হজরত মুহাম্মাদ (সা.) তখন মক্কায়। কাফেররা তাঁর নবুওয়াতের সত্যতা যাচাই করতে চাইল। মদিনার ইহুদিদের কাছে প্রতিনিধি দল পাঠাল। প্রতিনিধি দল তাদের কাছে মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে জানতে চাইল। ইহুদিরা প্রতিনিধি দলকে তিনটি প্রশ্ন শিখিয়ে দিয়ে বলল, এগুলোর উত্তর সত্য নবী ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল ‘ওই ব্যক্তির অবস্থা বলুন, যে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত জয় করতে করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন।’ প্রশ্নগুলোর জবাবে মুহাম্মাদ (সা.
ওই ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ-তায়ালা নবীকে বললেন, ‘তারা তোমাকে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলো, আমি তোমাদের কাছে তার বিষয় বর্ণনা করব।’ (আল্লাহতায়ালা বলেন,) ‘আমি তো তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দান করেছিলাম।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত: ৮৩-৮৫)
জুলকারনাইন ছিলেন একজন সৎ ব্যক্তি ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দেশসমূহ জয় করেছিলেন এবং সেসব দেশে তিনি সুবিচার ও ইনসাফের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য অর্জনে আল্লাহর কাছ থেকে সব রকম উপায়-উপকরণ পেয়েছিলেন। তিনি দিগ্বিজয়ে বের হয়ে পৃথিবীর তিন প্রান্তে পৌঁছে ছিলেন—পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের শেষে প্রান্তে এবং উত্তরে পর্বতমালার পাদদেশে। পাশ্চাত্যে তিনি এক অবিশ্বাসী সম্প্রদায় পেলেন। তিনি বললেন, ‘আমি এদের প্রথমে দাওয়াত দেব। যারা সৎ পথে আসবে, তাদের প্রতিদান দেব। যারা কুফুরে রয়ে যাবে, তাদের শাস্তি দেব।’
আরও পড়ুনযাঁর নামে কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে০৮ এপ্রিল ২০২৫প্রাচ্যে এমন এক সম্প্রদায় পেলেন, যারা শূন্য ময়দানে থাকত। রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গৃহ, তাঁবু, পোশাকপরিচ্ছদ ব্যবহার করত না। দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যস্থলে এমন এক সম্প্রদায় পেলেন, যারা তার কথা বুঝতে পারছিল না। তারা তাঁর কাছে ইয়াজুজ-মাজুজ থেকে বাঁচার আকুতি জানাল। তিনি দুই পর্বতের মধ্যবর্তী গিরিপথকে একটি সুবিশাল লৌহ প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে ইয়াজুজ-মাজুজের লুটতরাজ থেকে এলাকার জনগণ রক্ষা পায়। (সুরা কাহাফ, আয়াত: ৮৩-৯৭; তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মূল: মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা: ৮১৮)
কোরআনে বর্ণিত জুলকারনাইন কে এবং কোন যুগে ছিলেন, এ সম্পর্কে ইসলামি গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম রাজি (রহ.)-এর মতে, জুলকারনাইনের প্রকৃত নাম সিকান্দার। তিনি দারা ইবনে দারাকে একাধিকবার পরাজিত করেছেন। সিকান্দারের বাবা ছিলেন ইবনে ফিলিবুস ইউনানি।’ (তাফসিরুল কাবির, খণ্ড: ২১, পৃষ্ঠা: ৪৯৩)
আরও পড়ুনকোরআনের যে আয়াত শুনে ইসলামে আগ্রহী হলেন একজন০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ইবনে ইসহাকের বরাতে ইমাম কুরতুবি (রহ.) উল্লেখ করেছেন, ‘জুলকারনাইন ছিলেন মিসরের অধিবাসী। তিনি ইউনান বিন ইয়াফেস বিন নুহ (আ.)-এর সন্তান। ইবনে হিশাম বলেছেন, তার নাম সিকান্দার।’ (তাফসিরুল কুরতুবি, ১১/৪৫)
ইবনে কাসিরের মতে, জুলকারনাইনের সময় ছিল সিকান্দার গ্রিক, মকদুনি থেকে দুই হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আমলে। তাঁর মন্ত্রী ছিলেন হজরত খিজির (আ.)। তিনি পদব্রজে হজে গেলে ইবরাহিম (আ.) মক্কা থেকে বের হয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান, তাঁর জন্য দোয়া করেন এবং উপদেশ দেন। ইবনে কাসিরে আজরকির বরাত দিয়ে আছে, জুলকারনাইন ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে তওয়াফ ও কোরবানি করেন।
