে একবার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি শর্ত আজকের বাস্তবতায় অনেকটাই ভারসাম্যহীন ও নবীন দলবিরোধী। এ অবস্থায় একদিকে যখন শর্ত পূরণের কাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন, তখন অপর দিকে নিবন্ধনের আবেদন আহ্বান এবং এর জন্য কড়াকড়ি সময়সীমা নির্ধারণ একপ্রকার নীতিগত অসংগতি হিসেবেই প্রতিভাত হয়।

রাজনৈতিক পরিসরকে সুসংবদ্ধ ও বহুমাত্রিক করার জন্য কেবল বৃহৎ ও পুরোনো দলগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে নবাগত দলগুলোর সামনে দেয়াল তুলে রাখলে তা গণতান্ত্রিক বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। বরং একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের উচিত, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের প্রক্রিয়াকে সময় ও শর্ত—উভয় ক্ষেত্রেই আরও সহনীয়, বাস্তবসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমুখী করা।

আমরা আশা করি, নির্বাচন কমিশন অবিলম্বে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের সময়সীমা বৃদ্ধি করবে এবং সেই সঙ্গে শর্ত শিথিলসংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো গ্রহণের প্রক্রিয়া দ্রুততর করবে। গণতন্ত্রের শক্তি বহুমতের স্বীকৃতি ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির বিস্তারে নিহিত—এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ তৈরি করা, রাজনৈতিক দলের হাত-পা বেঁধে দিয়ে তরঙ্গসংকুল নদীতে সাঁতার কাটতে বাধ্য করা নয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দল নিবন্ধনের সময় ২ মাস বাড়ল
  • যুক্তরাষ্ট্রে মাসে বাড়তি শুল্ক দাঁড়াবে ২৫ কোটি ডলার
  • গণপরিষদের বদলে সংস্কার বাস্তবায়নে সময়সীমা
  • অনুমতি পৌনে ১৭ লাখ টন, চাল আমদানি ৫ লাখ ৪০ হাজার
  • সময়সীমা বাড়ানো ও শর্ত শিথিল বাস্তবসম্মত
  • বগুড়া পলিটেকনিকের ১৩ ক্রাফট ইন্সট্রাকটরকে কোয়ার্টার ছাড়তে আল্টিমেটাম