সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি বিকেএমইএর
Published: 20th, April 2025 GMT
দেশের সব স্থলবন্দ ও কাষ্টমস স্টেশন ব্যবহার করে সুতা আমদানির ব্যবস্থা চালু রাখার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ নীটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনকে চিঠি দিয়েছেন সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
গত ১৩ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুবিধা বাতিল করে এনবিআর। যারা ১৩ এপ্রিল বা এর আগে ঋণপত্র খুলেছিলেন, তারা কী করবেন, এ নিয়ে মাঠ পর্যায়ের অস্পষ্টতা দূর করতে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছে এনবিআরের শুল্ক বিভাগ।
এনবিআরের নতুন আদেশে বলা হয়েছে, যেসব আমদানিকারক ১৩ এপ্রিল বা তার আগে সুতা আমদানির ঋণপত্র স্থাপন করেছেন বা ওই তারিখের আগে সুতা আমদানির ঋণপত্র সংশোধন করেছেন, সেসব ঋণপত্রের পণ্য চালান উক্ত প্রজ্ঞাপনের আওতায় পড়বে না।
স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করার জন্য দেশীয় স্পিনিং মিল মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিন মাস আগে সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া শুরু করে। পরে ট্যারিফ কমিশন থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি পাঠানো হয়।
চিঠিতে দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পের স্বার্থ সংরক্ষণে সব সীমান্ত সংলগ্ন সড়ক ও রেলপথ এবং স্থলবন্দর ও কাস্টমস হাউসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে সুতা কাউন্ট নির্ণয়ে যথাযথ অবকাঠামো প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত আগের মতো সমুদ্রবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুপারিশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করা সংক্রান্ত আদেশ জারি করে।
বাণিজ্য উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য লেখা বিকেএমইএর চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশীয় টেক্সটাইল শিল্প সুরক্ষায় স্থল বন্দরের মাধ্যমে সুতা আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে প্রস্তাবিত এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে চলমান প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, মূল স্টেকহোল্ডার তৈরিপোশাক শিল্পোদ্যক্তাদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র একটি ব্যবসায়িক সংগঠনের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা স্বাপেক্ষে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এছাড়া যে অনুসন্ধানী রিপোর্টের উল্লেখ করা হয়েছে, তা বিকেএমইএকে অবহিত করা হয়নি। এভাবে একতরফা আলোচনার ভিত্তিতে সব স্থলবন্দর ও কাষ্টমস স্টেশন ব্যবহার করে সুতা আমদানির ব্যবস্থা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা বাংলাদেশের তৈলি পোশাক শিল্প বিশেষ করে নীটওয়্যার শিল্পের জন্য ক্ষতিকারক হবে।
যেসব যুক্তি বা অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্থল বন্দর বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তা বিকেএমইএ যথার্থ মনে করে না। এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএর যৌক্তিক কয়েকটি মতামতগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
বিটিএমএর চিঠির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিকেএমইএর মতামতগুলো হচ্ছে-বিটিএমএর তথ্যমতে, বাংলাদেশে সব ধরনের সুতা আমদানিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে ঘোষিত দাম অপেক্ষা স্থলবন্দর থেকে সুতা আমদানিতে উল্লেখযোগ্যহারে অবমূল্যায়ন করা হয়।
‘আমরা মনে করি এই তথ্যটি সঠিক নয় বরং চট্টগ্রাম বন্দর ও স্থলবন্দর থেকে আমদানিকৃত সুতার মূল্য প্রায় সমান বরং কোন কোন ক্ষেত্রে স্থলবন্দর থেকে আমদানিকৃত সুতার মূল্য বেশি। বিগত দিনগুলোর কাষ্টমস ডেটাবেইজ চেক করলে সঠিক তথ্যটি পাওয়া যাবে।’
