‘আমি এক দুর্ভাগা সন্তান। যার বাবা ছিল। কিন্তু সেই বাবা নগরের খালে হারিয়ে গেল। লাশটিও খুঁজে পেলাম না। সব সন্তান তার বাবার কবরের পাশে দাঁড়াতে পারে। অথচ আমার বাবার কোনো কবর নেই। আমার দাঁড়ানোর কোনো জায়গাও নেই। চার বছর ধরে বাবার লাশের খোঁজে আছি। কিন্তু কেউ আমার বাবার খোঁজ দিতে পারেনি।’ আক্ষেপ ও ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ছাদেকুল্লাহ মহিম। যার বাবা চারবছর আগে এক বৃষ্টির দিনে চট্টগ্রাম নগরের খালে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিলেন। তার খোঁজ আজও মেলেনি।

সোমবার সকালে ছাদেকুল্লাহ মহিম যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছিল। সেই বৃষ্টি যেন বাবাকে আরও বেশি করে মনে করিয়ে দিচ্ছিল মহিমকে। তিনি বলেন, ‘সেদিনও এমন বৃষ্টি ঝরছিল। বাবা মাইজভাণ্ডার জেয়ারতের মনস্থির করেছিলেন। চকবাজারের সবজির দোকানে আমাকে বসিয়ে বেরিয়ে যান। সেই যে বের হলেন, আর ফেরেননি।’

বাবাকে হারানোর দিনের স্মৃতিচারণ করে মহিম বলেন, ‘২০২১ সালের ২৫ আগস্ট সকাল ১১টায় মুরাদপুর নালায় পা পিছলে পড়ে যায় আমার বাবা। আমি ঘটনাটা জানতে পারি দুপুর সাড়ে ১২টায়। তখন আমি ছিলাম চকবাজার বাবার দোকানে। শুনতে পেয়ে ছুটে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। ঘটনা ঘটার আধা ঘণ্টা পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা আসেন কিন্তু ঘটনাস্থলে কাউকে না দেখে চলে যায় তারা। পরে আবার আমরা কল করার পর বিকেল ৩টায় ঘটনাস্থলে আসে ফায়ার সার্ভিস। তখন তারা এবং আমাদের লোকেরা সবাই খোঁজাখুঁজি করেন। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা চলে যায়। কিন্তু আমাদের লোকেরা রাত ১০টা পর্যন্ত বাবাকে খোঁজার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তার পরেরদিন ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা চশমাখাল থেকে শুরু করে মির্জার খাল পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করেন। নালা ভর্তি ময়লা আবর্জনা থাকার কারণে উদ্ধার অভিযানে ব্যাঘাত ঘটে। তারপর বিকেল ৩টায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে। পরে আমাদের লোকেরা ৮-১০ দিন অনবরত খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘পরে নৌকা ভাড়া করে কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট পর্যন্ত মাইক দিয়ে প্রচার করি। যাতে কেউ জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তিকে পানিতে ভেসে আসতে দেখলে আমাকে খবর দেন। তারপরও আমরা এখন পর্যন্ত কোনো খবর পাইনি।’ এখনও বাবার লাশটি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন বলে জানান তিনি।

মহিম বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) গাফিলতির কারণে আমি বাবা হারিয়েছি। কিন্তু চসিক ও সিডিএ কেউ এ দায় নেয়নি। এক সংস্থা আরেক সংস্থাকে দোষারোপ করেছে। কিন্তু দুর্ঘটনা এড়ানোর ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত কেউ নিচ্ছে না। এইখানে যদি কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকতো এবং নালাভর্তি ময়লা না থাকতো তাহলে এই রকম মর্মান্তিক ঘটনা ঘটত না। যা এখনও ঘটে চলেছে।’

ছাদেকুল্লাহ মহিম এখন পটিয়া সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। টিউশনির টাকায় চলছে এক বোন ও মাকে নিয়ে তাদের সংসার। তিনি বলেন, ‘বাবাকে হারালেও কারও থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। যেটা আমাদের মতো নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য খুবই দরকার ছিল। আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন বাবা। আমাদের মাথার ওপর থেকে বাবা নামক ছায়াটা সরে যায়। সে হারিয়ে যাওয়ার পর পরিবারে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এ বিষয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলাম। কিন্তু কোনো সুরাহা পাইনি।’

