ফ্যাসিবাদের নতুন মুখ: প্রযুক্তি, ধর্ম ও ধ্বংসের জোট
Published: 20th, April 2025 GMT
আজকের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতে ভবিষ্যতের এক অন্ধকার ও বিপর্যস্ত চিত্র উঠে আসছে। এই চিন্তার ওপর ভর করে গড়ে উঠছে এক বিশাল জোট। সেই জোটের মধ্যে আছে উগ্র ডানপন্থী আদর্শবাদী, বড় প্রযুক্তি কোম্পানির মালিক আর দুনিয়াকে ধ্বংস করতে তৎপর পুঁজিবাদ। এরা জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি বা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মতো সংকট না সামলে বরং সংকটগুলোর মধ্যেই মুনাফা খোঁজে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনের প্রচারণার পেছনে ছিলেন পিটার থিয়েল ও ইলন মাস্কের মতো ধনকুবেররা। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এ রকমের এক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। তাঁদের যে রাজনৈতিক প্রকল্প, তা এখন আর সমাজের বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধান করার ভানও করছে না। তাঁরা বরং পরিকল্পিতভাবে সেসব প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিচ্ছেন, যেগুলো জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে গঠিত হয়েছিল। এই ধনকুবেররা গড়ে তুলতে চান প্রযুক্তিনির্ভর এক কল্পনাবিলাসী দুনিয়া, যেখানে কর্তৃত্ববাদই একমাত্র নীতি।
সিলিকন ভ্যালি থেকে আসছে নতুন নতুন তত্ত্ব। প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা ছড়িয়ে দিচ্ছেন এমন তত্ত্ব, যেখানে বলা হচ্ছে যে পৃথিবীতে মানুষ আর টিকবে না। সেখানে রাজত্ব করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
দুনিয়াজোড়া কর্তৃত্ববাদকে কেবল প্রতিহত করলেই হবে না। এমন এক ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষাও সামনে আনতে হবে, যার জন্য লড়াই করা যায়। যে আকাঙ্ক্ষার ভিত্তি হবে মানুষের মর্যাদা।
এই ‘শেষ সময়ের ফ্যাসিবাদের’ কিছু মূল চালিকা শক্তি আছে। সেগুলো হলো দুনিয়া যে ধ্বংস হবে, তা নিয়তিনির্ধারিত। আর তাঁরাই হচ্ছেন সেই ধ্বংসের মধ্য দিয়েও টিকে থাকার মতো শ্রেষ্ঠ মানুষ। জলবায়ু বিপর্যয়, আন্তর্জাতিক অস্থিরতা এবং গণতান্ত্রিক নিয়মের অবক্ষয়ের মুখে এঁরা পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন না। তাঁরা বরং ভাবছেন কীভাবে এই ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবী থেকে নিজে রক্ষা পেয়ে ক্ষমতার একচেটিয়া দখল নেওয়া যায় অথবা কীভাবে এই ধ্বংসাবশেষের ওপর আধিপত্য বজায় রাখা যায়।
হামাস ইসরায়েলে মারাত্মক আক্রমণ চালালে পুরো বিশ্ব বিস্মিত হয়ে দেখল যে প্রবল প্রতাপশালী ইসরায়েলের প্রায় ১ হাজার নাগরিক নিহত হলো। তাদের অনেকেই ছিল সাধারণ নাগরিক। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এর পাল্টা জবাব দিতে কোনো দেরি হলো না। এরপরের মাসেই আক্রমণ করল ইসরায়েল।
সেই আক্রমণ ছিল পৈশাচিক ও নির্মম। গাজায় লাগাতার সামরিক আক্রমণে প্রাণ হারাল প্রায় ৩৩ হাজার নাগরিক। এদের মধ্যে ছিলেন হাজার হাজার শিশু ও নারী। সেই সংখ্যা এখনো বেড়েই চলেছে। সেখান থেকে যে ছবি আর খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে পুরো বিশ্ব শিউরে উঠছে।
গাজাতে এই মানবিক বিপর্যয়ে পৃথিবীর সব মনোযোগ স্বাভাবিকভাবেই সেদিকে গেছে। তবে এর মধ্যে লুকিয়ে আছে গভীর এক মতাদর্শিক সংগ্রাম। এই সংগ্রাম যে কেবল মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজ করছে, এমন নয়। এই লড়াই চলছে আসলে দুনিয়াজুড়ে।
এসবের মধ্যে আমরা আসলে যা দেখছি, তাকে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে নাম দিয়ে তা হলো—‘ফ্যাসিবাদের শেষ সময়’। এ ছাড়া আর কোনোভাবে একে ব্যাখ্যা করা যায় না। এর মধ্যে মিশে আছে কিছু বিষয়। একদিকে দুনিয়া কেমন করে শেষ হয়ে যাবে সেই বিষয়ে ধর্মীয় ধারণা। তার সঙ্গে এসে জুড়েছে অতিজাতীয়তাবাদী আর কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি। এসবের মধ্য দিয়ে দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন দেশের মৈত্রী নতুন আকার পাচ্ছে। আর ফাঁকতালে দুনিয়াজুড়ে বিপদে পড়েছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ।
