দেশের শেয়ারবাজারে গত সপ্তাহটি কেমন গেল? বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীরাই বা কতটা আশাবাদী? এসব প্রশ্নের জুতসই উত্তর মিলছে না। কারণ, শেয়ারবাজারে অনেক দিন ধরেই উত্থানের চেয়ে পতনটাই বেশি ঘটছে। বদৌলতে সূচক ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে। এতে শেয়ারবাজার নিয়ে উদ্বেগ–আতঙ্ক বাড়ছে।
গত সপ্তাহের মোট চার কার্যদিবসে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১০৮ পয়েন্ট বা ২ শতাংশের বেশি। বাজার মূলধন কমেছে ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। দৈনিক গড় লেনদেন ১৮ শতাংশের বেশি কমে ৪ কোটি টাকার নিচে নেমেছে। আর লেনদেন হওয়া ৩৯৬ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের মধ্যে ২৯৯টিরই দাম কমেছে। দাম বেড়েছে ৭৭টির আর অপরিবর্তিত ছিল ২০টির দাম। এই বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা কতটা আশাবাদী, সেই উত্তর উল্লিখিত তথ্যের মধ্যেই নিহিত।
বাজার অংশীজন থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারী সবারই এখন একটাই বক্তব্য, কেউ ভালো নেই। কারণ, শেয়ারের অব্যাহত দরপতনে সবাই বড় অঙ্কের পুঁজি হারিয়েছেন। বাজার অংশীজনেরা বলছেন, সরকার বদলের পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নেতৃত্বের বদল হলেও বাজারে কোনো আশার আলো দেখা যায়নি। বিদ্যমান সংকটেরও যেন কোনো সমাধান নেই। যে কারণে বাজার কেবলই দরপতনের একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাতে হতাশা বাড়ছে সর্বমহলে।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে সরকার বদলের পর শেয়ারবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারী ও বাজার অংশীজনেরা নতুন আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তখন বিএসইসির নেতৃত্বের বদল ঘটে। এরপর কেটে গেল সাত মাস। এ সময়ে বাজার সংস্কারে যত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে দেখা যাচ্ছে ধীরগতি। এর মধ্যে বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্ব বনাম কর্মকর্তাদের অন্তঃকলহ সবকিছুকে ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নেয়। ফলে বিএসইসিতেই দেখা দেয় স্থবিরতা। সেই স্থবিরতার ভুক্তভোগী হচ্ছেন বিনিয়োগকারী ও অংশীজনেরা।
বিনিয়োগকারী ও অংশীজনেরা মনে করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ কলহ বা মনোমালিন্য ঘুচিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে আস্থায় নিয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে না।
শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গত তিন দিনে ১০ জনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী থেকে শুরু করে বড় ও মাঝারি বিনিয়োগকারী। সবারই কথার সুর এ রকম, সরকার বদলের পর ব্যাংক খাতে দৃশ্যমান যত উদ্যোগ দেখা গেছে, পুঁজিবাজার সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে ব্যাংক খাতের প্রতি আমানতকারীদের হারানো আস্থা যতটা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন, বিএসইসির নেতৃত্ব সেটি পারেননি। ফলে বাজারে নতুন বিনিয়োগ যেমন আসছে না তেমনি পুরোনো বিনিয়োগকারীরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। আর বিএসইসিও যেন অনেকটা অকার্যকর সংস্থায় পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিনের অংশীজন হিসেবে বাজার নিয়ে আমাদের মধ্যে এত বেশি হতাশা আগে কখনো কাজ করেনি। বাজার এখন অনেকটাই দিকনির্দেশনাহীন। বিএসইসির সিদ্ধান্তহীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা বাজারকে এক অনিশ্চিত পথে ধাবিত করছে। বর্তমান বিএসইসি বাজারের মূল সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সেগুলোর সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে বাজারে আমরা আশার কোনো আলো দেখতে পারছি না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, আগে বিএসইসির একটি অংশ দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল। আর এখন বিএসইসি পরিণত হয়েছে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে। সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাজারমুখী নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দীর্ঘদিনের অংশীজন হিসেবে বাজার নিয়ে আমাদের মধ্যে এত বেশি হতাশা আগে কখনো কাজ করেনি। বাজার এখন অনেকটাই দিকনির্দেশনাহীন। বিএসইসির সিদ্ধান্তহীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা বাজারকে এক অনিশ্চিত পথে ধাবিত করছে। বর্তমান বিএসইসি বাজারের মূল সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সেগুলোর সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছেমিনহাজ মান্নান, পরিচালক, ডিএসইএদিকে অতীতে নানা ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় বিএসইসির কর্মকর্তাদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রেও বর্তমান কমিশনকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। একদিকে ঘর সামাল দেওয়া, অন্যদিকে বাজারের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ—দুইয়ের সমন্বয় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে কমিশনকে। তাই কাজের ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে বিএসইসির মুখপাত্রসহ একাধিক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে কারও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসইসির শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা জানান, শেয়ারবাজারে অভিজ্ঞ লোকের ঘাটতি রয়েছে। যাঁরা অভিজ্ঞ, তাঁরা আবার নানা ধরনের সুবিধাভোগী। ফলে কাজ করতে গিয়ে কিছুটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ কারণে টাস্কফোর্সসহ বাজারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। একসঙ্গে অনেকগুলো বিষয়ে সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হলে বাজারে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে আশা করছেন তিনি।