২০২১ সালের ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর মোড়ে নালায় পা পিছলে পড়ে যান সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ। মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে যান তিনি। পরে আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ছাদেকুল্লাহ মহিমের বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র একটি চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তিন মাস পর চাকরিও দেওয়া হয়। কিন্তু কোন পদ, কিসের চাকরি কিছুই জানানো হয়নি তাকে। মহিম কাজে যোগ দিয়ে জানতে পারেন সিটি করপোরেশনের পেট্রোল পাম্পের শ্রমিক করা হয়েছে তাকে। টানা ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। তখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন মহিম। পড়াশোনার পাশাপাশি ওই বয়সে এমন পরিশ্রমের কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

পরিশ্রম কম এমন একটি পদে চাকরি দেওয়ার অনুরোধ করলেও মেয়র গুরুত্ব দেননি বলে অভিযোগ করেন বাবা হারা মহিম। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর সিটি করপোরেশন বা সিডিএ কেউ তাঁদের খোঁজখবর নেয়নি।

ছালেহ আহমেদের তলিয়ে যাওয়ার ঘটনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে গঠিত কমিটির তদন্তে সিডিএ ও সিটি করপোরেশনকে দায়ী করা হয়েছিল।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজের জন্য সিডিএ এক বছর আগে ওখান থেকে স্ল্যাব সরিয়ে নেয়। সেখানে নিরাপত্তামূলক কোনো নির্দেশনা দেয়নি। আর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘খালে পড়ে নিখোঁজের ঘটনায় কেন তদন্ত কমিটি করা হয়নি আমার জানা নেই। কারণ তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। কিন্তু ওই ঘটনার পর নগরের অরক্ষিত খাল-নালায় নিরাপত্তা বেষ্টনী ও স্ল্যাব বসানো হয়েছিল।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা.

শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এই ধরণের দুঃখজনক ঘটনায় আমরা কেউ দায় এড়াতে পারি না। একজন নগরবাসী হিসেবে ও মেয়র হিসেবে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে ঝুঁকিপূর্ণ খাল বা নালাগুলোতে আপাতত বাঁশ দিয়ে ঘিরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পরে স্থায়ী ঘেরাও দেওয়া হবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: মরদ হ আম র ব ব আম দ র র জন য নগর র র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

সোনারগাঁয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল, বিএনপির প্রতিবাদ

সোনারগাঁয়ে ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় মাস্ক, কাপড় হেলমেট মাথায় দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিলেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তারই প্রতিবাদে সোনারগাঁ উপজেলা ও পৌর বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন।

সোমবার সকাল সাড়ে ৭ টায় হঠাৎ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপজেলার কাঁচপুর নয়াবাড়ি এলাকায় এ মিছিল করা হয়। পরে মিছিলের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ-সার্কেল) আসিফ ইমাম মিছিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

বিকেল ৪টায় সোনারগাঁ পৌরসভার কার্যালয়ের সামনে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিলের প্রতিবাদ জানিয়ে পৌরসভা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিলে বলতে শোনা যায়, জিয়ার সৈনিক এক হও লড়াই করো, হই হই রই রই নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ গেলি কই।

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট পরবর্তীতে সোনারগাঁয়ে এই প্রথম প্রকাশ্যে আওয়ামীলীগের অঙ্গ সংগঠনের ব্যানারে কোন কর্মসূচি করতে দেখা গিয়েছে।  ভিডিওটিতে বলতে শোনা যায় নারায়ণগঞ্জের মাটি শেখ হাসিনার ঘাটি, শেখ হাসিনার ভয় নাই রাজপথ ছাড়ি নাই।

শেখ হাসিনা আসবে বাংলাদেশ হাসবে, জামাত শিবির রাজাকার এই মূহুর্তে বাংলা ছাড়। এসময় ছাত্রলীগের ১৫ থেকে ২০ জন নেতাকর্মী মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। পরিচয় গোপন করতে প্রত্যেকেরই মুখে কালো মাস্ক, হেলমেট কিংবা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়া ভিডিওটি অস্পষ্ট হওয়ায় বিক্ষোভকারীদের কাউকে চেনা সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশ জানিয়েছেন ছাত্রলীগ এই বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। অপর দিকে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিলের প্রতিবাদ জানিয়ে উপজেলা ও পৌর বিএনপি এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ মিছিল বের করে। 

প্রতিবাদ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন সোনারগাঁও পৌরসভা যুবদলের আহবায়ক  মফিজুর রহমান সোহেল,সোনারগাঁও পৌরসভার স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক ফারুক আহমেদ, সোনারগাঁও পৌরসভা ছাত্রদলের সাবেক  আহবায়ক ফরহাদ শিকদার,  শ্রমিকদলের আহবায়ক আবুল হোসেন, সোনারগাঁ পৌরসভা যুবদল নেতা সালে মুসা,আল আমিন, পৌর ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক কাজী নাদিম,ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক তানভীর আহমেদ জনি।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