পুরোনো মৈত্রী নতুন আদলেবেশ কয়েক দশকজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিষ্টান, জায়নবাদী ও ইসরায়েলি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কট্টরপন্থী অংশ বিশ্বজুড়ে খুব অটুট এক বোঝাপড়ার মধ্যে ছিল। এটা খুব কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার যে এদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল খুব সুসংহত। জন হ্যাগির মতো ইভানজেলিক্যাল নেতা দাবি করেছিলেন যে হারিকেন ক্যাটারিনা ছিল ‘স্রষ্টার পাঠানো এক শাস্তি। অপরাধ কী?’
অপরাধ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সমস্যার দুই রাষ্ট্র সমাধান সমর্থন করা। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলকে সমর্থন করার কারণ ইহুদিদের নিরাপত্তা দেওয়া নয়। এই সমর্থন দিতে হবে, কারণ দুনিয়া শেষের যে লড়াই আর যিশুর দ্বিতীয় আগমনের জন্য ইহুদিদের জমায়েত হওয়াটা পূর্বশর্ত। তাই ইসরায়েল রাষ্ট্রকে সমর্থন দিতে হবে, এই হলো জন হ্যাগির বিশ্বাস।
ওদিকে ইসরায়েলে জায়নবাদী ও কট্টর ডানপন্থী দলগুলো প্রতিনিধিত্ব করে ধর্মতত্ত্ব আর জাতীয়তাবাদের মিশ্রণের। এ রকম দুটি দল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কোয়ালিশনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এই দলগুলো তাদের মতাদর্শিক অনুপ্রেরণা পায়, যার কাছ থেকে তাঁর নাম মেইর কাহানে। একসময় এই কাহানেকে ইসরায়েল রাষ্ট্র নিষিদ্ধ করেছিল তাঁর অতি কট্টর খোলাখুলি বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। আর আজ কাহানের শিষ্যরা ইসরায়েলের নীতি নির্ধারণ করে।
কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো এই ‘ত্রাতাবাদী’ জোট যে কেবল প্রতীকী, এমন নয়। এই মৈত্রীর আছে সরাসরি আর হিংসাত্মক ফলাফল। ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গেভির বলেছেন, তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের স্বেচ্ছায় গাজা থেকে চলে যেতে উৎসাহিত করা। আবার ইসরায়েলের ডাক দেন ফিলিস্তিনের সব শহরকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার।
এই মন্ত্রীরা কিন্তু একটা ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলছেন। তাঁরা ফিলিস্তিনের ওপর চালানো এই পৈশাচিক হামলাকে দেখেন স্রষ্টানির্ধারিত এক কাজ হিসেবে। এই হিসেবেই তাঁদের কাছে কোনো শিশু বা নারী হত্যা অপরাধ বলে মনে হয় না।
দুনিয়া ধ্বংসের প্রস্তুতি থেকে কোটিপতিদের গোপন বাংকার২০১৭ সালে নিউইয়র্কার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে আসে ধনীদের এক নতুন পরিকল্পনা। একে বলা হচ্ছে ‘ডুমসডে প্রিপারিং ফর দ্য সুপার রিচ।‘ অর্থাৎ সমাজে বড় ধস নামলে বেঁচে থাকার জন্য ধনীদের তৈরি বিশেষ পরিকল্পনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি ধনকুবের ও হেজ ফান্ড মালিকেরা তখন নিউজিল্যান্ড ও হাওয়াইয়ে বিলাসবহুল বাংকার তৈরি করছিলেন। সেখানে থাকছে ব্যক্তিগত বিমানঘাঁটি, গোপন পালানোর পথ, এমনকি ভূগর্ভস্থ নিরাপদ কক্ষ।
হাওয়াই দ্বীপ কাওআইতে তৈরি মার্ক জাকারবার্গের ‘ছোট্ট আশ্রয়স্থল’ বা পিটার থিয়েলের বিশাল নিউজিল্যান্ড এস্টেট। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন পরিকল্পনা বা হুজুগ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এগুলো একধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। এই ধনীরা মনে করছেন যে সমাজের ধস অনিবার্য। ফলে পুরোনো পৃথিবী বসবাসের একেবারে অযোগ্য হয়ে যাবে। ফলে তারা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা করে রাখছেন।