বিটিএমএর প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে-চীন, তুরস্ক, উজবেকিস্তান ও বাংলাদেশে উৎপাদিত সুতার গড় মূল্য প্রায় সমান। এই তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। প্রকৃতপক্ষে ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, উজবেকিস্তান ও চীনে উৎপাদিত সুতার দাম বাংলাদেশের সুতার দামের তুলনায় কম এবং উল্লিখিত প্রতিটি দেশের এফওবি মূল্য প্রায় সমান। অর্থাৎ আমাদের দেশীয় সুতার দাম বেশি। ডাম্পিং মূল্যে সুতা আমদানির কোন সুযোগ নেই।
কারণ বিগত প্রায় ২৫-৩০ বছর ধরেই ভারতসহ অন্যান্য দেশের সুতার মূল্য, বাংলাদেশের সুতার মূল্যের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ কম। এতদিন ধরে ডাম্পিং মূল্যে কোন দেশ সুতা রপ্তানি করবে না। তাছাড়াও যেখানে বিশ্বের সব দেশের সুতার মূল্য প্রায় সমান, সেখানে সবাই ডাম্পিং মূল্যে সুতা বিক্রয় করবে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।
এছাড়া গত ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভা থেকে জানা গেছে, স্থলবন্দর দিয়ে অবৈধভাবে সুতা প্রবেশ করে। বিটিএমএর অভিযোগ অনুসারে বাংলদেশের আমদানিকারকেরা ১টি ট্রাকের এলসি করে ৩ ট্রাক সুতা আমদানি করে।
এনবিআর এর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে বৈধ উপায়ে ৯৬,০০০ মেট্রিক টন সুতা আমদানি হয়েছে। বিটিএমএর এই অভিযোগ যদি আমলে নেওয়া হয়, তাহলে নিশ্চয় এই পরিমাণের সমান বা দ্বিগুণ সুতা অবৈধ উপায়ে আমদানি হয়েছে। ১টি ট্রাকে যদি ৯ টন সুতা আনা যায়, তাহলে এই বিপুল পরিমাণ সুতা চোরাই পথে আনতে হলে ১০,৬৬৬টি ট্রাক অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করাতে হবে, যা বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় রাষ্ট্রের কাষ্টমস কর্মকর্তাদের যৌথ দুর্নীতির মাধ্যমেও সম্ভব নয়। সুতরাং, এই তথ্যটি আরো বিচার বিশ্লেষণের দাবি রাখে। উপরোক্ত তথ্য প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনভাবেই স্থল বন্দর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সমিচীন হবে না।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ভারত থেকে সুতা রপ্তানি করার ক্ষেত্রে রপ্তানীকারকেরা তাদের রপ্তানির উপরে বিশেষ সহায়তা প্রাপ্ত হন। ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা যদি অবৈধ উপায়ে সুতা রপ্তানি করে থাকে, সেক্ষেত্রে এই সুবিধা তারা পাবে না। তারা নিশ্চয় নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত করে, লস দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে সুতা বিক্রয় করবে না।
স্থলবন্দর চালু রাখার গুরুত্ব এবং প্রয়াজনীয়তা
ফাস্ট ফ্যাশন ভ্যালু অ্যাডেড প্রডাক্ট তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের লিড টাইম অত্যন্ত সীমিত। স্থলপথে যেখানে ৫-৭দিনে সুতা আনা সম্ভব, সেখানে সমুদ্রপথে প্রায় ২৫/৩০ দিন প্রয়োজন। ফলে, স্থলপথে সুতা আমদানি করা গেলে আমাদের প্রত্যাশিত লিড পূরণ করা সম্ভব হবে যা আমাদের রপ্তানির অগ্রগতির জন্য সহায়ক।
এছাড়া অনেক সময় উৎপাদিত পণ্যে গুণগত মান নিশ্চিতে বায়ার কর্তৃক সরবরাহকারী নির্দিষ্ট করা থাকে। এছাড়া উল্লেখ্য, স্থানীয় বাজারের তুলনায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সুতার মান সাধারণত সন্তোষজনক ও তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। সুতরাং আমাদের কাছে কোন বিকল্প পন্থা না থাকায় বায়ার নির্ধারিত সরবরাহকারীর কাছ থেকেই অনেক সময় সুতা সংগ্রহ করা সুবিধাজনক এবং বাঞ্ছনীয়।
এতে বলা হয়েছে, ‘অতীতে দেখা গেছে স্থলবন্দর বন্ধ করা হলে বাংলাদেশি সুতা তৈরির কারখানা মালিকেরা উচ্চমূল্যে সুতা বিক্রয় করা শুরু করে। ফলে, বাজারের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যেহেতু আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রপ্তানি করি সুতরাং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করেই আমাদের সুতার দাম নির্ধারণ করা উচিৎ। অন্যথায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে সক্ষমতা হারাব।’
