হবিগঞ্জে শতবর্ষী গাছ কাটার প্রতিবাদে স্মারকলিপি
Published: 20th, April 2025 GMT
হবিগঞ্জ জেলা পরিষদ মিলনায়তনের সীমানা প্রাচীরের ভেতরের শতবর্ষী গাছ কাটার প্রতিবাদ ও নতুন গাছ রোপণের দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) হবিগঞ্জ জেলা শাখা।
রবিবার (২০ এপ্রিল) দুপুরে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে ধরার এক প্রতিনিধি দল উপস্থিত হয়ে এ বিষয়ে স্মারকলিপি হস্তান্তর করেন। জেলা প্রশাসক মো.
ধরা জেলা শাখার আহ্বায়ক তাহমিনা বেগম গিনি ও যুগ্ম-সদস্য সচিব সিদ্দিকী হারুন স্বাক্ষরিত স্মারকলিপিতে বলা হয়, গত ১৮ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলা পরিষদ মিলনায়তনের সীমানার ভেতরের কয়েকটি মূল্যবান ও পরিপক্ক গাছ কর্তন করা হয়েছে। এই বৃক্ষগুলো দীর্ঘকাল ধরে অত্র এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, বায়ু দূষণ হ্রাস এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। বৈশ্বিক ঊষ্ণায়নের এই দুর্যোগের সময়ে আকস্মিক ও অপরিকল্পিতভাবে এই গাছগুলো কেটে ফেলায় পরিবেশের উপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এতে আরো বলা হয়, গাছ কাটা শুধু পরিবেশের ক্ষতিই করেনি বরং স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। একটি সুস্থ ও সবুজ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য বৃক্ষের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।
আরো পড়ুন:
নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ নিয়ে গুজবের ছড়াছড়ি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে বৃক্ষরোপণ
স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়, অবিলম্বে জেলা পরিষদ মিলনায়তনের পাশে নির্বিচারে গাছ কাটার কারণ তদন্ত করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরণের কার্যকলাপ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্তনকৃত গাছগুলোর স্থানে এবং হবিগঞ্জের অন্যান্য উপযুক্ত স্থানে দ্রুত স্থানীয় পরিবেশের উপযোগী নতুন গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া ভবিষ্যতে যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বৃক্ষ কর্তনের প্রয়োজন দেখা দিলে পরিবেশের উপর সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনা করা এবং পরিবেশ আন্দোলন কর্মীদের মতামত নিতে হবে।
স্মারকলিপি প্রদানকালে ধরা হবিগঞ্জ শাখার পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন আহ্বায়ক তাহমিনা বেগম গিনি, সদস্য সচিব তোফাজ্জল সোহেল, যুগ্ম সদস্য সচিব সিদ্দিকী হারুন, নির্বাহী সদস্য আব্দুল হান্নান, আলোকচিত্রী আশীষ দাস, সমাজকর্মী রেজাউল হাসান রাজু ও খাদিজা আক্তার লিমা।
ঢাকা/মামুন/বকুল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ম রকল প পর ব শ র সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
বৈশাখজুড়ে শতবর্ষী মেলা
বাঙালির নানা রূপের চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে বৈশাখী মেলা একটি। ঐতিহাসিকভাবে মেলার জন্য বিখ্যাত চলনবিল অধ্যুষিত জনপদ তাড়াশ। তাড়াশের কলেজশিক্ষক মোছা. মাসুমা খাতুন বলেন, ‘যেহেতু এই গ্রামীণ জনপদেই জন্ম, সেহেতু চৈত্রসংক্রান্তিতে শ্মশান থেকে হাজরা ছোটা, বৈশাখী মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় দোল খেলা, বায়োস্কোপে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির দৃশ্য দেখে কষ্ট পাওয়া, পতুল নাচ, মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল খেলা, জাদু খেলা দেখা বা সার্কাসের ইয়া বড় হাতি দর্শন জীবনের এক বড় অধ্যায় হয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে ছোট ভাইদের জন্য টিন বা কাঠের বন্দুক, বাঁশের বাঁশি, বেলুন, আম কাটার চাকু, নিজের ও বোনদের কাচের লাল চুড়ি, চুল বাঁধার ফিতা, বনানী নামের স্নো কেনাসহ উপভোগ্য বহু ঘটনা এখনও আমায় স্মৃতিকাতর করে।’