এই প্রবণতার সঙ্গে মিল রেখে সিলিকন ভ্যালি থেকে আসছে নতুন নতুন তত্ত্ব। প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা ছড়িয়ে দিচ্ছেন এমন তত্ত্ব, যেখানে বলা হচ্ছে যে পৃথিবীতে মানুষ আর টিকবে না। সেখানে রাজত্ব করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একটু খোঁজ নিলেই বোঝা যায়, এগুলোর মধ্যে মিশে আছে ইউজেনিকস বা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। এসবের মূল কথা হচ্ছে—কে বাঁচবে আর কে মরবে, তা ঠিক করবে বাজার; যার হাতে বাজারের মালিকানা, তারাই টিকে থাকবে। যারা বাজারে দুর্বল তারা অনিবার্যভাবেই টিকে থাকার যোগ্য নয়।
এগুলোর মধ্যে ‘লংটারমিজম’ নামে এক মতবাদ বলে যে ভবিষ্যতে এক ট্রিলিয়ন মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। অথচ তারা বর্তমানের কোটি কোটি মানুষের দুঃখ-কষ্টকে তেমন গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। এই মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত আরেকটি বিশ্বাস হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) একদিন মানুষের চেয়ে উন্নত হবে। তখন প্রযুক্তিই হবে নতুন সভ্যতা; পৃথিবীতে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ থাকবে না।
ইলন মাস্ক তো একবার বলেই ফেলেছিলেন, ‘মানবজাতি হচ্ছে কেবল ডিজিটাল সুপারইন্টেলিজেন্সের জেনেটিক বুটলোডার।’ অর্থাৎ মানুষ হচ্ছে একধরনের অস্থায়ী যন্ত্র। এই মানুষকে অতিক্রম করে তৈরি হবে আরও উন্নত কিছু। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষ ‘পরিত্যাজ্য’।
ধ্বংসই উদ্দেশ্যএই আদর্শগুলো বা মতবাদগুলো কোনো সংকটের সমাধান দিতে রাজি নয়। তারা বরং সংকটকে সাদরে বরণ করছে। ট্রাম্প প্রশাসন পরিবেশ আইন, জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রতিষ্ঠান বা তহবিল অবলীলায় বন্ধ করে দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তারা পরিকল্পিত এক বিপর্যয় তৈরি করতে চাইছে। এই অরাজকতা যত বাড়বে, মানুষ তত নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ব্যক্তিগত প্রস্তুতি নেবে। সমাজ বা সামগ্রিক চিন্তা আর কারও মাথায় থাকবে না। তারা তখন কেবল প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানের দিকে ঝুঁকে পড়বে। একবার এই চক্র শুরু হলে এতে লাভ হয় ধনীদের।
স্পেনে একদল জলবায়ু অধিকারকর্মী প্রতিবাদ করে বলছেন, ‘তোমাদের ক্লাউড সিস্টেম টেকাতে গিয়ে আমাদের নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।’ অর্থাৎ এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালাতে যে বিপুল ডেটা সেন্টার লাগছে, তা স্থানীয় পানি শেষ করে দিচ্ছে। এখানে ‘ক্লাউড’ বা ‘তথ্যমেঘ’ কেবল রূপক নয়, এটি একটি বাস্তব সত্যের প্রতীক।
শেষ সময়ের পুঁজিবাদ আসলে এই পৃথিবীকে ধ্বংস করে গড়ে তুলছে এক ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া। আগামী কয়েক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য বিদ্যুতের চাহিদা তিন গুণ বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। নবায়নযোগ্য বা পারমাণবিক জ্বালানি যথেষ্ট দ্রুত বাড়ছে না। ফলে এখনো মূল ভরসা জীবাশ্ম জ্বালানি।
গুগলের সাবেক সিইও এরিক শ্মিট স্বীকার করেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তারের জন্য লাগবে বিশাল পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রকল্প, পানি ও বিরল খনিজ। তারা (প্রযুক্তনির্ভর ধনিক শ্রেণি) যেন পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ আগ্রহী নন। কারণ, তারা আর এই পৃথিবীকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না। একে কাজে লাগিয়ে কেবল অল্প কয়েকজন টিকে থাকাই তাদের কৌশল।
তবে এই প্রযুক্তিনির্ভর অতিধনীরা চিন্তিত অন্য কিছু নিয়ে। আর তা হলো তাঁদের এসব পরিকল্পনার মধ্যে সরকারের হস্তক্ষেপ। তাঁদের ভয়, যদি সরকার কর চাপানো শুরু করে, যদি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, যদি তাঁদের এসব বেহিসাবি কাজ বন্ধ করতে বলা হয়, তখন কী হবে? তাদের কাছে আসল মহাপ্রলয় হলো জবাবদিহির ভয়।