আবু রায়হান আল-বিরুনি কিতাবুল আসারিল বাকিয়া আনিল কুরুনিল খালিয়াতে বলেন, ‘কোরআনে বর্ণিত জুলকারনাইন হচ্ছে আবু বকর ইবনে সুমাই ইবনে ওমর ইবনে আফরিকায়স হিমইয়ারি। তিনি দিগ্বিজয়ী ছিলেন।’
আবু হাইয়ান বাহরে মুহিতে বলেন, জুলকারনাইন তিনজন ইয়েমেনি সম্রাটের প্রথম সম্রাট ছিলেন। সাবা কূপের মোকদ্দমায় ইবরাহিম (আ.)-এর পক্ষে ন্যায় সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।’ (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মূল: মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা: ৮১৯)
জুলকারনাইন নবী ছিলেন না। তিনি ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘জুলকারনাইন একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২/ ১১৩)। আবু হুরায়রাহ (রা.)-ও জুলকারনাইনকে সৎকর্মপরায়ণ বান্দা মনে করতেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২/ ১০৩)। আলি (রা.) বলেন, ‘জুলকারনাইন নবীও ছিলেন না, বাদশাহও ছিলেন না; তিনি একজন সৎ বান্দা ছিলেন।’ (ফাতহুল বারি, ৬/ ২৯৫)
লেখক: আলেম
আরও পড়ুনযে ঘটনায় কোরআনের আয়াত নাজিল হয়১১ নভেম্বর ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইবর হ ম ব দশ হ ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
৩১ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন অভিবাসন নীতির অধীনে গতকাল রোববার পর্যন্ত ৩১ বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন সূত্রে এ তথ্য নিশ্চত হওয়া গেছে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ফেব্রুয়ারি থেকে অবৈধ অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে শুরু করে ট্রাম্প প্রশাসন। ফেরত আসা বাংলাদেশিদের মধ্যে ৩০ পুরুষ ও একজন নারী। অভিবাসন-সংক্রান্ত মামলায় হেরে যাওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন এবং বিভিন্ন মামলায় সাজা হয়েছে– এমন ব্যক্তিদেরই ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ঢাকায় যাদের পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজনকে এসকর্ট বা বিশেষ নিরাপত্তাসহ পৌঁছে দিয়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ নিরাপত্তা বিভাগের কর্মীরা। বাকি বাংলাদেশিদের সাধারণ যাত্রীর মতো পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষ গত শনিবার দুপুরে একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে পাঁচ বাংলাদেশিকে। ফ্লাইটটি একই ধরনের যাত্রী নিয়ে নেপাল হয়ে বাংলাদেশে আসে।
ফেরত আসা দু’জনের সঙ্গে গতকাল যোগাযোগের চেষ্টা করে সমকাল। তাদের মধ্যে নোয়াখালীর শাহাদত হোসেন সমকালের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, গত ৯ মার্চ তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়। বিমান খরচ যুক্তরাষ্ট্র সরকার বহন করেছে। শাহাদত হোসেন বলেন, ‘তারা আমাকে এমিরেটস এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে তুলে দিয়েছিল। কোনো অসম্মানজনক আচরণ করেনি। হাতকড়া পরানো বা বাজে কোনো ব্যবহার করেনি। আমি সাধারণ যাত্রীর মতো এসেছি।’
শাহাদত যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ অ্যাসাইলাম চেয়েছিলেন। তা মঞ্জুর না হওয়ায় তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি ৯ মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান।
পুলিশের বিশেষ শাখার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বাংলাদেশি নাগরিকদের যাতে সম্মানের সঙ্গে ফেরত পাঠানো হয়– এ ব্যাপারে শুরু থেকেই জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে সরকার। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকেও এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তোলা হয়। বাংলাদেশের অনুরোধ এবং বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার কারণে বাংলাদেশি কাউকে হাতকড়া পরানো হয়নি বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। অনেক দেশের নাগরিকদের ফেরত পাঠাতে সামরিক বিমান ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশিদের সাধারণ ও চার্টার্ড বিমানে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ট্রাম্প প্রশাসন সে দেশে অবৈধ অভিবাসী এবং ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদকারী বিদেশি শিক্ষার্থীদের পর্যায়ক্রমে নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে, ভারতীয় নাগরিকদের হাতকড়া পরিয়ে সামরিক বিমানবোঝাই করে পাঠানোর ঘটনা গণমাধ্যমে এলে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