চট্টগ্রাম বন্দর, যা দেশের ৯০ শতাংশ বাণিজ্য পরিচালনা করে, বর্তমানে বন্দরটিতে অপ্রতুল লজিস্টিক সুবিধা, লোডিং ও আনলোডিং সমস্যা এবং কন্টেইনার জটের সম্মুখীন। তাই কেবল মাত্র সমুদ্রবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি করলে চট্টগ্রম বন্দরের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এর ফলে, পণ্য উৎপাদন সময় বৃদ্ধি পাবে এবং নির্দিষ্ট সময়ে ডেলিভারি ব্যহত হবে, যা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের অসন্তোষ সৃষ্টি করবে এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
স্থল বন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করায় সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে বিকেএমইএ কয়েকটি প্রস্তাবনা দিয়েছে, সেগুলো হচ্ছে-সুতার কাউন্ট নিরীক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট স্থলবন্দর বা কাস্টম হাউসে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপনে বিকেএমইএ প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করতে পাবে। প্রয়োজনে বিকেএমইএ, বিজিএমইএ ও বিটিএমএর একটি টিম সার্বক্ষণিক তদারকিতে রাখা যেতে পারে। এছাড়া, স্থলবন্দর বা কাস্টম হাউসে একটি বিশেষ কাউন্টার বা শেড স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যা কার্যক্রমের সঠিক তদারকি নিশ্চিত করবে।
চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের মোট জাতীয় রপ্তানির ৪৩.
বিকেএমইএ মনে করে বাংলাদেশের স্পিনিং মিলগুলো বেঁচে থাকলে নীটওয়্যার শিল্পই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। কিন্তু, বিটিএমএর উৎপাদিত সুতা কেন বিক্রি হচ্ছে না, তার মূল কারণ অনুসন্ধান না করে, অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে একটি শিল্পকে বাঁচাতে গিয়ে অন্য একটি শিল্পকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া কখনোই প্রত্যাশিত হতে পারে না। মূলত ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে নগদ সহায়তা কমিয়ে দেওয়া প্রকারান্তরে প্রায় বন্ধ করে দেওয়ার ফলে দেশীয় সুতা বিক্রয় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সুতরাং, সব স্থলবন্দর এবং কাস্টমস স্টেশনের মাধ্যমে সুতা আমদানির কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বিটিএমইএ সভাপতি।
ঢাকা/হাসনাত/সাইফ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব ক এমইএর ব ক এমইএ ব ট এমএর উৎপ দ ত আমদ ন র আমদ ন ক ক ষ টমস ঋণপত র র জন য ক স টম আম দ র উল ল খ গ রহণ ব যবস অবদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত-বাংলাদেশ শীতল সম্পর্ক আন্তসীমান্ত বাণিজ্য ও অবকাঠামোর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে
সম্প্রতি আসাম রাইফেলস ও এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স যৌথভাবে এক সম্মেলন আয়োজন করেছে। এ উপলক্ষে আগরতলায় এক সফরে গিয়ে আমাদের আবারও ‘আগরতলা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি)’ পরিদর্শন ও সেখানে আলোচনা করার সুযোগ হয়েছে। কাস্টমস ল্যান্ড স্টেশনগুলোতে আগরতলা আইসিপির মতো সুযোগ–সুবিধা না থাকলেও স্থানটি এক বছরের কম সময় আগেও সীমান্ত কর্মকাণ্ডের এক জমজমাট কেন্দ্র ছিল।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিটি সীমান্ত পয়েন্টে বাণিজ্যের গতি ভীষণভাবে কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আগরতলা-আখাউড়া সীমান্তও। প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার মানুষ এ চেকপোস্ট ব্যবহার করেন। এ সংখ্যা ২০০–এর নিচে নেমে গেছে। ২০২৩–২৪ সালে আগরতলা স্থলবন্দর দিয়ে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩১৮ কোটি রুপি। দৃশ্যত আজ সেখানে কোনো পণ্য চলাচল নেই। আধুনিক, ঝকঝকে আইসিপি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রজন্মগত পরিবর্তনের প্রতীক। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বাণিজ্য ও আন্তসীমান্ত অবকাঠামোর উন্নয়নে উভয় দেশ উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে।
অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ কলম্বো, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্লাংয়ের মতো গভীর আঞ্চলিক সমুদ্রবন্দরের ওপর নির্ভর করে আছে। মাতারবাড়ী বন্দর একবার চালু হলে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট খরচ কমবে, জাহাজে পণ্য পরিবহন সক্ষমতার উন্নয়ন ঘটবে ও দেশটি তার সামুদ্রিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।বর্তমানে আগরতলা আইসিপি–ই যে শুধু দৃশ্যত ফাঁকা পড়ে আছে তা নয়, কয়েক কিলোমিটার দূরে সাব্রুমে নতুন নির্মিত আইসিপিও নীরব। এটি কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। আন্তসীমান্ত ফেনী নদীর মৈত্রী সেতুর কাছে ২৫০ কোটি রুপিতে এ আইসিপি নির্মিত হয়েছে। ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের দক্ষিণ–পূর্বের জেলা খাগড়াছড়ির মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে নদীটি। প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির জন্য এ সুবিধা একসময় অপরিসীম প্রতিশ্রুতির ছিল।
বাংলাদেশও রামগড় স্থল বন্দরের নির্মাণকাজ শেষ করেছে। এটি একবার চালু হলে ভারতের মধ্য দিয়ে সংযোগ সড়ক হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহ এবং সিলেটে কার্যকর যাতায়াতের পথ সুগম হবে। পণ্য পরিবহন ও মানুষ চলাচলের ক্ষেত্রে বিশাল সম্ভাবনা থাকায় সাব্রুম ও রামগড় স্থলবন্দর একত্রে এই অঞ্চলের জন্য যুগান্তকারী পরিবর্তন বয়ে আনবে বলে আশা করা হয়েছিল। এতে ভারতের ত্রিপুরা ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বাসিন্দারা শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধাই নয়, বরং চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ব্যবহারেরও সুযোগ পেতেন। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এক নতুন বাণিজ্যিক করিডর হয়ে উঠতে পারত রামগড় স্থলবন্দর।
অপ্রকাশ্য সম্ভাবনা
বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশের কক্সবাজার। ভারত থেকে এ সৈকতে উল্লেখযোগ্য পর্যটক আসতে দেখা যায়নি। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের মধ্যে দ্বিমুখী চলাচল সুবিধার উন্নয়নে কিছু পরিবর্তন আনতে পারে এ সৈকত। বাস্তবে, এসব আন্তসীমান্ত পথের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যও লাভবান হবে বলে ধারণা করা হয়।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে কখনো যুক্ত হলেই শুধু আন্তসীমান্ত সুবিধাগুলো পূর্ণ সম্ভাবনার স্তরে পৌঁছাবে। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সহায়তায় কক্সবাজার জেলায় এ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষিণে অবস্থিত মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর শুধু বাংলাদেশ ও জাপানের জন্যই নয়, ভারতের জন্যও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ কলম্বো, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্লাংয়ের মতো গভীর আঞ্চলিক সমুদ্রবন্দরের ওপর নির্ভর করে আছে। মাতারবাড়ী বন্দর একবার চালু হলে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট খরচ কমবে, জাহাজে পণ্য পরিবহন সক্ষমতার উন্নয়ন ঘটবে ও দেশটি তার সামুদ্রিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের ওপর বৈশ্বিক মনোযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান বাণিজ্যিক ও কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেশটির আবেদন বাড়িয়েছে। কৌশলগত লক্ষ্য এগিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে ঢাকা নিজেকে তার ঐতিহ্যগত দক্ষিণ এশীয় পরিচয় ছাপিয়ে ক্রমেই আরও বেশি আঞ্চলিক খেলোয়াড় হিসেবে দেখছে। বৃহত্তর পরিসরে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে তার। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিকতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে আছে। মাতারবাড়ী বন্দর দেশটিকে আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্টের একটি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ বন্দরের কার্যক্রম শুরু হলে বড় জাহাজগুলো সেখানে সরাসরি নোঙর করতে পারবে। এতে এ বন্দর বাংলাদেশের সামুদ্রিক সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে। বাংলাদেশের প্রথম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে বড় জাহাজের সরাসরি নোঙর করার সুবিধা নেই। আনুমানিক পরিসংখ্যানে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ‘টোয়েন্টি ফুট ইক্যুইভ্যালেন্ট ইউনিটের (টিইইউ)’ কনটেইনার বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পরিবহন করতে বর্তমানে ৩ হাজার ডলার খরচ পড়ে ও সময় লাগে ৪০–৪২ দিন।
মাতারবাড়ী ৮ হাজার ২০০ টিইইউ–এর বেশি বৃহৎ কনটেইনারবাহী জাহাজগুলো ভেড়ার সুবিধা দিতে পারবে। এতে দ্রুততার সঙ্গে ও সুলভে জাহাজে পণ্য সরবরাহের সম্ভাবনা তৈরি হবে। রামগড় স্থলবন্দর ভারতের আইসিপিগুলো যুক্ত করবে। বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রবন্দরকে কক্সবাজারের সঙ্গে যুক্ত করতে ২৭ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কও নির্মাণ করছে।
বাংলাদেশ বলেছে, ভারতের কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের ফিডার নৌযান সেবাকেও সহায়তা করতে পারবে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর। এই ট্রান্সশিপমেন্ট রূপরেখা শুধু ভারত নয়, স্থলবেষ্টিত নেপাল ও ভুটানের মতো প্রতিবেশীর জন্যও কার্যকর বাণিজ্য–সুবিধা ত্বরান্বিত করতে পারে। যাহোক, এসব সম্ভাবনার অনেকটাই অপ্রকাশ্য রয়ে গেছে।বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ বলেছে, ভারতের কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের ফিডার নৌযান সেবাকেও সহায়তা করতে পারবে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর। এই ট্রান্সশিপমেন্ট রূপরেখা শুধু ভারত নয়, স্থলবেষ্টিত নেপাল ও ভুটানের মতো প্রতিবেশীর জন্যও কার্যকর বাণিজ্য–সুবিধা ত্বরান্বিত করতে পারে। যাহোক, এসব সম্ভাবনার অনেকটাই অপ্রকাশ্য রয়ে গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ ও ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক উত্তেজনা চলার মধ্যে এটি অব্যাহত থাকতে পারে।
হারানো সুযোগ
বিশ্ববাণিজ্যে অনিশ্চয়তা চলার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর শুল্কারোপ তা আরও তীব্র করেছে। সেই সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শীতলতা দক্ষিণ এশীয় উপ–আঞ্চলিক সম্ভাবনাকে আরও বাধাগ্রস্ত করছে। সম্প্রতি বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে দুই নেতার বৈঠকও (অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি) দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তেজনা কাটাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলাফল, দুই দেশের অধিকাংশ সীমান্ত অবকাঠামো অব্যবহৃত পড়ে আছে। কূটনৈতিক সম্পর্কে উষ্ণতা ফেরানো না গেলে মাতারবাড়ী বন্দরের নির্মাণকাজ শেষ হলেও এর পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচিত করা সম্ভব হবে না।
দৃশ্যত, বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই শুধু এ সম্পর্কের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। ততক্ষণ পর্যন্ত উভয় পাশের সাধারণ জনগণকে সুযোগ হারানোর ভার টানতে হবে।