সংকটের পর সংকটসম্প্রতি কয়েকটি সংকট এই সমস্যাগুলো সামনে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে আছে পরিবেশ। একে আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। তাপমাত্রা গত কয়েক বছরে বিশ্বজুড়ে হয়ে উঠেছে অসহনীয়। বাস্তুতন্ত্র পড়ছে ভেঙে। এসব সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া বা ঢেকে রাখার এখন আর কোনো উপায় নেই। আর আমাদের অতিধনীরা মুখে মুখে এসব বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও তলেতলে তাঁরা নিজেদের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন।
এই তো কিছুদিন আগে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় দেখা গেল যে আমাদের এই মানুষের পৃথিবী কত সহজে উলটপালট হয়ে যেতে পারে। দেখা গেল কেমন করে ভয়কে কাজে লাগিয়ে চমৎকার ব্যবসা করা যায়। সেই অতিমারি কেবল এক স্বাস্থ্যসংকট ছিল না। এটা ছিল নজরদারি, কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ আর মানুষের ওপর মানুষের আস্থা ধসিয়ে দেওয়ার নতুন পরীক্ষা।
এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নামের আরেক বাস্তবতা। যন্ত্র কোনো একসময় মানুষকে ছাপিয়ে যাবে—এই ভয় আজ যেন বাস্তব হয়ে দেখা দিচ্ছে। যারা এই ভয় দেখিয়ে বেড়াচ্ছে, সেই নতুন প্রযুক্তি অভিজাতেরাই এই ভয়কে বাস্তব করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরোনো এক ভয়—পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়। রিচার্ড সেইমুর যেমন বলেন, ‘দুনিয়া ধ্বংস হবে কবে, তা আর বিষয় নয়, আমরা এক ধ্বংস হওয়া পৃথিবীতেই বাস করছি।’
এই ভয়াবহ ছুটে চলার শেষ কোথায়? এর জন্য তো দরকার দুনিয়াকে দেখার এক বিকল্প দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি কেবল রাজনৈতিক হলে হবে না। তাঁকে হতে হবে একই সঙ্গে নৈতিক ও আত্মিক। দুনিয়াজোড়া কর্তৃত্ববাদকে কেবল প্রতিহত করলেই হবে না। এমন এক ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষাও সামনে আনতে হবে, যার জন্য লড়াই করা যায়। যে আকাঙ্ক্ষার ভিত্তি হবে মানুষের মর্যাদা। যেখানে সব বিশ্বাসের মানুষ কেবল মানুষ হিসেবেই একে অপরকে শ্রদ্ধা করবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সব বিশ্বাসের শিকড় হচ্ছে ন্যায্যতা।
এই প্রতিরোধের ইশারা পাওয়া যাচ্ছে ইতিমধ্যে। রাষ্ট্রের হিংস্রতাকে উপেক্ষা করে দুনিয়াজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, সিনাগগ আর চার্চে, অন্য অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে মানুষ নিজের আকাঙ্ক্ষার কথা জানাচ্ছেন।
নাওমি ক্লেইন লেখক ও অধিকারকর্মী
এস্ট্রা টেইলর লেখক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ জাভেদ হুসেন
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত ইসর য় ল র র জন ত ক ন তত ত ব ক বল প বল প র র জন য ন র ভর এসব র র ওপর সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমাকে হ্যান্ডকাফ পরানো অমর্যাদাকর
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হ্যান্ডকাফ দেখিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, ‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, আমাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়েছে। এটা আমার জন্য লজ্জাজনক ও অমর্যাদাকর।’
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যার অপরাধের মামলায় রোববার অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে শাজাহান খানকেও ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এ সময় হাতকড়া পরানো নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েন আসামি, পুলিশ, প্রসিকিউশন।