স্থানীয় একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, আশি ও নব্বই দশকেও তাড়াশে অনুষ্ঠিত হওয়া বেশ কয়েকটি বড় মেলায় সন্ধ্যারাত থেকে কুপি বাতি, হারিকেন, হ্যাজাক জ্বালিয়ে চলত নানা অনুষ্ঠান, হরেক রকমের পণ্যের বিকিকিনি। এখন তা চলছে বিদ্যুতের বাতিতে। তাড়াশের ২৯টি বার্ষিক মেলার সবই দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় চান্দ্রক্ষণের ওপর নির্ভর করে। মূলত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলায় চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ– এ তিন মাসে ২৯টি মেলার আয়োজন হয় বিভিন্ন গ্রামে; যার অধিকাংশ মেলার স্থান শত বা অর্ধশত বছর আগে নির্ধারিত। এগুলোর মধ্যে উপজেলা প্রশাসন মেলার ব্যাপকতা, লোক সমাগম ও গুরুত্ব বিবেচনা করে শতবর্ষী বা শতবর্ষের কাছাকাছি ১৭টি মেলাকে একদিনের বিশেষ হাট হিসেবে ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায় বা টোল আদায় করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য– বেহুলার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে বৈশাখী পূর্ণিমায় বিনসাড়া গ্রামে বসে তিন দিনের বেহুলা সুন্দরীর ‘চাঁদের মেলা’। চৈত্রের পূর্ণিমার রাতে তাড়াশের ‘বারুহাঁসের ভাদাই মেলা’, বৈশাখের তৃতীয় মঙ্গলবার বসা বড় ও ছোট ‘গুড়মা মেলা’ এবং কৃষ্ণা দিঘির ‘কৃষ্ণপুরের মেলা’ অন্যতম। অন্যদিকে জ্যৈষ্ঠের শুরুতে বসে ‘গোনতা মেলা’, ‘মাঝদক্ষিণা মেলা’, ‘রানীর হাট মেলা’, ‘আড়ংগাইল মেলা’, ‘দোবিলা মেলা’, ‘বস্তল মেলা’, ‘কুন্দইল মেলা’, ‘গুড়পিপুলের নিশানের মেলা’ প্রভৃতি।
এসব মেলা ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক রেওয়াজ; যা কমবেশি আজও বিদ্যমান। মেলার আগেই ঝি, জামাই, কাছের-দূরের আত্মীয়-স্বজনকে নাইওর আনার প্রচলন রয়েছে এ জনপদে। আজও ‘বারুহাঁস’, ‘গুড়মা’, ‘রানীর হাট’, ‘বেহুলার মেলা’সহ অনেক মেলা বসার আগেই স্থানীয় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মেয়ে জামাই, আত্মীয়-স্বজনে ঠাসা থাকে। এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বৈশাখী মেলার সতেজ আমেজ। সে আমেজে রেওয়াজ মেনে শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে শাশুড়ির হাত দিয়ে নতুন-পুরোনো সব জামাইকে মেলার ‘পরবি’ (নগদ টাকা) এবং মেলা শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় নতুন পোশাক, বিশেষ করে দামি লুঙ্গি উপহার দেওয়া এবং মেলার ঝুরি, মুড়কি, শাঁস, শুকনা মিষ্টি, রান্না করা খাবার বেঁধে আত্মীয় বাড়িতে পাঠানোর চল এখনও রয়েছে। নাইওরে আসা জামাইদেরও এসব মেলায় বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়। মেলা থেকে হাঁড়িভর্তি মিষ্টি, বড় মাছ, মাংস, শাশুড়ির জন্য পান-সুপারি কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে অনেক জামাই শ্বশুরের নাম রাখতে প্রতিযোগিতা করে মেলার সবচেয়ে বড় মাছ কিনে থাকেন। এ ছাড়া শ্যালক-শ্যালিকা ও তাদের সন্তানসহ ছোটদের মেলার পরবি দেওয়া বা অন্য উপহারের আবদার মেটানোও জামাইদের পুরোনো রেওয়াজ। তাড়াশের বৈশাখী মেলায় চিনি দিয়ে তৈরি সুস্বাদু হাতি, ঘোড়া, হরিণ, পাখি আকৃতির ছাঁচ, খাগড়াই, বাতাসা, কদমা প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। আরও রয়েছে বাহারি মিষ্টি রসগোল্লা, চমচম, ছানার জিলাপি, রসমালাই, শাহি, ক্ষীরশা দই। এ ছাড়া মেলায় শত শত মণ ঝুরি বিক্রি হয়। বাঁশ-বেতের জিনিস, কাঠের আসবাব, মসলা, শীতলপাটি, মৃৎ পাত্র, খেলনা, কসমেটিক সামগ্রী, কৃষিজ উপকরণ– হরপাট, কারাল, ডালি, টুপরি, চালুন, কুলা এমনকি হাতপাখা, চুন, পান-সুপারি ইত্যাদি তো আছেই। সব মিলিয়ে তাড়াশের ২৯টি মেলায় দুই-আড়াই মাসের মধ্যে কয়েক কোটি টাকার পণ্য কেনাবেচা হয়। তাড়াশের নওগাঁ জিন্দানী ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক সনাতন দাশ বলেন, ‘এটা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়। সব বয়সী লাখো মানুষের মেলাকেন্দ্রিক বাঙালি সংস্কৃতির অদৃশ্য খোরাক পূরণ হয় এসব মেলায়। উৎসবের মূল্যের কাছে অর্থের মূল্য অতি নগণ্য।’