জানতে চাইলে ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে কত বাংলাদেশি অবৈধ হয়ে পড়েছেন, তার কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যা এখনও জানতে পারেনি সরকার। কেউ অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হলে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এমন নাগরিকদের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানায় তারা। এর পর সেই তথ্য পাঠানো হয় বাংলাদেশে। পুলিশের বিশেষ শাখা তাদের নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। আর যে কয়েক দফায় ৩১ জনকে দেশে পাঠানো হয়েছে, প্রতিবারই আগে থেকে তা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদের হস্তান্তর করা হয়। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে রেজিস্টারে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করে বাড়ি পাঠানো হয়েছে।
একাধিক সূত্র বলছে, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস আগেই বাংলাদেশ সরকারকে অবৈধ হয়ে পড়া লোকজনকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি অবহিত করেছে। এ নিয়ে সরকারকে কূটনৈতিক পত্র দেওয়া হয়।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিষয়টি দেখভাল করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় একাধিক বৈঠক করে। সেখানে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্রসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, অবৈধ অভিবাসী হিসেবে যারা ফেরত এসেছেন, তাদের আইনি কোনো সহযোগিতা দরকার হলে, সরকার তা করবে। এ জন্য বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাককে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
গতকাল রাতে যোগাযোগ করা হলে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান সমকালকে বলেন, যেসব অভিবাসী বিদেশ থেকে ফেরত আসেন, বিমানবন্দরে তাদের সহযোগিতা করে থাকে ব্র্যাক। প্রয়োজনে তাদের কাউন্সেলিং এবং আর্থিক সহযোগিতাও দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আসাদের ক্ষেত্রে সরকার চাইলে ব্র্যাক সহায়তা দেবে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গত সপ্তাহেও ঢাকায় পুলিশের বিশেষ শাখার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। গত শনিবার যে পাঁচ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল, তাদের বিষয়ে আগেই বাংলাদেশকে অবহিত করা হয়। চার্টার্ড ফ্লাইটে ওই পাঁচজনের বুধবার ঢাকায় পৌঁছার কথা ছিল। বিশেষ কারণে তাতে দু’দিন বিলম্ব হয়। ফেরত আসা এই পাঁচজনের মধ্যে দু’জন নোয়াখালীর বাসিন্দা। বাকি তিনজনের বাড়ি কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে।
যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি সরকারি দপ্তর অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়টি তদারক করে থাকে। দপ্তরগুলো হলো– অফিস অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন এবং ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট। ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ গ্রহণের পর ২৯ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর কাজ শুরু হয়। এতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে এক ধরনের উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর তথ্য এই প্রথম প্রকাশ পেল।