এর আগে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শাজাহান খান, হানাসুল হক ইনুসহ ১৮ জনকে এদিন প্রিজন ভ্যান থেকে হাতকড়া পরিয়ে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নেওয়া হয়। পরে দুপুর ১২টার দিকে তাদের তোলা হয় কাঠগড়ায়। এর মধ্যে শাজাহান খানসহ কয়েকজনকে হাতকড়া পরানো অবস্থায় কাঠগড়ায় নেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, প্রিজন ভ্যানে থাকা অবস্থায় সাবেকমন্ত্রী-এমপিদের পেছনে হাতমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। যা লজ্জাজনক ও অমর্যাদাকর।
এদিকে ট্রাইব্যুনালে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন, পুলিশ সদরদপ্তরের নির্দেশে এসব আসামিদের হ্যান্ডকাফ, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট পরানো হয়েছে। তবে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, সামনের দিনে এখানে আর হ্যান্ডকাফ পরানো যাবে না। যারা এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শাহজাহান খান বলেন, ‘অতীতে আমরা রাজাকারদের হাতকড়া পরাইনি, আমাদের কেন হাতকড়া পরানো হয়েছে? এটা লজ্জাজনক।’
এ সময় মুহম্মদ ফারুক খানের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, ইতোপূর্বে এই আসামিদের হ্যান্ডকাফ ছাড়াই ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হত। কিন্তু কিছুদিন ধরে তাদের হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ট্রাইব্যুনালে আনা হচ্ছে। বিশেষ করে আজ কাঠগড়ায় হাজির করার পরেও কয়েকজন হ্যান্ডকাফ পড়ানো অবস্থায় ছিলেন।
এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য জানতে চান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। পুলিশের দুই সদস্য বলেন, পুলিশ সদরদপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে আসামিদের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিতে হবে।
চেয়ারম্যান বলেন, উনাদের হ্যান্ডকাফ পরানোর প্র্যাকটিস তো এই ট্রাইব্যুনালে নেই, পরাচ্ছেন কেন?
ট্রাইব্যুনালকে পুলিশ সদস্য নুরুন্নবী জানান, পুলিশ সদরদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী আসামিদের হ্যান্ডকাফ, হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে এভাবে হাজির করা হয়েছে।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, আসামিদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের হ্যান্ডকাফ পরানোর নিয়ম রয়েছে। আর কোর্টরুমে আসার আগেই সেটা খোলা হয়। তবে পুলিশ সদস্যরা আসামিদের আজকের আচরণ নিয়ে যেটা আমাদের বলেছেন, তা বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা।
এ সময় শাহজাহান খান বলেন, প্রিজন ভ্যান থেকে নামার আগেই আমাকে পেছনে দুই হাতমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়েছে। আর এজলাসে উঠানোর পর হ্যান্ডকাফ খোলা হয়েছে। আমি তখন পুলিশকে আপত্তি জানিয়ে বলেছি, তোমরা আমাকে নামার আগেই হ্যান্ডকাফ পরাচ্ছো কেন? তাহলে আমি কীভাবে গাড়ি থেকে নামবো। তারা আমার কোনো কথা শুনেনি।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের আরও ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এই দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার ন্যূনতম মর্যাদাটুকু চাই। সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এ সময় প্রশ্ন করেন, ‘আওয়ামী লীগ কি নিষিদ্ধ দল?’
এদিন এই মামলার ১৭ আসামিকে কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, আনিসুল হক, ড. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, সাবেক দুই উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান, ডা. দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, বিচারপতি এ এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনাইদ আহ্মেদ পলক, সাবেক এমপি সোলায়মান মোহাম্মদ সেলিম, সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম।
এছাড়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।