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাত্র চার কার্যদিবসে ঢাকার বাজারের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৮০০ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওই সময় লেনদেনও বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছিল। আট মাস পর এসে এখন বাজারের লেনদেন কমে নেমেছে ৪০০ কোটির ঘরে, আর সূচকও ১ হাজার পয়েন্ট কমে আবার ৫ হাজারের কাছাকাছি নেমে এসেছে। শেয়ারবাজারের লেনদেন কমে গেলে তাতে বিনিয়োগকারীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে শুরু করে ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ বাজারের অংশীজনেরাও বড় লোকসানের মুখে পড়েন। ২০১০ সালের ধসের পর থেকে শেয়ারবাজারের এমন পরিস্থিতিই চলছে। মাঝেমধ্যে অবশ্য কিছুটা উত্থান দেখা গেলেও সেটি স্থায়ী হয় না। যার কারণে হঠাৎ হঠাৎ আশার ঝিলিক দেখা গেলেও আবার হতাশার মুখোমুখি হতে হয় বিনিয়োগকারী ও বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। এ অবস্থায় দেশের শেয়ারবাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাই এখন সবার চাওয়া।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স দ ধ ন ত গ রহণ শ য় রব জ র ব এসইস র ন ব এসইস র অ শ জন অ শ জন র ক র যকর ল নদ ন ক জ কর র বদল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শেয়ারবাজারে কাঠামোগত সংস্কারে অগ্রগতি নেই
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জে সুশাসনের অভাব দেশের শেয়ারবাজারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বড় কারণ ছিল। কিন্তু মৌলিক এ জায়গার কাঠামোগত সংস্কারের কোনো উদ্যোগ এখনও নেই। উল্টো বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে খোদ কমিশনের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
এ অবস্থায় শেয়ারবাজার স্বাভাবিক ধারায় চলা তো দূরের কথা, উল্টো দর পতন হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই সব শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছাড়ছেন। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত আট মাসে পরিবর্তনের আশায় প্রায় ২১ হাজার বিনিয়োগকারী নতুন করে বিও অ্যাকাউন্ট খোলেন। কিন্তু একই সময়ে প্রায় ৪৮ হাজার বিও অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি শেয়ারশূন্য হয়েছে। সরকার বদলের পর দীর্ঘ সময়েও দেশের শেয়ারবাজার সংস্কারে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি না থাকায় হতাশা বাড়ছে।
গত অক্টোবরে শেয়ারবাজার সংস্কার প্রস্তাব দিতে পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। গত সাড়ে ছয় মাসে এ টাস্কফোর্স মিউচুয়াল ফান্ড, মার্জিন ঋণ এবং আইপিও ইস্যুতে কিছু বিধিবিধান সংশোধনের খসড়া জমা দিয়েছে। শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিনিয়োগকারী বা বাজার-সংশ্লিষ্টরা আগে যেসব সংস্কার প্রত্যাশা করেন, সেখানে এখনও হাতই দেওয়া হয়নি।
টাস্কফোর্সকে মৌলিক কাঠামোগত সংস্কারে ১৭টি বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব দিতে দায়িত্ব দিয়েছিল বিএসইসি। টাস্কফোর্সের একাধিক সদস্য সমকালকে বলেছেন, সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়নের বিশাল যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো তাদের নিজের পেশাগত কাজের ফাঁকে পরিপালন করা এক প্রকার অসম্ভব। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি সংস্থার চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক শাকিল রিজভী সমকালকে বলেন, শেয়ারবাজারে সুশাসনের অভাবই বড় সমস্যা। সুশাসন না থাকার মূলে ছিল গত কয়েকটি কমিশন। তারা যথেচ্ছভাবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থবিরোধী আইন করেছে। নিজেদের স্বার্থে মন্দ কোম্পানির আইপিও এনেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না এবং নিজেরা জড়াবেন না– এমন পরিবর্তন মানুষ প্রত্যাশা করে। সে লক্ষ্যে এখনও কোনো সংস্কারের দেখা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টাস্কফোর্সের এক সদস্য সমকালকে বলেন, বিগত সময়ে অনিয়ম বা দুর্নীতির নেপথ্যে ছিল কমিশনের শীর্ষ নেতৃত্ব। তাদের কাজের কোনো জবাবদিহি ছিল না। কমিশনের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা এবং বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান এবং কারসাজি চক্র এর সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব তৈরিতে যে ধরনের লোকের প্রয়োজন ছিল, কমিটিতে সে ধরনের লোকের অভাব আছে। তার পরও তারা আগামী মে মাসের মধ্যে শেয়ারবাজারে কিছু ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিতে জনবল কাঠামো এবং তাদের দায়বদ্ধতা ইস্যুতে প্রস্তাব দেওয়ার চেষ্টা করবেন। পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বিষয়েও কিছু সংস্কার প্রস্তাব করা হবে।
টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আল-আমীন বলেন, কাঠামোগত সংস্কারে প্রথমে হাত দিলে হয়তো কাজই করা যেত না। নানা পর্যায় থেকে অসহযোগিতা আসত। কাজ শুরু করার পর দেখছেন, তার অনুমান সত্য। কিছু সাধারণ তথ্য চেয়েও তারা পাচ্ছেন না।
ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বিনিয়োগকারীরা হতাশাগ্রস্ত। তারা কোনো দিশা পাচ্ছেন না। বাজারে কী সংস্কার হবে এবং হলে তাদের পক্ষে হবে কিনা, কেউ তা বুঝতে পারছেন না। বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তা পছন্দ করেন না। ফলে তারা বাজার ছাড়ছেন। বিগত সময়ের দুর্নীতিগ্রস্ত কমিশনের পরিবর্তে নতুন কমিশন গঠনের পর সবাই আশা করেছিল, বাজার ঘুরে দাঁড়াবে এবং মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।